করোনা তুমি কার

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

কোনো এক অদ্ভুত আঁধারের কারণে কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘...পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া...।’ তাঁরা কারা? ডোনাল্ড ট্রাম্প, নাকি পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তিধরেরা? না, তাঁদের কেউ নন। তাঁদের আচরণ কেবলই শিক্ষা দিয়েছে সিংহ আর বাঘ মিলে বিড়ালকে পরাস্ত করার জয়ধ্বনি।

শক্তিধর হলে তো নিজ দেশের এত বড় ক্ষতিতে আজ চুপ করে বসে থাকতেন না। প্রতিহিংসার রোষে যুদ্ধবোমার মতোই প্রতিপক্ষের ওপরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দিতেন। নিজেরা আরাম-আয়েশে বসে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীর মরণ হাসিমুখেই দেখতেন। জয়ের ঘণ্টা বাজিয়ে উৎসবে মেতে উঠতেন। আমেরিকা, ব্রিটেন বা ইউরোপের মতো দেশে কিছুতেই করোনাভাইরাস ছড়াতে পারত না। প্রতিদিন কোটি কোটি ডলার আয়ের উৎসগুলোও এক দিনের জন্য বন্ধ হতো না।
বিচারক সাহেব সব সময় অন্যের রায় দিলেও আজ তিনি নিজের রায় দেখার জন্য উপরওলার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আছি গৃহবন্দী। মনে হয়, আপাতত জামিনে আছি। করোনা ধরে বসলে সিদ্ধান্ত হবে, জেল হবে নাকি ফাঁসি? চিকিৎসাহীন মৃত্যু হলে ফাঁসির চেয়ে কম কিসে? ধনী-গরিব বৈষম্যে উঁচু–নিচু ছিল, আছে ও থাকবে...। করোনাভাইরাস আজকের মানবজাতির জন্য অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। এ মহামারিতে প্রভু কোথায় কাকে কী শিক্ষা দিচ্ছেন, তিনিই ভালো জানেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি, সব মানুষ ঘরে বসে আল্লাহকে ডাকছে। ভালো কাজ করছে। সবাই প্রভুভক্ত হয়ে গেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে। প্রত্যেকেই আরাধনার পাশাপাশি নিজ নিজ ধর্মের বই পাঠ করছে। কেউ কারও কোনো ক্ষতি করছে না। যুদ্ধ, চুরি-ডাকাতি ও হত্যা–খুন সবই বন্ধ। প্রভু কি এমন একটি বিশ্বই দেখতে চান?
এমনটা কী করে সম্ভব? শয়তানি না থাকলে দুনিয়া চলবে কী করে? দুনিয়াতে কোনো শয়তানি না থাকলে ফেরেশতারাই যথেষ্ট ছিলেন।

ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স
ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স

মানুষের প্রতিপক্ষ শয়তান আজ সফল। শয়তান প্রাপ্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে সার্থক হয়েছে। মানুষকে ঠকাতে পেরেছে। মানুষের অস্থিমজ্জায়ও ঢুকতে পেরেছে। নিজের সংস্পর্শে মানুষকেও শয়তান বানাতে পেরেছে। মানুষের মাধ্যমে সে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অত্যাচার, অবিচার আর অপকর্ম পৌঁছাতে পেরেছে। শয়তান মুমিনদের কাছ থেকে দূরে থাকলেও মুনাফিকের রগে রগে ঢুকে নিজ শর্তের বাস্তবিক রূপ দিয়েছে। মানুষও তার সুবাদে সব কুকর্মের পথ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে।
প্রভু মানুষের সব রকম শয়তানি সহ্য করে নিলেও তার সীমা অতিক্রম সহ্য করেন না। সীমা লঙ্ঘনের এ পর্যায়ে এসে মানুষ এখন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি জাত নিয়ে ব্যস্ত। প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য কেউ ব্যস্ত নয়। পৃথিবী এখন প্রভৃতি জাত দিয়ে ভরে গেছে। প্রকৃত মানুষ আর মনুষ্যত্ব দিয়ে ভরে ওঠেনি। যেখানে মানবতা বিসর্জনে, সেখানে কী হবে মানুষ দিয়ে, মানুষের এত সব জাত দিয়ে।
সিদ্ধান্ত একমাত্র তাঁর, যিনি সব জাতিকেই সৃষ্টি করেছেন। তাহলে ভজরঙ্গের গৌরাঙ্গ কী করছেন? এখন আর বলার উপায় নেই, করোনা কোনো নির্দিষ্ট দেশ, জাতি বা গোষ্ঠীর। মানুষের অধিকার হরণ, খুনাখুনি আর ক্ষমতার বাহাদুরি বিশ্বজুড়েই প্রাধান্য পেয়েছে।
করোনার হামলা দেখে কিছু লোক ক্ষোভের তৃষ্ণা মেটাতে বলছেন, সেকেন্ড হোম এখন কোথায় যাবে? হোম দিয়েই–বা কী হবে? করোনা তো সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। অপরাধচক্রের বিত্তশালীদের মনে অবশ্যই নাড়া দেওয়ার কথা, করোনা এসে পৃথিবী অচল করে রাখলে প্রচুর ধনসম্পদ দিয়ে কী হবে? যদিও সচল পৃথিবী অচলের জন্য সৃষ্টি হয়নি। এখন দেখছি সচল পৃথিবীতে অচলের বিস্তার প্রকট। কেউ জানে না, করোনার থাবা থেকে নিজেরও রক্ষা হবে কি না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় বলতে হয়, ‘আত্মার অবসাদ ঘটতে দেবো না, মরবার সমস্ত লক্ষণ দেখেও।’ এ স্বীকারোক্তি মেনে নেওয়ার পরেও মনোভীতিতে বলি, এই বুঝি করোনা এসে আমাকে গিলে ফেলল? কোন রাজ্যের রাজা বা মন্ত্রী জানে, আজ কিংবা কালই করোনার আঘাত তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে না?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মৃত্যু নেই, রাজা-প্রজা এবং ধনী-গরিব—কারও বেলাতেই কোনো গ্যারান্টি নেই। মৃত্যু অনিবার্য, সব রকম গ্যারান্টিই আছে। আমরা ক্ষণস্থায়ী, এ কথা জেনেও মন্দের পথ ছাড়ছি না। করোনার আধিপত্য দেখে এখনই আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। মানুষ হিসেবে আমরা সীমা লঙ্ঘন ছাড়ি। আজই অত্যাচার–অবিচার বন্ধ করি।
করোনার এমন কী ক্ষমতা আছে, মানুষকে মেরে ফেলতে পারে? বোঝাই তো গেল, প্রেমের কারণে মানুষ শ্রেষ্ঠ হলেও অত্যাচার–অবিচার আর অপরাধের কারণে করোনাভাইরাসও মানুষকে মৃত্যু এনে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ক্ষমতাধর করোনাকেও এ ক্ষমতা দিয়ে পাঠাতে পারেন। এ ক্ষমতাও যে একান্তই তাঁর, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ শ্রেষ্ঠ এবং সেরা হয়েও আজ সামান্য একটা কীট বা করোনার কাছে জিম্মি। কেন জিম্মি, আল্লাহই ভালো জানেন।
আমাদের এখন করোনার থাবায় সর্বহারা হতে বেশ আপত্তি। এ মরণ কেউ চান না। চাওয়ার কথাও না। কিন্তু প্রভু যদি চান, আমরা কী করতে পারি? করোনায় মানুষ মরছে। মরণ অব্যাহত আছে। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না। ফয়সালা যাঁর, ভরসাও তাঁর। ভালো-মন্দের ফয়সালা এখন তাঁর বৈঠক থেকেই হোক। করোনার এই দিনে মানুষ তার মনুষ্যত্বের সঠিক করুণা বেছে নিক।
‘একে পাপ করে দশে পইড়া মরে।’ করোনাভাইরাস এখন সারা বিশ্বের। ক্ষমতার অপব্যবহার, অত্যাচার, নির্যাতন ও ধর্ষণ বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। এদের বলি হচ্ছে জনসাধারণ, নিষ্পাপ শিশু ও নিরীহ শ্রমিক। বিশ্বের অধিকাংশ শ্রমিকই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। শাসকের শোষণ আর হর্তাকর্তা মিলে চিরদিনই দুর্বলকে মেরে খাওয়ার দক্ষতা দেখিয়েছে।
হে প্রভু! আপনি কঠিন না হয়ে আমাদের প্রতি দয়া করুন, ক্ষমা করুন। আপনি নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল।