মেহফিল, অনলাইনে গুরু-শিষ্য পরম্পরা

লেখক। ছবি: সংগৃহীত
লেখক। ছবি: সংগৃহীত

শাস্ত্রীয় সংগীতের বিশ্বখ্যাত শিল্পী, গুরু পণ্ডিত এ কাননের জন্মশতবার্ষিকী, গুরু–শিষ্য পরম্পরা আর কলাকারের নতুন প্রয়াস—মেহফিল।

কী চরম দুঃসময়। আমাদের খুব কাছের এক দেশে কিছুদিন আগেও রাস্তায় পড়ে ছিল সারি সারি মৃতদেহ, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই সৎকারের ব্যবস্থা করার জন্য! কে কাকে দেখবে! কে কার জন্য চোখের জল ফেলবে! চারদিকে মৃত্যুপুরীর হাহাকার! এ যেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র সেই গল্প! এক রাক্ষসী এসে সারা দেশের সবাইকে মেরে ফেলেছে, রাজা, রানি, সেপাই–সামন্ত, হাতি–ঘোড়া কাউকেই রেহাই দেয়নি! এদিকে রাজপুত্র যুদ্ধে গিয়ে অনেক দেশ জয় করে ফিরে এসে দেখল নিজের দেশ খাঁ খাঁ করছে! তারপর তো সেই কত কাণ্ড করে রাক্ষসীকে খুঁজে বের করে তাকে মেরে ফেলে জিয়নকাঠি দিয়ে মরে যাওয়া সবাইকে বাঁচিয়ে তোলা গেল!

দিন যায়, কাল যায়। সেই রাজাও নেই, সেই রাজ্যপাটও নেই। মানুষ বদলে গেছে, মাথায় হীরার মুকুটের বদলে রেব্যান সানগ্লাস আর রিবকের টি–শার্ট পরে ঘোরাঘুরি করছে। ঘোড়ায় টানা রথের বদলে এখন হাতে মার্সিডিসের চাবি। ২০২০–তে বসে, অত্যাধুনিক সব টেকনোলজি নিয়ে দিনরাত কাজ করে মহাকাশে গিয়ে বাড়িঘর বানিয়ে ফেলতে পেরেছে, খোদার ওপর খোদকারি করে আরও কত কিছুই না করছে! আনন্দ আর কাকে বলে! ঠিকঠাকই চলছিল সব, হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দেখা গেল সেই কত যুগ আগের রাক্ষসী আবার ফিরে এসেছে! বলা নেই কওয়া নেই যাকে ইচ্ছে তাকেই মেরে ফেলছে! এখন আবার তার একটা আধুনিক নাম হয়েছে করোনা! কী কাণ্ড রে বাবা! চেষ্টাচরিত্র করে শেষমেশ একজন রাজপুত্রকে হয়তো পাওয়া যাবে, যে কিনা এই রাক্ষসীকে মারার ওষুধ বের করেই ফেলবে, কিন্তু ওই জিয়নকাঠি? তা কি আর কোনো যুগেই পাওয়া যাবে, যা দিয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে বাঁচিয়ে তোলা যাবে!

এই রকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে, আমার মতো যাদের কাছে সংগীত ছাড়া আর কিছু নেই, তারা সবাই যে যতভাবে পারছেন চেষ্টা করছেন গান গেয়ে, নিজের যন্ত্র বাজিয়ে অন্যদের কিছুক্ষণের জন্য হলেও একটু শান্তি দিতে। এ বছর আমার গুরুজি পণ্ডিত এ কাননের জন্মশতবর্ষ। কত প্ল্যান ছিল, কিন্তু করোনা রাক্ষসীর ভয়ে আমরা সবাই ঘরবন্দী, বাইরে গিয়ে ঘটা করে কোনো অনুষ্ঠানই করা গেল না। গুরুজির কাছেই শিখেছি, হার মানা যাবে না। গুরুজি নিজেও তো ক্যানসারের কাছে হার না মেনে অপারেশন করে ফিরে এসে ঘরে ঢুকে সবার আগে ইলেকট্রনিক তানপুরাটা অন করেছিলেন।

সেই গুরুর ছাত্র হয়ে আমি কি হার মানতে পারি? সাহস দেওয়ার জন্য কয়েকজন বন্ধুও যে পাশে আছেন। তাদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের শিক্ষিকা, সোয়াস সাউথ এশিয়ান আর্টসের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ডক্টর সংযুক্তা ঘোষ, গুরুজির আর এক ছাত্র ডক্টর সিদ্ধার্থ করগুপ্ত আর সুহৃদ ডক্টর ইমতিয়াজ আহমেদ আমার চেয়ে বেশি সাহসী!

ইমতিয়াজ দা ডাক্তার, নিজের পেশার কারণে প্রতিদিনই করোনা রাক্ষসীর সঙ্গে সমানতালে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। আর সংযুক্তা শিক্ষিকা! ছাত্রদের মনে সাহস জুগিয়ে তাদের এগিয়ে চলার পথ দেখানোই তো ওর কাজ! তাই আমার এই ‘পারব কি পারব না’ মনো ভাব এক কথায় উড়িয়ে দিলেন এরা। এদের সঙ্গে যোগ দিলেন আমার ছাত্রী শতরূপা ঘোষ, কলকাতা থেকে বহু দিনের পুরোনো বন্ধু চয়নিকা চক্রবর্তী আর অনুজপ্রতিম ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়। মহা উদ্যোগে শুরু হলো কলাকারের ফেসবুক পেজ থেকে গুরুজির স্মৃতিতে অনুষ্ঠান। নাম রাখা হলো মেহফিল, গুরু–শিষ্য পরম্পরা।

অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য শুধু গানবাজনা করাই নয়, এখনকার নামী শিল্পীরা কীভাবে তাঁদের গুরুর কাছে শিখেছেন, তাঁদের সাফল্যের পেছনে যে গুরুর অবদান, সেই গুরুকে নিয়ে, গুরু গৃহে শিক্ষা নিয়ে কত ধরনের গল্প, প্রতিদিনের শেখার খুঁটিনাটি—সেসব আলাপচারিতা। শিল্পীরা সাধারণত জীবনের এই ঘটনাগুলো বলার সুযোগ তেমন পান না!

গুরু–শিষ্য পরম্পরা বিষয়টি কী

গুরু–শিষ্য পরম্পরার অনুষ্ঠানের অনলাইন প্রচার। ছবি: সংগৃহীত
গুরু–শিষ্য পরম্পরার অনুষ্ঠানের অনলাইন প্রচার। ছবি: সংগৃহীত

প্রথাটা একটু সেকেলে! গান, নাচ বা যন্ত্রসংগীত শিখতে এক ছাত্র একজন খুব গুণী মানুষের কাছে গিয়ে তার শিষ্য হওয়ার জন্য আরজি জানালো। গুণী মানুষটি প্রথমেই তো আর যাকে তাকে শিষ্য করবেন না, তাই নানা রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাতে লাগলেন দিনের পর দিন। সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই ছাত্র চলে আসে গুরুর বাড়ি, সারা দিন ওখানেই থাকে, নানা রকম ফাই–ফরমাশ খাটে, দোকান, বাজার করে, ঘর ঝাড়ু দেয়, গুরুর পা টিপে দেয়, কেউ কিছু খেতে দিলে খায়, না হলে অনেক সময় সারা দিন কিছু না খেয়েও থাকতে হতে পারে। গুরু মানুষটি কতটা সদয় বা নির্দয়—এই সব খাটাখাটুনি তার ওপরেও নির্ভর করে। মাস চলে যায়, ছাত্র রেওয়াজ করে, গুরু শুনেও না শোনার ভান করেন। ছাত্র অনেক সময় গুরুর বাড়িতেই দিনের পর দিন থাকে, গুরুর তানপুরা বয়ে নিয়ে যায়, গুরুতর শরীর খারাপ হলে সারা রাত জেগে পাশে বসে সেবা করে। অনেক দিন অনেক মাস পরে একদিন গুরুর মনে সামান্য দয়া হয়, গুরু ছাত্রকে ডেকে বলেন, ‘লাগাও দেখি একটু সা’! ওই সা লাগানো যদি গুরুর পছন্দ হয়, তখন তিনি হয়তো দুই লাইনের একটা বান্দিশ ছাত্রকে শিখিয়ে দেবেন।

বান্দিশ কী?

সহজ করে বলতে গেলে শাস্ত্রীয় সংগীতের এক ভাগ হলো খেয়াল। বিভিন্ন রাগের ওপর ভিত্তি করে একেকটা খেয়াল, যার শুরুতে ৪ লাইনের একটা গান, ওই গানকে বলে বান্দিশ। তা গুরু তো ওই একটা বান্দিশ শিখিয়েই আবার মাসের পর মাস চুপ। ছাত্র তখন কী করবে? গুরুর বাড়িতে থাকা অনেক পুরোনো কোনো ছাত্রর (যাকে গুরু বেশ পছন্দ করেন) কাছ থেকে ওই বান্দিশটা যে রাগের ওপর তৈরি, ওই রাগটা শুনে শুনে একটু শেখার চেষ্টা করবে, নিজের মতো করে গাইবে। চেষ্টা করবে অবিকল গুরুর মতো করে তাকিয়ে, হাত নাড়িয়ে, মুখ বেঁকিয়ে গান করার। পুরোনো ছাত্রকে তো বলা যাবে না, ভাইরে, আমাকে রাগটা একটু শিখিয়ে দাও। কারণ ওই কথা গুরুর কানে গেলে উনি আবার এমন রাগ করবেন যে নতুন–পুরোনো দুই ছাত্রকেই হয়তো পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন, ‘সাহস তো কম নয়, আমার বাড়িতে বসে আমার সামনেই গুরুগিরি হচ্ছে, জীবনে যেন এই বাঁদরের মতো মুখ আমার চোখের সামনে না দেখি’ ইত্যাদি মিষ্টিমধুর কথাবার্তা বলে! তাই অন্য ছাত্রের গান শুনে শুনেই যতটা শেখা যায়।

গুরু আড়াল থেকে সবকিছুই দেখেন, কিন্তু এমনভাব করেন যেন কিছুই জানেন না। এভাবে বছরের পর বছর চলে যেতে পারে, অনেক শিষ্য এত ধৈর্য ধরতে না পেরে এক সময় ‘আর পারা যাচ্ছে না বাপু, গুরুগিরির একটা সীমা আছে’ বলে গুরুকে আর পাত্তা না দিয়ে নিজের রাস্তা দেখেন।

কিন্তু অনেক শিষ্য আছেন, যারা বছরের পর বছর ওইভাবে গুরুর বাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থেকে গুরুর রেওয়াজ শুনে শুনে নিজে শেখে, দিনের বেলা গুরু নিজে রেওয়াজ করবেন, শেখাবেন, তাই শিষ্য সারা রাত জেগে নিজের রেওয়াজ চালিয়ে যান। শিষ্যের এই ভক্তি, আগ্রহ আর ধৈর্য দেখে গুরু একসময় শিষ্যকে কাছে ডাকেন। এই ‘কাছে ডাকা’ মানে আজীবন নিজের ছেলেমেয়ের মতো করে কাছে রাখা। সন্তান জন্মের পর যেমন নানা রকম পুজো করা হয়, তেমনি কোনো শিষ্যকে শিষ্য বলে মেনে নেওয়ার কিছু রীতি আছে। রীতিমতো পঞ্জিকা দেখে দিন ঠিক করে গুরুর বাড়িতে অনুষ্ঠান হয়। শিষ্যকে সামনে নিয়ে বসে গুরু পুজো করেন, তার পর একটা লাল রঙের মোটা সুতো নিজের গুরু আর ঈশ্বরের নাম করে শিষ্যের হাতে বেঁধে দিয়ে তাকে সবার সামনে নিজের শিষ্য বলে পরিচয় দেন। এই পুজোর নাম নাড়া বাধা বা ‘গান্ডা বন্ধ’।

গুরুর মৃত্যুর পর গুরুর ছেলের মতো এই নাড়া বাঁধা শিষ্যরাও গুরুর মুখাগ্নি করবেন। কোনো বিখ্যাত গুরুর কাছে গান্ডা বন্ধ শিষ্য হওয়া মানে সে এক বিরাট ব্যাপার। সম্মান যতটা, খাটুনি তার চেয়েও বেশি অবশ্য! আগে যদি সাত ঘণ্টা রেওয়াজ করতে হতো, তাহলে এখন সেটা বেড়ে ডাবল হয়ে যাওয়ার খুব চান্স আছে! তার ওপর অন্যান্য খাটাখাটুনি তো থাকবেই, আরও বেড়েও যেতে পারে। কিন্তু এত সবের বদলে শিষ্য কী পাবে? গুরু আজীবন যা শিখেছেন, তার সবকিছু তিনি শিষ্যকে উজাড় করে দিয়ে যাবেন। নিজে না খেয়ে শিষ্যকে খাওয়াবেন, রাত–দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে শিষ্যকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলবেন। সেই শিক্ষার যথাযথ মর্যাদা দিলে এই শিষ্যও একদিন খুব নামী শিল্পী হবে, আর একজন গুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। থেকে যাবে বিশেষ ওই ঘরানার গানবাজনাও।

যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলতে পারত গুরু–শিষ্যের এই পরম্পরা। আমরা আরও কয়েকজন রবিশঙ্কর, বিলায়েত খান বা আলী আকবরকেও পেয়ে যেতাম। কিন্তু যুগ বদলে গেছে, এখন একজন পুরোনো দিনের গুরুর (যে কজন বেঁচেবর্তে আছেন) সেই ইচ্ছে বা ধৈর্য থাকলেও শিষ্যের বড্ড আকাল! এখন এই ফেসবুক, ইউটিউবের যুগে গুরুর বাড়িতে হাপিত্যেশ করে গানবাজনা শেখার জন্য বসে না থেকে কম্পিউটারের সামনে বসে কয়েক খানা গান একটু তুলে নিলেই কেল্লা ফতে! কোনো না কোনো টিভি চ্যানেল সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে দু–একটা প্রোগ্রামও দিব্বি করিয়ে দেয়। সেই সুযোগে এদিক–ওদিক মাচায় উঠে একটু গেয়ে নেওয়াও যেতে পারে!

অনেকে আবার কয়েক মাস একজন নামী গুরুর কাছে গিয়ে ‘আপনাকে পেয়েছি আর আমি জীবনে কিচ্ছুটি চাই না’ বলে গুরুকে বেশ মাখনটাখন লাগিয়ে দু–একটা রাগারাগি শিখে নিয়েই নিজেও বেশ একজন গুরু হয়ে যাচ্ছেন। এখনকার পুরোনো গুরুদের তো আগের যুগের মতো সেই মেজাজ আর নেই, তাই তারাও সব জেনেবুঝেই গান সেখান, শেখাতে বাধ্য হন! না হলে তাদেরই বা চলবে কি করে! তবে সুখের কথা যে এর মধ্যেও কিছু শিষ্য আছেন, যারা নিষ্ঠা নিয়ে শিখছেন, রেওয়াজ করে যাচ্ছেন আর গুরুর প্রতি সত্যিকারের ভক্তিও আছে। না হলে তো আমাদের এসব রাগ–রাগিণী এত দিনে কোথায় হাওয়া হয়ে যেত!

ওস্তাদ রশীদ খানসহ অনেকেই অনলাইনে গুরু–শিষ্য পরম্পরার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
ওস্তাদ রশীদ খানসহ অনেকেই অনলাইনে গুরু–শিষ্য পরম্পরার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। ছবি: সংগৃহীত

আমার গুরুজি আর গুরুমা পণ্ডিত এ কানন আর শ্রীমতী মালবিকা কাননের কাছে আমার শিক্ষাও রীতিমতো পরম্পরার মেনেই! যদিও গুরুজি, গুরুমা কেউই বছরের পর বছর আমার নিষ্ঠা আর ধৈর্যের পরীক্ষা নেননি! মাত্র ১২ বছর বয়সে সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে পরীক্ষা দিয়ে আমি গুরুজির কাছে শেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। আর প্রথম দিন থেকেই নিঃসন্তান দম্পতি এক অদ্ভুত মায়া আর ভালোবাসা দিয়ে আমাকে ‘আমাদের চন্দ্রা মা’ বলে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। অল্প শিখেই গুরু হয়ে যাওয়ার বাসনা যেমন আমার কোনো দিন ছিল না, তেমনি দিনের পর দিন শিষ্যকে দিয়ে ঘর ঝাঁট দিয়ে বা বাসন মাজিয়ে তার পরীক্ষা নেওয়ার মানসিকতাও আমার গুরুর ছিল না। গুরুমা শেখানোর ব্যাপারে একটু কড়া হলেও আমার গুরুজি আবার ছিলেন এক কাটি বাড়া! যে আসত, তাকেই তিনি পরম মমতায় গান শেখাতেন, আবার চলে যাওয়ার সময় তার হাতে দুটো পয়সাও গুঁজে দিতেন, যাতে সে ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছাতে পারে! গুরুগৃহে থাকাকালীন এসব দেখে আমিই উল্টে রাগ করতাম! কিন্তু কানন সাহেবকে যারাই চেনেন, তারাই ওনার কথা বলতে গিয়ে সবার আগে একটা কথা বলেন, ‘কানন সাহেব, উনি তো ঈশ্বর’!

এই ঈশ্বরতুল্য গুরুর জন্মশতবার্ষিকী পালন হচ্ছে জেনে অনেক মানুষ নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছেন তাঁদের দেখা কানন সাহেবকে নিয়ে কথা বলতে। পৃথীবি বিখ্যাত উস্তাদ রাশিদ খান, আমার রাশিদ ভাইকে যখন বলা হলো এই অনুষ্ঠানের কথা, এক কথায় রাজি তো হলেনই, অনুষ্ঠানে এসেও বারবার বলতে লাগলেন, ‘কানন সাহেব আমার নিজের বাবার মতো করে আমাকে আগলে রেখেছিলেন।’ পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জির কথাতেও সেই একই সুর ‘কানন সাহেব তো একজন সাধু ছিলেন’! উস্তাদ সুজাত খান, পণ্ডিত তন্ময় বসু, উস্তাদ মুরাদ আলী খান এমনকি রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী শ্রাবণী সেনেরও সেই একই কথা, কানন সাহেব, ওনার মতো মানুষ হয় নাকি!

গুরুজি থাকলে কি যে খুশি হতেন এত আয়োজন, এত গুণী শিল্পীদের সবাইকে একসঙ্গে দেখে!

হাজারো মানুষ সারা পৃথিবী থেকে অনুষ্ঠান দেখছেন। কলাকারের অনলাইন অনুষ্ঠানে এই নামী শিষ্যরা তাদের গুরুকে নিয়ে কত কথা বলছেন, কত ঘটনা বর্ণনা করছেন। যে ঘটনাগুলো সাধারণত শুনতে পাওয়া যায়নি, জানাও যায়নি। দর্শক–শ্রোতারা চমকিত, শিল্পী নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন বারবার তার নিজের গুরু আর শিক্ষার কথা বলতে গিয়ে।

গুরু আমাদের পথপ্রদর্শক। আজকাল আর সেই গুরুভক্তিই বা কোথায়, দু–এক লাইন শিখে বা একেবারে প্রথাগতভাবে কোনো তালিম না নিয়েও তো কতজন গুরু হয়ে গেছেন! এই আক্ষেপ খুঁজে পাওয়া গেল পৃথিবী বিখ্যাত সংগীতশিল্পীদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। তবুও সবার মনে ক্ষীণ আশা, নিশ্চই গুরু–শিষ্য পরম্পরার এই প্রথা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে না, নিশ্চই কিছু শিক্ষার্থী ভালো করে যত্ন নিয়ে শিখতে চাইবে, গুরুকে সম্মান করে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের ধারাকে অব্যাহত রাখবে। পুরোনো দিনের সব গুরুর গল্প, তাঁদের মান–অভিমান, তাঁদের শিক্ষা দেওয়ার ধরন, নামী শিল্পীদের কত কৃচ্ছ্রসাধন, সাধনা না করে যে কোনো কিছুই শেখা যায় না, সাধনা ছাড়া যে কোনো কাজেই সাফল্য আসে না, এই কথাটুকুও যদি নতুন প্রজন্মের কাছে একটু পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে গুরুজির মতো অন্য অনেক গুরুজিও শান্তি পাবেন। শুদ্ধ সংগীতের ধারা বজায় থেকে যাবে। কে বলতে পারে, ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে কোনো ওষুধপত্র ছাড়া শুধু সংগীত দিয়েই করোনা রাক্ষসীর মতো দুর্ধর্ষ কোনো শত্রুর মোকাবিলা করা যাচ্ছে! স্বপ্ন দেখতে দোষ কি...।

গুরুজিকে শ্রদ্ধা জানানোর এই অনলাইন সংগীত অনুষ্ঠান/আলাপচারিতা সারা বছর ধরেই চলবে। কিছুদিন পরেই আমরা রাক্ষসীকে মেরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব। জিয়নকাঠি তো পাওয়া যাবে না, তাই হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনেরাও আর ফিরে আসবেন না! আমার এই অনুষ্ঠান তাই আমার গুরুজির পাশাপাশি ওই সব চলে যাওয়া মানুষদের প্রতিও বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

সর্ভে ভবন্তু সুখিনাহাঃ, সর্ভে সন্তু নিরাময়াঃ, সর্ভে ভদ্রানী পশ্যন্তু, মা কশ্চিৎ দুঃখভাগভবেত ...ওম শান্তি...