জানালায় বাবার মুখোচ্ছবি

দাঁড়িয়ে আছেন বয়স্ক লোকটি। ছবি: সংগৃহীত
দাঁড়িয়ে আছেন বয়স্ক লোকটি। ছবি: সংগৃহীত

বাইরে এখনো হিমহিম ঠান্ডা। ঝিরঝির করে বরফ পড়ছে। জানালার স্বচ্ছ কাচ পেরিয়ে বাসার সামনের নিষ্প্রাণ হাইওয়ে অতিক্রম করে অদূরে গ্রোসারি স্টোরের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় নীলার চোখ দুটো। প্রায় উবু হয়ে গ্রোসারির কার্টের সাথে মিশে যাওয়া কালো জ্যাকেট পরা একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ, জীবন এবং পেটের তাগিদ যাকে কোনোভাবেই এই করোনা বিষণ্ন দিনে গৃহবন্দী করে রাখতে পারেনি। কতই বা হবে ভদ্রলোকের বয়স, ৭৫ বা ৮০। হয়তো ছেলেমেয়ে সব থাকার পরেও একাকী পার করছেন জীবনসায়াহ্নের এই সময়টুকু। জীবনের প্রয়োজনের কাছে সবকিছুই নস্যি।

নীলা এক নিমেষেই ফিরে যায় মাত্র কদিন আগের ফেলে আসা অদূর অতীতে। এই তো গত বছরের মাঝামাঝি বাবা মারা গেলেন। মাত্র কদিনের নোটিশে জলজ্যান্ত একজন মানুষ কীভাবে চিরবিদায় নিলেন। ভাগ্যিস শেষ দেখা হয়েছিল। বাবার মুখটা খুব মনে পড়ে। প্রবাসজীবনের অনেক জটিলতায় দেশে গিয়ে বাবার সাথে ঘন ঘন দেখা করা সম্ভব হয়নি অনেকগুলো বছরে। সেই বেদনা নীলার হৃদয়কে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করে। এই করোনাকালীন গৃহবন্দী জীবনে কেন জানি বাবাকে খুব বেশি মনে পড়ে। বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চিত দিনে দুই থেকে তিনবার ফোন করে খোঁজ নিতেন। মা সোনা, মাগো, আমার লক্ষ্মী মা, কেমন আছ মা? ফোনের ওপাশ থেকে অহর্নিশ আদর আর চুমোর শব্দ আসতেই থাকত যতক্ষণ না কথা শেষ হতো। সেই বাবা আজ শুধুই স্মৃতি। নীলা বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা’। ওপারে ভালো থেকো বাবা।

এই করোনার দিন কবে শেষ হবে কেউ জানে না। প্রতিদিন পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং চিরবিদায় নিচ্ছে মানুষ। সেই মৃত্যুর মিছিলে নীলার বাবার বয়সী মানুষের সংখ্যাই হয়তো বেশি। পরিজনকে হারানোর বেদনায় সমগ্র পৃথিবীর আকাশ অন্য এক নীলে নীল। গুমরে মরছে বেদনার আর্তি। এসব ভাবতে ভাবতেই নীলার দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসে। কেন যেন এই জীবনের সবকিছুকে বড় বেশি মূল্যহীন মনে হয়। মনে হয়, এই যদি হবে জীবন, তবে কিসের এত আয়োজন, কিসের এত ঘনঘটা। হঠাৎ ছেলের ‘মা’ ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় নীলা। পেছন থেকে ছেলে নীলাকে জড়িয়ে ধরে। নীলাও পরম আদরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে।

নাহ, এখন মনে হচ্ছে, জীবনের মানে তো আছেই। কোনো জীবনই মূল্যহীন নয়। প্রত্যেকটা জীবনেরই অনেক বড় একটা উদ্দেশ্য থাকে। সুদূর নর্থ পোলে যেখানে কখনোই কোনো মানুষের পদচিহ্ন পড়ার কথা নয়, সেখানে -৫০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডে পাথরের ভেতরে বেড়ে ওঠা একটি এককোষী লাল শৈবালেরও তো জীবন থাকে। বিধাতা পরম যত্নে সেই জীবনকে লালিত করেন। কেন করেন? মিছেমিছি? মোটেও নয়। তাই যদি হয়, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ, তার জীবন মূল্যহীন হবে? কোনোভাবেই নয়। সেই জীবনকে কোনোভাবেই অবহেলা নয়। সেই জীবনের জন্য সবকিছুই করতে হবে। জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য। বেঁচে থাকাটাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় বিস্ময়। চলবে..

*লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী এবং গবেষক