সৌদিতে অবরুদ্ধ সময়ের দিনলিপি

খবরটা এসেছিল দমকা হাওয়ার মতো হঠাৎ করে। কাল (মার্চের শেষে) থেকে পুরো সৌদি আরবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা। মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠল সবাই। হোয়াটসআপ-টুইটারের নোটিফিকেশন আসতে শুরু করল এক এক করে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ মানে বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ। পৃথিবীতে আক্রমণকারী করোনাভাইরাসের কোনো প্রভাব আমরা এই প্রথম টের পেলাম।

ছাত্রদের পৃথিবী মনে হয় আলাদা নিয়মে চলে। কাউকে কাউকে খুব উৎসাহ নিয়ে খবরটা প্রচার করতে দেখা গেল। ভেতরে ভেতরে মনে হয় খুশি হলো কেউ কেউ। ক্লাস বন্ধ মানে কয়েক দিন শান্তি। সকাল সাতটায় তড়িঘড়ি করে ক্লাসে হাজির হতে হবে না। পরীক্ষা নেই, অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার তাড়া নেই। প্রতিদিনের একঘেয়ে রুটিনে যেন একটু বিরাম।
তখনো কেউ সামান্য আঁচ করতে পারেনি কতটা ভয়ংকর সময়ের দিকে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। ক্লাস বন্ধ হলেও সবকিছু স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। ক্যানটিনে খেতে খেতে আড্ডার সময়টা কিছুটা দীর্ঘ হলো। অফার খুঁজে খুঁজে মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করছিল কেউ কেউ।
মদিনা পৃথিবীর সব শহর থেকে একটু আলাদা, সে কথা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলতে হবে না। কোথাও যেতে মন না চাইলেও মসজিদে নববিতে গিয়ে অনেক ভালো সময় কাটানো যায়। গত কিছুদিন ধরে ওমরার ভিসা বন্ধ হওয়ায় বিদেশিরা নেই। তাই এখন অনেকটা স্বস্তিতে মসজিদে নববিতে থাকা যায়।
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার ইফতারের আয়োজন থাকে মসজিদে। প্রতিদিন থাকে খেজুর এবং চা দিয়ে মসজিদে আগন্তুকদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা। তা ছাড়া মাগরিবের নামাজের পর মসজিদের ভেতর কোরআন-হাদিস ও ইসলামি আইনের ওপর নানা কোর্স চালু আছে। পুরুষদের পাশাপাশি নারী এবং শিশুরাও আসে মসজিদে। তাই ক্লাস বন্ধ হলেও সবার ভালোই সময় কাটছিল সব মিলিয়ে।
কিন্তু কদিন যেতেই তাতে ছেদ পড়ল। জনসমাগম এড়াতে সকল কোর্স এবং আপ্যায়নব্যবস্থা বন্ধ ঘোষণা দেওয়া হলো। কদিন পর বন্ধ করে দেওয়া হলো রাসুল (সা.)–এর রওজা জিয়ারাত এবং জমজম পানির সরবরাহ। ধীরে ধীরে শূন্য হতে শুরু করল সারা বছর জনসমাগম থাকা মসজিদে নববির চত্বর।
একদিন এশার নামাজের আজান শুনে কান সচকিত হলো সবার। আজান শেষে মুয়াজ্জিন ঘোষণা দিলেন সবাই নিজ নিজ ঘরে নামাজ আদায় করুন। সত্যি বলতে আমাদের জন্য এটা একটা দুঃসংবাদ ছিল। এ দেশে ছেলেরা সবাই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে। আমাদের ডরমিটরি কিংবা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনও মসজিদের নামাজের সময় অনুযায়ী সাজানো। মসজিদে নামাজ না হওয়া মানে সবকিছু এলমেলো হয়ে যাওয়া।
পুরো সৌদি আরবে বা বলতে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কটি দেশের মধ্যে এখন মাত্র মক্কা ও মদিনার দুটি মসজিদে নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় হচ্ছে। আমাদের ডরমিটরি থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরের মসজিদে নববিতে তখনো যাতায়াত ছিল ছাত্রদের কারও কারও।
এর মধ্য এসে গেল শুক্রবার। মসজিদে নামাজ বন্ধ হওয়ার পর প্রথম শুক্রবার এটি। সাধারণত প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে মসজিদে নববিতে প্রচুর লোকসমাগম হয়। এখন অন্যান্য মসজিদ বন্ধ। তাই পুরো শহরবাসী যে আজ (২৭ মার্চ) মসজিদে ভিড় করবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। রাত তিনটার দিকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে জানা গেল জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মক্কা ও মদিনার দুই মসজিদের ফটক। তাই ঘরেই সবাইকে নামাজ আদায় করতে হবে।

সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছেন বাদশা সালমান। প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য দিনের এই সময়টুকু যথেষ্ট। কারফিউর সময়ে জরুরি প্রয়োজনে যে কেউ চলাফেরা করতে পারবে। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া বের হলে জরিমানা করা হবে ১০ হাজার রিয়াল।
কারফিউ চালু করার পর কদিন অনেককে এমন জরিমানাও করা হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল এমন কিছু ভিডিও।
এর মধ্যে একদিন জানা গেল মদিনায় করোনায় আরও একজন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। প্রায় ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি আফগানিস্তানের নাগরিক। কাজ করতেন একটি রেস্তোরাঁয়। ভয়ানক বিষয়, তিনি হাসপাতালে যেতে অনেক দেরি করে ফেলেছেন। হাসপাতালে যাওয়ার পরপরই তাঁর মৃত্যু হয়।
ভদ্রলোক যেহেতু রেস্তোরাঁর কর্মচারী ছিলেন, তাই বেশি ভয়। কারণ, এই কদিনে বহু মানুষের সঙ্গে তাঁর নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে। এভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে অনেকের মধ্যে। লকডাউন করা হলো পুরো এলাকা।
প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। অনলাইনে কেনাকাটা করা যাচ্ছে সহজেই। মিউনিসিপ্যালিটি জানিয়েছে, প্রতিদিন শ খানেক ডেলিভারিম্যানের লাইসেন্স ইস্যু করছে তারা।
আশঙ্কা ভুল হয়নি। পরদিন থেকেই বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ কিংবা বহির্গমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা লকডাউন করা হচ্ছে। নতুন করে ভয়ের বাতাস ছড়িয়ে পড়ল আবার।
কারফিউর সময় বাড়ানো হয়েছে চার ঘণ্টা। দুপুর তিনটায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব। সংক্রমণ ঠেকাতে কোনো ত্রুটি রাখতে চাইছে না সরকার। তবু হু হু করে বেড়ে চলছে আক্রান্তের সংখ্যা।
প্রতিদিন গড়ে চার শতাধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৬ হাজার ৩৮০ জন। অবশ্য এ দেশে মৃত্যুর হার কম। মারা গেছে এ পর্যন্ত ৮৩ জন। উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা হয়তো অবদান রেখেছে এ ক্ষেত্রে।
সবচেয়ে ভয় এ দেশে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের নিয়ে। কিছু কিছু কাজ থেমে নেই। বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা এখানে প্রচুর। অবশ্য তাঁদেরকে নিরাপত্তার জন্য মাস্ক ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশিদের অনেকে উদ্বিগ্ন তাঁদের স্বজনদের জন্য। সৌদি আরব থেকে বিমান চলাচল ব্যবস্থা আপাতত বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও অনেকে দেশে ফিরতে আগ্রহী। উৎকণ্ঠায় কাটছে তাঁদের সময়।
আবার একটা কোলাহলপূর্ণ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা গোটা বিশ্ব। এই অপেক্ষা শিগগিরই শেষ হোক, এই কামনা।

লেখক: বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা, সৌদি