করোনায় সভ্যতার সংকট: দেশ ও বিদেশ

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

সভ্যতা শব্দটির সঙ্গে আমরা মোটামুটি সবাই পরিচিত। অভিধানগতভাবে সভ্যতা শব্দটি কোনো সমাজে মানুষের জীবনযাত্রার বিকাশ, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন ইত্যাদি বিষয় বোঝায়। সাধারণভাবে সভ্যতা দিয়ে একজন মানুষ কতটুকু মানবিক গুণাবলি রাখে, তা বোঝায়। যদি বলা হয় একজন মানুষ অভদ্র, তার মানে মানুষটা একটু দুষ্টপ্রকৃতির এবং মানবিক ও সামাজিক অনুশাসন থেকে বিচ্যুত।

পৃথিবীতে কোন জাতি কত বেশি সভ্য কিংবা অসভ্য, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা আছে। বাংলাদেশের মানুষ কতটুকু সভ্য, তা নিয়েও আছে অনেক আলোচনা এবং সমালোচনা। করোনা ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন না মেনে মানুষের বাইরে বের হওয়া, জানাজায় অংশ নেওয়াসহ আরও বিভিন্ন কারণে এই আলোচনা আরও সামনে চলে আসছে। সবার একটাই প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খায় যে ‘এই জাতি লইয়া আমরা কী করিব?’

সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার আধিকাংশ দেশের মানুষকে অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় বেশি সভ্য মনে করা হয়। কিন্তু করোনা ও লকডাউন ইস্যুতে আসলেই পরিস্থিতি কী এসব দেশে? মানুষই–বা কতটুকু সভ্যতার পরিচয় দিচ্ছে?

মাস্টার্স করার জন্য এখন আমাকে থাকতে হচ্ছে ভ্যাংকুভারে। এখানে বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা থেকে যা দেখলাম, তা জানানোর জন্যই এই লেখা। এখন ভ্যাংকুভারে গ্রীষ্মকাল। সাধারণত শীতপ্রধান দেশের মানুষ এই গ্রীষ্মকালের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে। এ বছর ও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই করোনার জন্য কার্যত লকডাউন থাকলেও হরহামেশাই মানুষ বাইরে যাচ্ছে। লকডাউনের প্রথম কয়েক দিন কদাচিৎ রাস্তায় মানুষ দেখা গেলেও এখন আস্তে আস্তে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি বাড়ছেই। গ্রীষ্মে এখানকার মানুষ বাইকিং করতে এবং জগিং করতে ভালোবাসে। করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও মানুষের বাইরে যাওয়া না কমে বরং বাড়ছে। পার্কে মানুষকে একসঙ্গে সময় কাটাতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি শতকরা ৯০ ভাগ মানুষকে মাস্ক ও পরতে দেখিনি। এখানকার একটা বিচের পাশে একদিন ড্রাইভ করে যাচ্ছিলাম। দেখলাম সমুদ্রসৈকতে শত শত মানুষ। ফেসবুকের মাধ্যমে দেখলাম অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার সমুদ্রসৈকতগুলোতেও দেখলাম একই অবস্থা। তারা করোনার জন্য এই গ্রীষ্মের উদযাপন মিস করতে চায় না। এখানে শুধু সরকারি নির্দেশনা থাকায় খাবারের দোকানগুলোতে ভেতরে খাওয়া বন্ধ এবুং শুধু ‘টেইক আউট’ সার্ভিস চালু আছে। নইলে তাও থাকত কি না কে জানে।

এই তো গেল বাইরে যাওয়ার কথা। এবার আসি একটু বাজার–সদাইয়ের ব্যাপারে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখলাম বাংলাদেশের কিছু মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মজুত করার চেষ্টা করছে। দেখলাম অনেকে গালাগাল করছে এদের। আমার কাছে এই আচরণ একটুও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। কারণ, ঠিক এমনটাই আমি নিজে এখানে দেখেছি। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই এখানে মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি জিনিস কেনা শুরু করে। ফলে সুপারস্টোরগুলোতে শুরু হয় নিত্যব্যবহার্য জিনিসের সংকট। আমি নিজেও গিয়ে কিছুই না কিনে ফেরত আসি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মাস্ক তো হয়ে ওঠে সোনার হরিণ। মানতে কষ্ট হলেও সত্যি যে নিজের জন্য এখন মাস্ক কিনতে পারিনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, মানুষকে ট্রাক ভরে টয়লেট পেপার কিনেছে। আমি জানি না করোনার পূর্ব সতর্কতার সঙ্গে টয়লেট পেপার কেনার কী সম্পর্ক। শুধু ভালো সাপ্লাই চেইন থাকার কারণে মারাত্মক সংকট হয়নি, এ কথা আমি লিখে দিতে পারি।

কানাডার প্রধানমন্ত্রীর জয়জয়কার দেখলাম সব জায়গায়। হওয়াটাও স্বাভাবিক। যারা কাজ হারিয়েছে, তাদের জন্য আছে ‘Employment Insurance’। যারা নিজে থেকে কাজে যাওয়া থেকে বিরত আছে, তাদের জন্য আছে ‘Canada Emergency Response Benifit’। এ ছাড়া সব ধরনের বিলের পেমেন্ট ও ট্যাক্স রিটার্ন পেছানো হয়েছে। এত কিছু দেওয়ার পরও যদি মানুষকে ঘরে রাখা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের দোষটা কোথায়? আমার দেশের মানুষ তো নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকারি সাহায্যের কোনো ঠিকঠিকানা নাই। বরাদ্দের চাল তো সব চোরদের পেটেই যাওয়ার খবরও মিলছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং কিছু সামাজিক সংগঠন চেষ্টা করছে কিছু করার। তাদেরও আছে সীমাবদ্ধতা। উন্নত দেশের সব সুযোগ–সুবিধা পেয়েও মানুষ যদি ঘরে থাকতে না পারে, তাহলে আমার দেশের খেটে খাওয়া মানুষ যদি পেটের দায়ে ঘর থেকে বের হয় ও তাহলে তাদের গালাগাল দেওয়ার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। তাই বলে হাজারো মানুষের জানাজা সমীচীন, আমি তা বলছি না। কিছু মানুষ সব সময়ই নির্বোধ। তাদের জন্য শাস্তি ছাড়া আর কিছুই কাজ করবে না। ফেসবুকে দেখলাম একজন রিকশাওয়ালা ভাই বলছেন যে পেটের দায় না থাকলে কোনো দিনই সরকারি নির্দেশ অমান্য করে বাইরে বের হতেন না। পরিবারের অভিভাবক হিসেবে তাঁরও তো পরিবারকে বাঁচাতে হবে। পেটের দায় না থাকলে তো গার্মেন্টসে কাজ করা ভাইবোনেরা সেদিন পায়ে হেঁটে ঢাকা আসতে চাইতেন না। কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের জন্য লকডাউন নিশ্চিত করতে হলে আগে নিশ্চিত করতে হবে পেটের লকডাউন যাতে না হয়। তা না হলে আপনার–আমার মতো যারা বাসায় আছি, তাদের গালাগালি তে মানুষের বাইরে বের হওয়া বন্ধ হবে না।

ভালো থাকো তুমি প্রিয় মাতৃভূমি! তোমার সন্তানেরা যেন থাকে দুধে ভাতে!

*লেখেক: শিক্ষার্থী (মাস্টার্স), নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি