বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা অস্ট্রেলিয়ায় কেমন আছেন

করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগের দিনে অস্ট্রেলিয়ায় কেমন আছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা, জানতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীদের প্রিয় মানুষেরা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অস্ট্রেলিয়াও আক্রান্ত হয়েছিল ভয়াবহভাবে। পীড়িত অন্যান্য দেশের মতোই শঙ্কায় কুঁকড়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীসহ সব মানুষ। এখন অনেকটায় নিয়ন্ত্রণে অস্ট্রেলিয়ার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির পরিস্থিতি। জনজীবনে ফিরে আসছে স্বস্তি। এ সময়ের সংকট ও উত্তরণ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। সেই কথোপথনের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

ঋদ্দি শ্রী চাকমা
ঋদ্দি শ্রী চাকমা

অর্থনৈতিক সহায়তা দরকার: ঋদ্দি শ্রী চাকমা
আমি গত বছর এখানে পড়তে আসি। পার্টটাইম একটা কাজ করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমার কাজের ঘণ্টা কমে গেছে। ফলে আমার পরিকল্পনামতো আর এগোতে পারছি না। আত্মীয়দের সঙ্গে আছি কিন্তু এই এপ্রিলে একটা আলাদা বাসা নিতে চেয়েছিলাম, সেটা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। আমি যেহেতু বছরখানেক আগে আসছি, সেহেতু আমার একটা ভালো অভিজ্ঞতা আছে এ ধরনের সময়ে কীভাবে পড়াশোনা করতে হয়। তাই পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। তবে অনলাইনে পড়াশোনা করার অভ্যাস করতে সময় লাগছে।
অস্ট্রেলিয়া সরকার কিংবা বাংলাদেশ সরকার অথবা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকেই হোক, আমাদের একটা অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়া দরকার। তবে ম্যাকওয়েরি ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ২৫ শতাংশ ঋণ দিচ্ছে। এ ঋণটা কোর্সের শেষ দিকে দিলেও হবে। এ ছাড়া যারা একদম বিভিন্ন বিল দিতে পারছে না তাদেরকে ২০০ ডলারের ভাউচার দিচ্ছে।
বাংলাদেশে আমাদের অভিভাবকদের বলব চিন্তা না করতে। কারণ অস্ট্রেলিয়া করোনাভাইরাস ভালোমতো ট্যাকল করছে।

*ঋদ্দি শ্রী চাকমা সিডনির ম্যাকওয়েরি ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর অব সাইবার সিকিউরিটির শিক্ষার্থী।


ক্লাস, লাইব্রেরি, আড্ডা এখন নেই: অর্ক হাসান

অর্ক হাসান
অর্ক হাসান

এটা একটা বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে গেছে। তাই সবকিছু ধৈর্য নিয়ে সামলে ওঠার চেষ্টা করছি। আমরা যদি আশা করি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অস্ট্রেলিয়া সরকার টাকা দেবে, তাহলে তো সেটা সম্ভব না। যদি কেউ আমাদের কেয়ার করে, তাহলে সেটা করবে বাংলাদেশ সরকার। তারপর যদি অস্ট্রেলিয়া সরকার কিছু করে, তাহলে অনেক ভালো। আমি সিডনি থেকে একটু দূরে ওলংগংয়ে থাকি, সেখানে কাজ একদম চলে গেছে এমন নয়। অনেকেই গাড়ি নিয়ে উবার ইটসে কাজ করছে। তবে যারা একটু বেশি কাজ, করত আর যারা ওলংগং থেকে সিডনি গিয়ে কাজ করত তাদের সমস্যা হচ্ছে। কারণ ট্রেন বন্ধ থাকায় তারা এখন কাজে যেতে পারছে না।
তবে আশা করা যায়, কিছুদিনে মধ্যে পরিবেশ অনেকটায় স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অনলাইনে পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়। ক্লাসের পরিবেশ, লাইব্রেরি, একটু আড্ডা দেওয়া—এগুলোতো নেই এখন। তবে পড়াশোনায় তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টিগুলো এখন খুবই অ্যাকটিভ, যেকোনো সমস্যায় সঙ্গে সঙ্গে রেসপেন্স করে। এই সময়ে পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বাংলাদেশে থাকলেও তো ঘরেই বসে থাকতাম। বরং এখানে অনেক কিছু করতে পারছি। অভিভাবকেরা আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, দোয়া করবেন।

*অর্ক হাসান ওলংগং ইউনিভার্সিটির মার্কেটিংয়ের (মাস্টার্স) শিক্ষার্থী

চলার টাকা ও পড়ার টিউশন ফির কী হবে: যারীন ইয়াছমিন চৈতী

যারীন ইয়াছমিন চৈতী
যারীন ইয়াছমিন চৈতী

পড়াশোনায় অভার অল সবাই কিছু না কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। তবে আমরা যারা উন্নয়নশীল দেশ থেকে এসেছি, তাদের জন্য একটু বেশি কঠিন। কারণ, এখানকার হাইটেক ফ্যাসিলিটিজগুলোর সঙ্গে আমরা এত পরিচিত নই। যাঁরা আমাদের মতো স্কলারশিপে আছেন, তাঁরা মোটামুটি আর্থিকভাবে কোনো সমস্যায় নেই কিন্তু সেলফ ফিন্যান্সে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের অনেক সমস্যা।
অস্ট্রেলিয়ায় যাঁরা আসেন, তাঁরা কিন্তু অনেকেই এখানে আয় করা যায় ওই ভরসায় আসেন। এখন বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে বেশির ভাগ রেস্তোরাঁ ও কাজের যে সুযোগ ছিল, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তাঁদের রোজগার বন্ধ পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে চাইলেও কেউ এই পরিস্থিতিতে টাকাপয়সা পাঠাতে পারছেন না। এ ছাড়া ব্যাপারটা যেহেতু দ্রুত ঘটে গেল, সেহেতু আগে থেকে কেউ প্রস্তুতিও নিতে পারেননি। শারীরিকভাবে ভালো থাকায় শুধু ইস্যু না। চলার জন্য টাকা লাগবে, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে টিউশন ফি লাগবে। সব মিলে একটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। করোনা থেকে অনেকটায় ঝুঁকিমুক্ত আমরা। আমরা বিদেশি শিক্ষার্থী যাঁরা আছি আশা করি, অস্ট্রেলিয়া সরকার কিছু করবে অথবা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশন ফি কমিয়ে দেবে কিংবা ফি দেওয়ার তারিখটা মাস ছয়েক পিছিয়ে দেবে। সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটা আসেসমেন্ট করা দরকার যে এখানে কতজন পড়ছেন। তাঁদের কার কী দরকার, যেন সে অনুযায়ী সহায়তা দিতে পারে।

*যারীন ইয়াছমিন চৈতী ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্লাইমেট চেঞ্জ (মাস্টার্স) শিক্ষার্থী।


দেশে ফিরে যেতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়: নভোনীল রহমান

নভোনীল রহমান
নভোনীল রহমান

এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা একটা দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক। তবে পুরো সিস্টেমটায় একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে নতুন অনলাইন জীবনও উপভোগ করছি। ঘরে বসেই ক্লাস, পরীক্ষা, আড্ডা ভালোই লাগছে। পুরোপুরি নতুন একটা কনসেপ্ট। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী তাঁদের দৈনন্দিন খরচটা এখানে কাজ করে উপার্জন করতেন, তাঁদের জন্য সময়টা একটু কঠিন যাচ্ছে। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। মানসিকভাবেও চাপে রয়েছে অনেকই।
সাম্প্রতিক বিদেশি ছাত্রদের অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে নিজ দেশে চলে যাওয়ার ঘোষণায় অনেক অভিভাবক চিন্তায় পড়ে গেছেন, তবে বিষয়টা এ রকম নয়। যাঁরা নিজেদের খরচ বহন করতে পারবেন না, তাঁরা চাইলে তাঁর নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন—এটা বলেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। বাংলাদেশে কেউ আমাদের নিয়ে চিন্তিত হবেন না, অস্ট্রেলিয়া অচিরেই করোনাভাইরাস মুক্ত হয়ে যাবে।

*নভোনীল রহমান সিডনির ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর অব বিজনেসের শিক্ষার্থী


বরং বাংলাদেশের জন্য চিন্তিত: আফনান ইয়াসির

আফনান ইয়াসির
আফনান ইয়াসির

কোর্স অনলাইন হয়ে যাওয়ায় টেকনিক্যাল জটিলতা নিয়মিত ব্যাপার। পড়াশোনার কোয়ালিটি কমে গেছে। মূলত আমরা যে কারণে বিদেশে পড়তে আসছি, সেটায় এখন আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া লিভিং স্ট্যান্ডার্ড বা অন্য কিছু কোনো সমস্যা নয়। যদি সেফটির কথা বলেন, বলব এখানে আমরা ভালো আছি। যা সমস্যা আছে, আশা করি তা কয়েক মাসে চলে যাবে। তারপরও যদি কেউ বাইচাঞ্চ আক্রান্তও হয়ে যায়, তাহলে এখানে একটা চিকিৎসা পাবে নিশ্চিত। কারণ এখানে এই সুযোগটুকু আছে। সুতরাং আমাদের নিয়ে বাংলাদেশের কাউকে চিন্তা না করতে বলব।
আমি তো বরং বাংলাদেশের জন্য, মা-বাবার জন্য, আত্মীয়স্বজনের জন্য চিন্তিত।

*আফনান ইয়াসির মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর অব আর্টস (সাইকোলজি) শিক্ষার্থী


ইউনিভার্সিটিও সহযোগিতা করছে: মহিবুর রহমান দীপু

মহিবুর রহমান দীপু
মহিবুর রহমান দীপু

পড়াশোনায় বিশেষ কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কাজ নিয়ে। প্রথমত, যাঁরা কাজনির্ভর, তাঁরা সমস্যা পড়েছেন। এখানে এখন পর্যটক সিজন ছিল। অনেকই ট্যাক্সি চালিয়ে একটু বেশি ইনকাম করতে পারতেন, এবার সেটা হচ্ছে না। কারণ লকডাউনে কোনো পর্যটক নেই ডারউইনে। দ্বিতীয়ত, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য কাজের জায়গাগুলো বন্ধ, তাই তাঁরাও কাজ হারিয়েছেন। আবার সুপারমার্কেটগুলো প্রচুর নতুন কর্মী নিয়েছে, ফলে ঘণ্টা কমে গেছে। এই আর কি ।এ নিয়ে মোটামুটি সবার মন খারাপ।
তবে এখানে কিন্তু ইউনিভার্সিটি সহযোগিতা করছে। যাঁদের চাকরি চলে গেছে, তাঁদের আলাদা করে বৃত্তি দিচ্ছে, যেন টিউশন ফি দেওয়া না লাগে। স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনগুলোও সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশের অভিভাবকেরা কোনো চিন্তা করবেন না আমাদের নিয়ে। ডারউইনে এখন আর নতুন আক্রান্ত নেই। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনও খুব কম হয়েছিল এখানে।

*মহিবুর রহমান দীপু ডারউইনের চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটির মাস্টার অব ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী