আমের আঁটির ভেঁপুতে মাউথ অর্গানের সুর

‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা... 

মামার বাড়ি যাই।

ঝড়ের দিনে মামার দেশে
আম কুড়াতে সুখ,
পাকা জামের মধুর রসে
রঙিন করি মুখ।’

গাছ থেকে পাড়া আম হাতে মিক। ছবি: লেখক
গাছ থেকে পাড়া আম হাতে মিক। ছবি: লেখক

মামাবাড়ি বা নানাবাড়ি এখনো বাংলাদেশের শিশুদের শৈশব স্মৃতির অন্যতম অঙ্গ। আমাদের শৈশবের দিনগুলো আরও বেশি জড়িত। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় মা নানাবাড়িতে নায়রে যেতেন। নানাবাড়ি থেকে গরুর গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো। সারা দিন ধরে গরুর গাড়ি আসত আর পরের দিন আমাদের নিয়ে রওনা দিত। গরুর গাড়ির ওপরে বাঁশের চটার তৈরি ছই বসিয়ে দেওয়া হতো, যার সামনে–পেছনে খোলা। তারপর শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে সামনের ও পেছনের সেই খোলা অংশ বন্ধ করে দেওয়া হতো।

আমরা সবাই সেই গাড়ির মধ্যে বসে থাকতাম আর গরুর গাড়ি ক্যা কু ক্যা কু শব্দ তুলে এগিয়ে যেত। আমরা প্রায়ই শাড়ির পর্দার বাইরে গিয়ে গাড়োয়ানের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতাম। এভাবেই একসময় মামাবাড়ি, তথা নানাবাড়ি পৌঁছে যেতাম। তারপর শুরু হতো আমাদের স্বাধীনভাবে পথচলা। যে কটা দিন নানাবাড়ি থাকা হতো সেই কটা দিন স্মৃতি হয়ে থাকত বছরের বাকি দিনগুলোর জন্য।

তত দিনে মায়ের অন্য বোনেরাও চলে আসত তাদের এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে নিয়ে। সারা বাড়ি গমগম করে উঠত বাচ্চাদের কোলাহলে। নানাবাড়িতে বাসার বাইরেই ছিল বিশাল আম এবং কাঁঠালের বাগান। সেখানে সারি করে লাগানো ছিল লেংড়া, হিমসাগর আরও কত রকমের আমের গাছ। আর আলাদা সারিতে ছিল কাঁঠালগাছ।

ঝড়ের দিনে আমরা সব মামাতো, খালাতো ভাইবোন সেই আমবাগানে জড়ো হয়ে যেতাম। তারপর শুরু হতো পাল্লা দিয়ে আম কুড়ানো। সেই কুড়িয়ে আনা আম ছিলে আঁটি আলাদা করে সেগুলোর একটা অংশ দিয়ে আচার বানানো হতো আর বাকি অংশটা কেটে ফালি করা হতো। তারপর পাটায় শর্ষে বাটা হতো। এরপর আমের ফালির সঙ্গে লবণ আর শর্ষেবাটা মিশিয়ে তৈরি হতো সুস্বাদু কাঁচা আমের মাখানি।

কাঁচা ও ডাঁসা আমগুলো দিয়ে তৈরি করা হতো সুস্বাদু টকটক ও ঝালঝাল আমের মাখানি। তবে পুরো কাজটা খুবই সাবধানে করতে হতো। কারণ, কাঁচা আমের কষ খুবই ভয়ংকর জিনিস। এই কষ একবার কোথাও লাগলে আর উঠে না সহজে। সাবান দিয়ে কচলিয়ে ধুয়ে ফেলতে পারলেই তবে রক্ষা। ঠিক একইভাবে আম কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখার সময়ও সাবধান থাকতে হতো। আমরা ছোটরা অবশ্য থোড়াই কেয়ার করতাম। যেই হাত দিয়ে আম কুড়াতাম সেই হাত দিয়েই আবার দেখা যাচ্ছে আমরা হাত–মুখ চুলকাতাম। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাঁচা আমের কষ লেগে যেত। আর আমের মৌসুম যখন শেষ হতো তখন দেখা যেত আমাদের মুখের এবং হাতের অনেক জায়গার চামড়া বদলে নতুন চামড়া জন্ম নিচ্ছে। তখন আমরা টের পেতে শুরু করতাম কোথায় কোথায় কাঁচা আমের কষ লেগেছিল।

আম আঁটির ভেঁপু সাধারণত আমরা তৈরি করতাম পাকা আমের আঁটি দিয়ে। ভেঁপু মানে আসলে শব্দ করা বা হর্ন দেওয়া। এই ভেঁপু থেকে বাস–ট্রাকের হর্নের মতো অদ্ভুত শব্দ বের হতো, সেই কারণে হয়তোবা এমন অদ্ভুত নামকরণ। পাকা আম খাওয়ার পর সেই আঁটি বাসার কোনা–কানচিতে ফেলে দেওয়া হতো। এরপর একসময় সেই আঁটি ফুঁড়ে বেগুনি রঙের লকলকে নতুন চারাগাছ গজিয়ে উঠলে আমরা আঁটিটাকে সেই স্তূপ থেকে বের করে আনতাম। এরপর বাইরের শক্ত আস্তরণটা ফেলে দিলেই বের হয়ে আসত ভেতরের নরম অংশ। চারাগাছটা ভেঙে ফেলে আঁটির দুটো অংশের ভেতরের দিক কোনো শক্ত কিছুর সঙ্গে ঘষে সমান করে নেওয়া হতো। তারপর আমরা খুঁজে বের করতাম কচুগাছ। গ্রামের বাড়ির আনাচে-কানাচেতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজির চাষাবাদ করা হয়। তাই খুঁজে পেতে বেশি কষ্ট করতে হতো না। কচু পাতার অংশ আমের আঁটির মাপে ছিঁড়ে নিয়ে সেটাকে আঁটির দুই অংশের ভাঁজের মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হতো। এরপর বাঁকা দিকের অংশে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিলেই মধুর শব্দে বেজে উঠত আম আঁটির ভেঁপু। এই সুর অনেকটা মাউথ অর্গানের সুরের কাছাকাছি। সারা দিন আমরা সেই ভেঁপু বাজিয়ে বেড়াতাম।

নদীভাঙনের পর যখন কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। তখন আম চুরি করা মোটামুটি একটা শিল্পের রূপ নিল। যেহেতু নতুন ঘরবাড়ি করেছিলাম, তাই সেখানে ফলদ বৃক্ষ ছিল না। আমাদের বাসার উল্টো দিকে রাস্তার অন্য পাশে বর্গিদের বিশাল খোলা জায়গা। আমরা সেখানে সারা দিন বিভিন্ন খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকি। আর ক্লান্ত হয়ে গেলে পাশের আমগাছের ডালে চড়ে বিশ্রাম নিই। সেই গাছে যখন আমের মুকুল আসে, তখন আর আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু তখন বর্গিরা নিয়মিত পাহারা দেয়, তাই আমাদের আম পাড়তে হয় দূর থেকে ঢিল দিয়ে। সেই গাছের আমগুলো আকারে এবং খেতে ততটা সুবিধার না হলেও মোটামুটি সহজলভ্য হওয়াতে আমরা সেটাকেই প্রথম টার্গেট করতাম। এক ঢিলে কখনো একটা আম পাড়া সম্ভব হতো না। কয়েকটা ঢিলে পাড়তে হতো। আম পাড়ার পর আবার মারামারি লেগে যেত কার ঢিলে আমটা পড়েছে সেটা নিয়ে। চুরির আম বাসায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তাই কাঁচাই খেতে হতো। কেউ কেউ বাসা থেকে চুরি করে লবণ নিয়ে আসত। সেই কাঁচা আম খেতে গিয়ে কত যে ঘা হয়েছে ঠোঁটে–মুখে, তার হিসাব নেই।

জীবনের স্রোতে একসময় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি এসে বসতি শুরু করলাম। বর্তমান কর্মস্থলে আসতে হলে বাস থেকে নেমে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। মূল রাস্তা থেকে কিছুদূর এসে বাঁয়ে বাঁক নিলেই চারটা বাড়ি পরেই আমাদের অফিস। এই বাঁকের কোনার বাড়িটায় একটা আমগাছ আছে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার ঋতু মেনে আমের মুকুল আসে। সেখানে আমের ছোট গুটি দেখা যায়। তারপর আমগুলো একে একে বড় হয়। আর প্রতিটা ঘটনারই আমি সাক্ষী। আমের মুকুল কেমন এল, কতটা গুটি হলো আর কতগুলোই বা পরিণত রূপ পেল, সবই মুখস্থ থাকে। বাড়ির মালিক একটা অজি পরিবার। তারা এই আমগাছ বা আমের কোনো কদর জানে না। হয়তোবা তারা ক্রয়সূত্রে আমগাছটা পেয়েছিল। আমিই পাহারাদারের মতো পাহারা দিয়ে রাখি আর গাছের তলা থেকে বিভিন্ন সময়ে আম কুড়িয়ে নিয়ে আসি। আমার অফিসের সবাই এই ব্যাপারটা জানে।

আমাদের সহকর্মী মাইকেল মিকেলপ, যাকে আমরা মিক বলে ডাকি। এখন আমার বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। আমরা দুজনে পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। আমাদের দুজনের মানসিকতায় অদ্ভুত মিল আছে। এ বছর আমগুলো বড় হয়ে যাওয়ার পর মিককে বললাম, তুমি আমাকে আমগুলো পেড়ে দিতে পারবে? মিকের উচ্চতা ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি। গাছের যেসব ডাল থেকে আমি পারতে আমাদের কুটা বা লগা ব্যবহার করতে হয় মিকের হাত অনায়াসেই সেই উচ্চতায় পৌঁছে যায় এবং আয়েসে আমটা পেরে নিয়ে আসে। কাঁচা আম পাড়ার পর সেগুলো বাসায় নিয়ে কেটে বাংলা দোকান থেকে কাসুন্দি এনে ভর্তা করেছিলাম। তারপর ভর্তার সেই ছবি ফেসবুকে দেওয়ার পর অপু ভাই বললেন, ‘ইয়াকুব এইগুলো একা একা খেতে নেই।’ আমি তাঁর কমেন্ট পড়ে তাড়াতাড়ি একটা ছোট বাক্সে করে ভর্তা দিয়ে এলাম। ফিরেই দেখি নাসের দুলাভাইও খেতে চেয়েছেন। আবার বের হলাম তাঁকে একটু ভর্তা দিয়ে আসতে।

আমরা কীভাবে ভর্তা করে খেয়েছি এটা সময়–সময় মিকের সঙ্গে শেয়ার করতাম। এরপর একসময় আমগুলো ডাঁসা হয়ে এল। তখন মিককে নিয়ে শেষবারের মতো আমি পেড়ে আনলাম। আর এই আমগুলো ভর্তা না করে এমনিতেই রেখে দিলাম। কয়েক দিনের মধ্যে আমগুলো পেকে সুন্দর ঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল। তখন সেগুলো বের করে বাচ্চাদের কেটে দিলাম। আমরা অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর এখানে পাওয়া যায় এমন সব রকমের আমই খেয়েছি, কিন্তু এই গাছটার আমের স্বাদ অতুলনীয়। অনেকটা বাংলাদেশের আমের কাছাকাছি মিষ্টি। তাই হয়তোবা বাচ্চারা বেশি পছন্দ করে। একেবারে শেষবারের মতো গত ১৪ এপ্রিল গাছের তলায় তিনটা আমি পড়ে থাকতে দেখলাম। কাছে গিয়ে দেখি, দুটোর বেশির ভাগ অংশই বাদুড়ে খেয়ে ফেলেছে। আর অন্যটার এক কোনা খাওয়া। আমি ঝুঁকে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে এলাম। তারপর একটা পলিথিন ব্যাগে ভরে আমার ব্যাকপেকে রেখে দিলাম। বাসায় আমটা প্রথমে সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিলাম। কারণ, আমার বুয়েটের ছোট বোন শুক্তি বলছিল, ‘ভাইয়া বাদুড়ে খাওয়া আম না খাওয়াই ভালো আর যদি খানও তাহলে বাদুড়ে খাওয়া অংশ ফেলে দিয়েন।’ আমি বাদুড়ে খাওয়া অংশ ফেলে দিয়ে বাকিটা বাচ্চাদের কেটে দিলাম। তাহিয়াকে না দিয়ে রায়ান একাই প্রায় পুরোটা সবার করে দিল।

অস্ট্রেলিয়ায় আমের মৌসুম শেষ হয়ে গেছে বেশ আগেই, কিন্তু এই গাছে এখনো আম আছে। ইতিমধ্যেই করোনার উপদ্রব শুরু হয়েছে, তবু আমাদের অফিস চলছে। অফিসের সবাই একধরনের আতঙ্ক নিয়ে কাজ করছে, যদিও আমরা সামাজিক দূরত্ব থেকে শুরু করে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ঠিকভাবে মেনে চলছি। জীবনকে স্বাভাবিক রাখতে আমরা শৈশব–কৈশোরের দিনগুলো নিয়ে গল্প করি।

আম নিয়েও মিকের সঙ্গে অনেক কথায় হয়েছে। বিশেষ করে কাঁচা আমগুলো পাড়ার দিনে আমি বললাম, ‘অফিসে ফিরে তাড়াতাড়ি সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নাও। নাহলে তোমার হাতের যে জায়গাগুলোতে কষ লেগেছে সেখানে ঘা হয়ে যেতে পারে।’ তখন আমাদের ছোটবেলার গল্পগুলো বললাম। এ ছাড়া আম পাড়ার সময় বললাম, ‘আমাদের দেশে যখন গাছ থেকে আম পাড়া হয়, তখন কিছু আম রেখে দেওয়া হয়, যাতে পাখি, বাদুড় খেতে পারে।’

শেষ আমটা কুড়িয়ে আনার পর বললাম, আম আঁটির ভেঁপুর গল্প। শুনে ও খুবই আনন্দ পেল। এমনকি আমরা গাছের তলা থেকে দুটো আঁটিও কুড়িয়ে এনেছি। আমি মিককে বললাম, এখন শুকনো আঁটিগুলো দিয়ে ভেঁপু বানানো যাবে না। এগুলোকে মাটির মধ্যে ফেলে রাখলে রস পেয়ে স্ফীত হয়ে গাছ বের হবে, তখন এগুলোকে মাটি থেকে বের করে আম আঁটির ভেঁপু বানাব আর আমার মেয়ে সেটা বাজিয়ে বেড়াবে সারা দিন ধরে। শুনে মিক বলল, শব্দটা কেমন হয়? আমি বললাম, মাউথ অর্গানের মতো। শুনে ও খুবই বিস্মিত হলো। বললাম, আমাদের আটপৌরে শৈশবে আমরা সব খেলার উপকরণ প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতাম। কারণ, প্রযুক্তি তখনো গ্রামীণ জীবনে তার কালো থাবা বসায়নি। পাশাপাশি এ–ও বললাম, শৈশবের বেশির ভাগ খেলাধুলার জন্যই কোনো টাকাপয়সা লাগতো না, উপরন্তু সেগুলো ছিল একটি শিশুর সুস্থ–স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার বাহন। আমরা বেড়ে উঠেছিলাম মাটির রসের আদরে, বাতাসের মমতামাখা স্পর্শে আর সূর্যের শাসনে, তাই আমরা জীবনে কখনোই বিষণ্নতায় ভুগি না। যদিওবা কখনো আমাদেরকে বিষণ্নতা পেয়ে বসে, তখন আমরা আমাদের ছোটবেলার কথা ভাবি, যখন আমরা আম আঁটির ভেঁপু বাজিয়ে আনন্দের জয়গান গাইতাম।