বেঁচে থাকলে একদিন দেশে ফিরব

ইরানের কোম শহরে করোনাভাইরাস নির্মূলে বাংলাদেশের পতাকা হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করে একদল প্রবাসী বাংলাদেশি। ছবি: লেখক
ইরানের কোম শহরে করোনাভাইরাস নির্মূলে বাংলাদেশের পতাকা হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করে একদল প্রবাসী বাংলাদেশি। ছবি: লেখক

ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে আমার বর্তমান ঠিকানা এই শহরের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরি। দেশ থেকে আসার সময় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিই ছিলাম। বিভিন্ন কারণে একে একে সবাই চলে গেছেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে বাংলাদেশি শুধু আমি একাই।

সর্বশেষ যে ডরমিটরি ছেড়ে গিয়েছে তার যাওয়ারও প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছে। তবে সে ডরমিটরি ছেড়ে গেলেও মাশহাদ শহর ছেড়ে যায়নি। আগে ডরমিটরিতে থাকত, এখন কয়েক কিলোমিটার দূরে ফ্যামিলি বাসায় থাকে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কারণে ডরমিটরিতে আসে, কখনো কখনো আমিও তার বাসায় যাই। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ দুই মাসে মাত্র এক দিন তার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ডরমিটরিতে থাকি, ডরমিটরি কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের বিষয়ে খুবই আন্তরিক এবং করোনাভাইরাসের কারণে বিভিন্ন সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথম থেকেই প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে ডরমিটরিতে দায়িত্বরত কর্মকর্তা প্রতিটি রুমে গিয়ে ছাত্রদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছেন। ফার্স্ট এইড রেডি রাখা হয়েছে। কারও জ্বর বা কাশি হলেই একটা বিশেষ রুমে কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে। প্রতিদিনই ডরমিটরির রুমগুলোর দরজার হাতল, সিঁড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে ডরমিটরিতে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। একেবারেই বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাত্র ডরমিটরির বাইরে যেতে পারবেন না। আর বাইরে যাওয়া-আসার সময় দায়িত্বরত দারোয়ান মাস্ক ব্যবহার ও স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের ডরমিটরির কয়েকজনের হালকা জ্বর-কাশি হলেও আল্লাহর রহমতে এখনো কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি।

গত মার্চ মাসের শুরুর দিকে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হলে ইরানের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোলা থাকে শুধু বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের ডরমিটরিগুলো। ইরানের শিক্ষা-গবেষণা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মতে, বিশ্বের ১২৯টি দেশের ৪০ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী ইরানে লেখাপড়া করছেন। যাঁদের অধিকাংশ করোনা পরিস্থিতিতে ইরানের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইরানে আটকা পড়ে যান। তুরস্ক, আজারবাইজান, ভারতসহ কয়েকটি দেশ বিশেষ বিমান পাঠিয়ে ইরানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পরে ইরান-আমেরিকা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তেহরানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ-তৎপরতা শুরু করেছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ইরানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য তাদের কোনো বিশেষ নির্দেশনা বা তৎপরতা দেখিনি। আর আমরাও দূতাবাসে যোগাযোগ করিনি। কারণ, চীনের উহান থেকে কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর পরামর্শ ছিল যে চীন থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দেশে না ফেরাটাই উত্তম। কারণ, এতে তাঁদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে আর যদি এমনটি হয়, তাহলে দেশ ও দেশের মানুষের আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিদেশফেরত ব্যক্তির পরিবারটি। বিষয়টি চিন্তা করে প্রথম থেকেই দেশে ফেরার চিন্তা বাদ দিয়েছি। যদিও বাড়ি থেকে মা–বাবা দেশে ফেরার জন্য বলছিলেন, কিন্তু তাঁদের জানিয়ে দিয়েছি, করোনা পরিস্থিতি ঠিক না হলে দেশে ফিরব না।

এখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ভালোই আছেন। করোনা সচেতনতায় অনেকেই কাজ করছেন। কোম শহরে করোনাভাইরাস নির্মূলে বাংলাদেশের পতাকা হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করেছে একদল প্রবাসী বাংলাদেশি।

গত মাসেও বিশ্বে করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে সমস্যায় ছিল ইরান ও ইতালি। চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ালেও সেখানে নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল। সে সময় ইরানে প্রতি ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে নতুন আক্রান্ত হচ্ছিল ৪০ জন এবং মারা যাচ্ছিল ৬ জন। কিন্তু গত এক সপ্তাহে ইরানের অবস্থা পাল্টে গিয়েছে। অব্যাহতভাবে কমে আসছে করোনায়ভাইরাসে নতুন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ইরানে করোনাভাইরাসে ৮০ হাজার ৮৬৮ জন আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ৩১ জন মারা গিয়েছে এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৫৫ হাজার ৯৮৭ জন।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-মোস্তফা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, মাশহাদ, ইরান। [email protected]