নদীর নাম মায়াবতী

অস্ট্রেলিয়ায় নদীর ধারে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ায় নদীর ধারে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

মাঝেমধ্যেই আমি উদ্ভট স্বপ্ন দেখি। তবে আজকের স্বপ্নটা একটু ব্যতিক্রম। আমি ব্রিসবেন রিভারসাইডে বসে আছি। আমার পাশে কবি মাইকেল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ক্লাস টেনে যার কবিতা পড়ে বাংলাতে পাস করেছি। মাইকেল আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, বৎস, আমি যখন ফ্রান্সে ছিলাম, একসময় চরম হোমসিকনেসে ভোগা শুরু করি। তখন একসময় ভার্সাই শহরে বসে একটা কবিতা লিখেছিলাম—‘কপোতাক্ষ নদ’। পরে সেটা প্রকাশিত হয় ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ কাব্যগ্রন্থে। আমি বিড়বিড় করে পড়লাম, ‘সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে; সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে…’।

মাইকেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, অনেক দিন হলো তুমি এখন প্রবাসে। মাঝেমধ্যেই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়। তার ওপর এখন কোয়ারেন্টিন চলছে। এটা কবিতা লিখার পারফেক্ট টাইমিং। তোমাকে আমি সাজেস্ট করব একটা সনেট কবিতা লিখতে। কবিতার নাম হবে ‘ঘাঘট নদী’। কবিতা লিখলে বিষাদগ্রস্ততা একটুখানি হলেও প্রশমিত হবে।

আমি বললাম, ওরে বাবা। সনেট লেখা কি ছেলেখেলা কথা! চৌদ্দটা লাইন থাকতে হবে কবিতায়, আবার প্রতিটি লাইনে মোট চৌদ্দটা করে অক্ষর। সারা দিন প্রচুর ঝামেলায় থাকি জনাব—রিসার্চ, স্টাডি, রান্নাবান্না, আর এখন আপনি বলছেন সনেট লিখতে। মাইকেল এবার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন, আচ্ছা, তুমি বুকে হাত দিয়ে বল তো, এই নদীটাকে তুমি মিস করো না। আমি সাফ জবাব দিয়ে বললাম, না। আর আমি আপনার সঙ্গে একমত না। বিশেষ করে ওই দুই লাইন, ‘বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে’। আমার কাছে পৃথিবীর সব নদীই একরকম। হয়তো একেক নদীর উৎপত্তি একেক জায়গায়, কিন্তু দিনশেষে সবার গন্তব্য একটাই। সমুদ্র। সবাই এক জায়গায় মিশে যায়। মাইকেল আরেকবার হাসি দিয়ে বললেন, বাছা, তুমি আমার কবিতাটা পড়ে বাংলায় এ প্লাস পেয়েছ ঠিকই, কিন্তু অনুধাবন করতে পারনি।

অস্ট্রেলিয়ায় বিল্ডিং আর ব্রিজের চোখধাঁধানো আলোর প্রতিফলন নদীর পানির ওপরে এক অপরূপ আলোকচ্ছটা তৈরি করে। ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ায় বিল্ডিং আর ব্রিজের চোখধাঁধানো আলোর প্রতিফলন নদীর পানির ওপরে এক অপরূপ আলোকচ্ছটা তৈরি করে। ছবি: সংগৃহীত

তারপর স্বপ্নটা ভেঙে যায় আমার। ঘুম থেকে উঠে আজ চরম বিষণ্ন হয়ে যাই আমি। পৃথিবীজুড়ে দুঃসময় চলছে। ইউরোপ আমারিকার রাস্তায় রাস্তায় লাশের মিছিল। এদিকে বাংলাদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তা। সারা অস্ট্রেলিয়া লকডাউন। লাস্ট কবে ব্রিসবেন রিভারসাইডে গিয়েছি মনে নেই। মন খারাপ থাকলে প্রায়ই ওখানে যেতাম আমি। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়। বসে পড়তাম ফেভারেট স্পটে। এখন ওখানটায়ও যেতে মানা। বিনা কারণে বাসার বাইরে বের হলে ১ হাজার ৩০০ ডলার জরিমানা গুনতে হবে।

বিদেশের নদী আসলেই একটু অন্য রকম। ব্রিসবেন রিভারের ওপর দিয়ে চলে গেছে গুডউইল ব্রিজ। আর রিভারসাইডে গড়ে উঠেছে অসংখ্য হাইরাইজ বিল্ডিং। বিল্ডিং আর ব্রিজের চোখধাঁধানো আলোর প্রতিফলন নদীর পানির ওপরে এক অপরূপ আলোকচ্ছটা তৈরি করে। আমি অনেকটা সম্মোহিত হয়ে যাই। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। হোমসিকনেস আর বিষাদগ্রস্তটা নিমেষেই চলে যায়।

কিন্তু তারপরও ঘাঘট নদী কেন? এতদিনে নদী তো আর কম দেখিনি। ছোটবেলায় থাকতাম পঞ্চগড়ে। সেখানে মাঝেমধ্যেই প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে বন্ধুরা মিলে চলে যেতাম করতোয়া নদীতে। কতবার যে সাঁতার শিখতে গিয়ে নদীর পানি খেয়েছি, তার হিসেব নেই। তারপর গেলাম খুলনায় পড়াশোনা করতে। আমাদের কুয়েটের পাশেই ছিল ভৈরব নদী। বোরিং ক্লাস, পরীক্ষা শেষে নদীর পাশে গিয়ে বসলেই চলে যেত সব অবসাদ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য থাকতে হলো নাটোরের কাদিরাবাদে। আর্মি ইউনিভার্সিটিতে। ওখান থেকেই একটু দূরে বড়াল নদী। বোরিং ফিল হলেই উইকেন্ডে চলে যেতাম ছাত্রদের সঙ্গে।

মাঝেমধ্যে আমার কুয়েটের জুনিয়র তাপস ফোন দিয়ে বলত, ভাই আজকে আকাশ অনেক পরিষ্কার। চলেন ব্রিজে দাঁড়িয়ে তারা দেখব। আমি বাইক নিয়ে আসছি। ও বড়াল ব্রিজের ওপর বাইক রেখে অনেকটা কবির মতো ভাব নিয়ে বলত, ভাই, আজ অনেক দিন পর আকাশের তারা দেখছি। আরেকবার সুযোগ পেলে আমি ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে অ্যাস্ট্রোনোমি পড়তাম। মাঝেমধ্যে ও নদীর পানিতেও আকাশের তারার আলোর প্রতিফলন খুঁজত।

রাতের ব্রিজবেন নদী। ছবি: লেখক
রাতের ব্রিজবেন নদী। ছবি: লেখক

এরপরও এত নদী থাকতে ঘাঘট কেন? যত দূর মনে পড়ে, ঘাঘটে লাস্ট গিয়েছি আজ প্রায় চার বছর হলো। তাও গিয়েছি মাত্র একবার। রংপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা একটা নদী। নদীর ওপারে কাশবন আর ঝাউবন। নৌকা দিয়ে পার হয়ে যেতে হয় এপার থেকে ওপারে। ওই দিন নদীর পাড়ে বসে ছিলাম অনেকক্ষণ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নদীর পানির শব্দ আছড়ে পরছে ঘাটে, আর এক অপরূপ ছন্দ তৈরি করছে। কে জানত, সেই সময় এক অজানা মায়াজালে বেঁধে ফেলবে এই নদী। এরপর যত নদীতেই গিয়েছি, কোনোটাই ঘাঘটের মতো মনে হয়নি। হয়তোবা হবেও না।

অস্ট্রেলিয়া আসার পর প্রায়ই রাতে ঘুম আসতে চায় না। তখন চোখ বন্ধ করে একটা নদীর কথা ভাবি। ছোট্ট আঁকাবাঁকা একটা নদী। নদীর ওপারে কাশবন। আমি এপারে বসে একা। কি মায়াবতী নদী! দূর থেকে নদীর পানির কলকল শব্দ। সেই শব্দ আমাকে সম্মোহিত করে দেয়। ঘুম এসে যায়।

হয়তো আমার কল্পনার ওই মায়াবতী নদীটাই ‘ঘাঘট’। বাংলাদেশ ছেড়েছি প্রায় দেড় বছর হলো। ঘাঘট নদী রংপুর শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমি রংপুরের ছেলে। বাসায় থাকতে এই নদীর প্রতি এতটা টান অনুভব করিনি কখনো। হয়তো বন্ধুরা যাওয়ার কথা বললে ব্যস্ততার ছলে কাটিয়ে দিয়েছি। আজ কেন জানি খুব ইচ্ছে হচ্ছে ঘাঘটের পাড়ে গিয়ে বসি। হয়তো কোনো কবিতা রচনা করা হবে না। তারপরও।

মাইকেলের সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হবে কি না জানি না। দেখা হলে ওনাকে একটা কথা বলব। স্যার, আপনার কথাটা আমি রাখতে পারিনি। আমি আপনার মতো প্রতিভাবান নই, তাই হয়তো সনেট লেখা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তবে আমি একটা গল্প লিখেছি। নাম শুনবেন স্যার? নদীর নাম মায়াবতী।

*লেখক: পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কলার, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, অস্ট্রেলিয়া