হাওয়াই ঘুরে এলাম: মাওয়ি ট্রিপ ১

এমন বাতাস সবসময় হাওয়াই দ্বীপে। ছবি: লেখক
এমন বাতাস সবসময় হাওয়াই দ্বীপে। ছবি: লেখক

বিয়ের পর আমাদের হাওয়াইতে হানিমুনে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বিয়ে টা হোল, বছরের পর বছর গড়াল, অর্ধেক পৃথিবী ঘোরা হয়ে গেল, দশকের পর দশক গড়াল, সেই হাইয়াইতে আর হানিমুন হলো না। এর মাঝে ছানা পোনারাও বড় হয়ে গেছে।

আমাদের প্রতিবছর এডুকেশনাল পারপাসে ক্লাস নিতে হয়, এবার কি মনে করে খুঁজলাম কোথায় যাওয়া যায়। সময়ের সাথে মিলে গেল বলে ঠিক করলাম যাই এবার ফাইনালি হাওয়াই যাই। বরকে বললাম যদি তার ইচ্ছে হয়, আমার সাথে যেতে পারে। বাচ্চাদের স্কুল খোলা, ওদের নিতে পারব না। সেটারও সমাধান হলো - আমার বাবা-মায়ের সাথেই ছানা পোনা থাকবে। আমরা দুজন যাব। নির্দিষ্ট দিনে ভীষন উত্তেজনা নিয়ে রওনা হলাম।

এত দেশ ঘুরেছি, কখনো এত উত্তেজনা লাগে নি। বাড়ির পাশে হাওয়াই যেতে যতটা এক্সাইটমেন্ট ফিল করেছি। যদিও ঘরের কাছে, তবুও যেতে ১২ ঘন্টার বেশি লাগে প্লেনে। তার সাথে আবার চার ঘন্টা সময়ের পার্থক্য। মানে এখানে যদি সন্ধ্যা, ওখানে দুপুর। মানে আমরা সময় গেইন করব। এক সপ্তাহের জন্য হাওয়াই আমাদের ঘরবাড়ি!

আমরা যাচ্ছি মাওয়ি তে!

হাওয়াই প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার একটি স্টেট যেটা অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। হাওয়াইয়ের দ্বীপ সবমিলিয়ে একশত সাইত্রিশটি। এই আইল্যান্ডগুলোর বড়গুলোর একটি হচ্ছে মাওয়ি।

সকালে এয়ারপোর্টে নেমেই চোখে পড়ল পাহাড়ের সারি। রেন্টালকার পিক করতে যেতেই আরামদায়ক বাতাসের ঝাপটা চোখে মুখে। মুখ তুলে দেখি নারকেল গাছের সারি যেন বাতাসে উড়ে যাবে। প্রথমে ভেবেছিলাম ঝড় বোধহয়, পরে ভুল ভাঙল- এটাই এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার! আশেপাশে দেখি বন্য মুরগি, বাচ্চারা ছুটাছুটি করছে।

আমেরিকার সব জায়গায় মুরগি দেখা যায় না। কোথাও কোথাও এগুলো পালা বেআইনি- স্পেশালী মোরগ।

হালেকালা পর্যটক সেন্টার। ছবি: লেখক
হালেকালা পর্যটক সেন্টার। ছবি: লেখক

সেখান থেকে হোটেলের পথে দেখি আম ভরা গাছ, সজনের ডাল- গাছপালা প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছিল ভুল করে বাংলাদেশে চলে এসেছি। এটাই আমাকে এত ভীষন আনন্দ দিচ্ছিল। দেশের নস্টালজিয়া ফিলিং! মনে হচ্ছে কত চেনা!

হোটেলের রিসেপশনের কাজ শেষে বারান্দায় যেতেই সমুদ্র আর হোটেলের পুল দেখে খিদে টা জানান দিল। খুব বেশী খাবারের জায়গা নেই। তারপর আমাদের ভাত মাছ না হলে চলে না- খুঁজে খুঁজে মেডিটেরেনিয়ান বা থাই খাবারের জন্য অস্থির হয়ে যাই- আধা ঘণ্টা, একঘণ্টার ড্রাইভ হলেও সমস্যা নেই। হালাল বা তার কাছাকাছি খাবারের দোকান আমাদের পেতেই হয়। নইলে বাঙালী রসনা মেটে না। থাই খাবারের দোকান পেলাম আধা ঘণ্টার রাস্তা দূরে- সেই সই।

সেখানেও দেখি রাস্তায় মুরগী বেড়াচ্ছে আপন মনে। খেয়ে দেয়ে হাটতে বের হলাম। বিচের পাশেই দোকানপাট, আর সেই হাটতে হাটতেই আবিস্কার করলাম আমাদের বিচে বসার জায়গা। মানুষজন বরশি পেতে রেখেছে। কি ধরছে জিজ্ঞেস করতেই দেখাচ্ছে। পাথরে বাধাই করা সমুদ্রের পার, সেখানে বসে দিগন্ত দেখার মতো মুগ্ধতা আর কিছুতে নাই। পাহাড়, মেঘের খেলা- আর পরিচিত, অপরিচিত গাছপালা - স্বর্গ যেন মাটিতে। আমরা সেই মাছ ধরা লোকদের পাশেই বসে পড়লাম- ভিড় ভাট্টা নেই- বিরক্ত করার কেউ নেই। আমি মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখি। ডাহুক দেখি দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছে। দেশে আমি জীবনে দু একটার বেশি দেখিনি- এখানে অনেক! আর কেউ তাদের বিরক্তও করে না। লোকাল লোকগুলো জেলে ঠিক নয়, লোকগুলো আমাদের বিশাল বিশাল কচ্ছপ কিভাবে স্পট করতে হবে ঢেউয়ের নিচে সেটা দেখিয়ে দিল।

পরদিন সকালে ক্লাসে যেতেই লোকজন আমাকে সুপারি আর ক্যাকটাস চেনায়। আমি মনে মনে বলি, এসব দেখেই আমি বড় হয়েছি। এক গাছে পাখি দম্পতি বাসা বানাচ্ছে- লোকটি ডেকে আমাকে সেটাও দেখালেন। আগে কখনো পাখির বাসা বুনুনো দেখি নি। কি সুন্দর করে পাতার বুনন করে ওরা ঘর বানায়! আমরা দেশে পশুপাখিকে বহুত জ্বালাই, তাই হয়তো ওরা আমাদের দেখলেই দৌড়ে পালায়। এখানে এরা তত ভীতু নয়- আমাদের থোড়াই কেয়ার করে ঘর বানিয়ে ফেলল আমাদের সামনেই।

হাওয়াই প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার একটি স্টেট যেটা অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। হাওয়াইয়ের দ্বীপ সবমিলিয়ে একশত সাইত্রিশটি। এই আইল্যান্ডগুলোর বড়গুলোর একটি হচ্ছে মাওয়ি। হাওয়াই দ্বীপে স্বামীর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
হাওয়াই প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার একটি স্টেট যেটা অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। হাওয়াইয়ের দ্বীপ সবমিলিয়ে একশত সাইত্রিশটি। এই আইল্যান্ডগুলোর বড়গুলোর একটি হচ্ছে মাওয়ি। হাওয়াই দ্বীপে স্বামীর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

ক্লাস শেষে আশপাশে ঘোরাঘুরি। জায়গাটার সাথে পরিচয় পর্ব সেরে নিচ্ছি। যাব ভলক্যানো দেখতে। মানে আগ্নেয়গিরি। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, সমুদ্র পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা। প্রকৃতি যে কি অকৃপণ এখানে! হাজারো প্রজাতির গাছ, ফুল পেরিয়ে আমরা যাচ্ছি ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল দিয়ে ।

এ ইউক্যালিপটাস ও সাধারণ ইউক্যালিপটাস নয়! রেইনবো ইউক্যালিপ্টাস। রেইনবোর মতো রং বলেই এর এমন নাম। এই শার্প ন্যারো রাস্তার মাঝেও কতবার যে গাড়ি থামিয়েছি পাহাড়ের ওপর থেকে দুরের শহর দেখব বলে। ড্রাইভ করতে করতেই হাজির হলাম হালেকালা ন্যাশনাল পার্কে।

বুঝতে পারি নাই কি অপেক্ষা করছে। সেই পাহাড়ের বাঁক বেয়ে, পেজা তুলোর মতো মেঘ ছুঁয়ে আমরা উপরে উঠছি আর উঠছিই- ভয়ে চিৎকারও করেছি কবার যে ঠিক নেই সর্পিল, শার্প বাঁক! আমার পক্ষে এ ড্রাইভ অসম্ভব। ভাগ্যিস ও ছিলো!

হালেকালা ন্যাশনাল পার্ক - সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০ হাজার ফুট ওপরে জীবন্ত কিন্তু বর্তমানে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। যে কোন সময় উৎগীরন হবে। এটা একটা পবিত্র প্লেসও হাওয়াইয়ানদের জন্য। ইচ্ছে হলেই এই আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি মাইলের পর মাইল হাইক করা যায়। আবার এখানে একটি সুবিশাল অবজারভেটরিও আছে কিন্তু জনগনের জন্য উন্মুক্ত নয়। আমরা ঠিক। করলাম ফিরে আসব, বাড়ি যাওয়ার আগে, এসে সূর্যোদয় দেখব আর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ পর্যন্ত হাইক করব। কিন্তু আজ ফিরে যেতে হবে - অন্ধকার হলে আর এই ভয়ংকর পাহাড় বেয়ে নামা যাবে না। ফিরে আরও ঘন্টাখানেক ড্রাইভ করতে হবে খাবারের জন্য।

হাওয়াই দ্বীপে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
হাওয়াই দ্বীপে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

পাহাড় নামার ঘন্টা দুই পরে রাস্তায় দেখি কেউ কেউ একপাশে বাঁক নিয়ে নেমে যাচ্ছে- আমরাও তাদের পিছু নিলাম। সমুদ্র সৈকত! তার অসম্ভব সুন্দর সূর্যাস্ত! আমরা পাহাড়ের উপরে ছিলাম, সেখান থেকে দেখতে পেলাম কালো কালো পাথর! লোকজন জানালো সেগুলো পাথর নয়। কচ্ছপগুলো এখানে সন্ধ্যায় ডাঙায় ফিরে। অবিশ্বাসী মন নিয়ে ভালো করে তাকালাম পাথরের দিকে, দেখি বড় বড় কচ্ছপ ডাঙায় বিশ্রাম নিচ্ছে, কতগুলো পানি থেকে উঠছে, সাথে কিছু বাচ্চাও আছে। সবাই তাদের কোনরকম বিরক্ত না করেই তাদের ছবি তুলছে। আমরাও এবার উপর থেকে দৌড়ে নেমে এলাম আধা মাইল। কাছ থেকে দেখার জন্য। আসলেই বন্যরা বনে সুন্দর!

সেখানে সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমে যেতেই খাবারের জন্য নিজেদের যেতে হল- ঘন্টাখানেক আরো ড্রাইভ করে এবার সেই আমাদের প্রথম স্পটে হাটতেই আবিস্কার করলাম, থাই ফুড ট্রাক-লোকজনের ভিড় দেখে ঠিক করলাম আমরাও ট্রাই করব। ভাগ্যিস ঠিক করেছিলাম! এত ভালো থাইফুড রেস্তোরাগুলোতেও পাওয়া যায় না। আমাদের অর্ডার নিয়ে, আরো ৩০ মিনিট পর যা পেলাম - তা অমৃত বলেই মনে হলো। আমাদের মাওয়ির ফেভারিট ডিনার স্পট হয়ে গেল সেটা। ডিনার শেষে আমরা হাটতে হাটতে আমাদের বসার যায়গায় চলে গেলাম-ঘন্টার পর ঘন্টা পাথরগুলোর উপর বসে সমুদ্র দর্শন- জীবনের কোন অশান্তি যেন আর স্পর্শ করে না! মন শান্ত হয়ে যায়! ঘরে ফেরার তাড়া নাই।

সাহস করে অন্ধকারে সমুদ্র পাড়ে বসে থাকার আরো একটা কারন আছে - হাওয়াই সব কিছু থেকে এত দুরে যে এখানে কোনো সাপ নাই! চলবে...