মাওয়ি ট্রিপ-২

দূর পাহাড় থেকে তোলা সমুদ্র ও আকাশ। ছবি: লেখক
দূর পাহাড় থেকে তোলা সমুদ্র ও আকাশ। ছবি: লেখক

পরদিন ভাবলাম, আশপাশে ঘুরব। কায়াকিং করব। মানে, সমুদ্রে নৌকা চালাব।

আমরা কেউ ভালো সাঁতারু নই! কতক্ষণ বিচে ঘোরাঘুরি করে সেই প্ল্যান বাদ দিলাম। পাহাড় দেখতে গেলাম! মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ে সবার সঙ্গে উঠলাম! সেটা করতে করতেই দুপুর কখন গড়িয়ে গেল বুঝতে পারিনি।
আমরা সমুদ্রে কখনো নামি না। এবার ভাবলাম যাই–ই না একবার। ছোট একটা প্রাইভেট বিচে গাড়ি থামিয়ে ভয়ে ভয়ে নামলাম। সবাই কী সুন্দর বোটিং করছে, ফ্লোট করছে। ভাবলাম, কোনো সমস্যা নেই। ওমা, সেই ছোট ছোট ঢেউ আসছে কিন্তু তার উদ্দামতা এত বেশি যে আমাদের ডুবিয়ে দিচ্ছে। মিনিটখানেকের আগে ছাড়াছাড়ি নেই! পায়ের নিচে কিছু পাথরও আছে! কয়েকবার ওই পাথরে বাড়ি খেয়ে আর পানির নিচে দম বন্ধ হয়ে থাকায় আধা ঘণ্টার মাঝে সমুদ্র ছাড়লাম আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই কষ্ট যত দিন মনে থাকবে, আর সমুদ্রে নামব না।


প্রকৃতি বড় অকরুণ। এর বিশাল ফোর্স মাপা সহজ নয়! আমি ভেবে দেখলাম সুনামি কী ভয়াবহ ছিল। পানির তীব্র স্রোত, প্রেশার আর তার সঙ্গে আছড়ে পড়া শক্ত কোনো কিছুর ওপর। একই রকম দমকা হাওয়া, টর্নেডো, হারিকেন, মাড স্লাইড, ভল্কেনো ইরাপশন! আমরা প্রকৃতির কাছে কত তুচ্ছ।


সেখান থেকে ফিরে খেতে গেলাম। বাকি সন্ধ্যা শুধু সমুদ্র দেখা—অবশ্যই কিনারা থেকে।
এ দুদিনে শহরের এমাথা–ওমাথা চষে ফেলেছি।

সৈকতে কচ্ছপ। ছবি: লেখক
সৈকতে কচ্ছপ। ছবি: লেখক

পরদিন ঠিক করলাম আমরা সমুদ্র দর্শনে যাব! বোটে করে। মোটামুটি দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে। হোয়েল মানে তিমি দেখার সিজন মাত্রই শেষ হয়েছে কিন্তু কপালে থাকলে দেখা যেতেও পারে।
বোটে ওঠার আগে ইনস্ট্রাকশন শেষে একদম ডেকে চলে গেলাম—পানি আর পানি! ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে কূলে—দূর থেকে দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল—পাথরগুলোর ওপর ঢেউয়ের তাণ্ডব! নাহ্, পানিতে আর কখনে নামব না! হোয়েলের দেখা পাইনি। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে কয়েক ঘণ্টা বিচরণের যে এক্সাইটমেন্ট, সেটা পেয়েছি।


সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে কূলে ফিরতে ফিরতে। গাড়ি নিয়ে আবারও সেই থাই ফুড ট্রাক আর সমুদ্রপাড়! আমাদের চিন্তায় কিছু নেই প্রকৃতি ছাড়া!


পরের দিন ক্লাস শেষে ভাবলাম, দূরে কোথাও যাই! ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরতে গিয়ে ভাবলাম, রোড টু হানা যাব। সেটার জন্য পুরো দিন লাগবে! আজ সময় পেলে মাউয়িকে দেখব আকাশ থেকে। আমার থেকে ওর বেশি উচ্চতার ভয়। যদিও প্রতি সপ্তাহে প্লেন ট্রাভেলে অভ্যস্ত, তারপরও ভয় তাড়াতে পারছিল না (সত্যি বলতে আমারও ভয় হচ্ছিল—যেভাবে পাখির মতো টুপটাপ করে হেলিকপ্টারগুলো ইদানীং মাটিতে পড়ছে!)। ভয় তাড়াতেই যেন আমরা চড়ে বসলাম হেলিকপ্টারে! নিয়মকানুন, হেনতেন করে আটজন কপ্টারে। দুজন দুজনের হাত টাইট করে ধরে আছি যেন সেটা আমাদের যদি পতন হয় রোধ করতে পারবে!

সৈকতে পর্যটক ও কচ্ছপ। ছবি: লেখক
সৈকতে পর্যটক ও কচ্ছপ। ছবি: লেখক

কপ্টার যখন ওপরে উঠে বা ঝাঁকি খায়—ইয়া নফসি, ইয়া নফসি পড়ি! চোখ বন্ধ করতেও ইচ্ছা হয়! কিন্তু যে সৌন্দর্য চোখের সামনে, তাতে মনে হয়; মরলেও কষ্ট হবে না আর! অথচ তিন মাইল গভীর সমুদ্র নিচে, দশ মাইল দূরে নেক্সট পাহাড়! সাঁতরে কূল পাব না! পাইলট আমাদের বলে যাচ্ছে কোনটা কোন পাহাড়, কোথায় জুরাসিক পার্কের শুটিং হয়েছে ইত্যাদি!


আর ঝরনা? পাহাড়ের তিন মাইল ওপর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে নিচে! নিচে বিশাল ঢেউ! নাহ্! অ্যাক্সিডেন্ট হলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একমাত্র শান্তি—কোনো সাপ নেই।


এর মাঝেও এত পাহাড়ের একটার মাথায় সুন্দর এক ঘর দেখি! যারা এখানে থাকে, তারা যে কদিন থাকে সব রসদ কপ্টারে করেই আনা–নেওয়া করে! আর কেউ নেই তাদের জন্য সেই পাহাড়চূড়ায়!


মানুষের কত রকম শখ হয়! কারও এমন এক্সট্রিম একাকিত্ব ভালোবাসাটা আমাদের মতো সামাজিক বাঙালিদের জন্য হজম করা কষ্টকর! কত যে ঝরনা পাহাড়গুলো থেকে নেমে এসেছে, আমি গোনা বন্ধ করে শুধু দেখাতেই মনোযোগ দিয়েছি! ফেরার পথেও দু–একবার হেঁচকি তুলেছে হেলিকপ্টার—মাটি ছোঁয়ার আগ পর্যন্ত হাত আর ছাড়িনি। আলহামদুলিল্লাহ বলে নেমে আমরা সেদিনের মতো ছুটি ঘোষণা করলাম।

হাওয়াইয়ে মুরগি। ছবি: লেখক
হাওয়াইয়ে মুরগি। ছবি: লেখক

পরদিন রোড টু হানা—আসলে এটা একটা রোড ট্রিপ। প্রকৃতি, পাহাড়, ঝরনা আর হাজার বছর ধরে আনইন্টারাপটেড জঙ্গল, মাঝে মাঝে ট্যুরিস্ট স্পট। অনেক জায়গায় মানুষ এমনিতেই থামে শুধু প্রকৃতি অবলোকন করতে। আমরা পারলে প্রতিটি কর্নারে থামি।


যেতে পাঁচ ঘণ্টা, ফিরতে পাঁচ! যদি না ফিরতে পারি, যেখানে থামব, সেখানেই হোটেল নিয়ে নিব। কিন্তু যদি ফিরতে পারি—সেটাই ভালো হবে।


ঝরনার পর ঝরনা! কোনো কোনোটাতে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আধা মাইল হাঁটতে হয়! কোনোটা রাস্তার ব্রিজের ওপরে! কোনোটা সিনিক ভিউ বলে পাহাড়ে চড়লেই দেখা যায়। এর মাঝেই দুটো বিশাল পাহাড়ে গাড়ি থামিয়ে হাইক করে ফেলেছি! মানিপ্ল্যান্ট, কৃষ্ণচূড়া, রডোডেনড্রন আর কর্দমাক্ত ঢাল—কোনোটাই আমাদের রুখতে পারেনি! এখানে দেখা মিলল বাঁশঝাড় আর বনমোরগের।


পাঁচ ঘণ্টা কখন ছয়ে পড়েছে খেয়াল নেই! দেখি সবাই একটা ন্যাশনাল ফরেস্টের দিকে এগোচ্ছে—আমরা টেন্ট করার মানুষ নই! তারপরও পিছু পিছু ঢুকে গেলাম! সুন্দর ছিমছাম জায়গা! লোকজনেরও কমতি নেই। দেখি একটা বিয়েরও আয়োজন চলছে। এখানে লোকজন আউটডোরে, সুন্দর লোকেশনে বিয়ের আয়োজন করে! আমি ভাবলাম, ভালোই হলো! হাঁটতে হাঁটতে নিচের পাথর আর বিচ দেখে আমার চক্ষুস্থির! কালো বিচ!

আকাশ যেন সমুদ্রে মিলেছে। ছবি: লেখক
আকাশ যেন সমুদ্রে মিলেছে। ছবি: লেখক

আধা ঘণ্টার জায়গায় আমরা সময় ভুলে বিচে। আর তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার ওই বিচের শেষ মাথার চূড়ায় উঠে গেলাম। এখানে ঢেউ এত স্ট্রং, যা পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেয়ে আপনাকে ভিজিয়ে দিতে পারে।
সাহসে কুলালে পাহাড় থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার অদম্য আগ্রহ ছিল কিন্তু সাহসে কুলাল না!


মনোমুগ্ধকর দৃশ্য চারপাশে। তারপরও আবার নিচে নেমে এলাম! এবার দেখি এক পাশে একটা টানেলের মতো। জানি না তার ওই পাশে কী আছে! কিন্তু সাপ যেহেতু নেই, সেই কালো পাহাড়ের গুহায় ঢুকে যাওয়া কে আটকায়! ওমা, ঢুকে দেখি সেখানে আমার মতোই অতি উৎসাহী দু–একজন আছে! আক গুহাটা পানিতে খোলা—আকাশ দেখা যায়! পানির স্রোত আছড়ে পড়ছে আর ভেতরেও পানি চলে আসছে! কতক্ষণ সেখানে কাটিয়ে ফেরার পথ ধরলাম! রোড টু হানা ওইখানেই শেষ আমাদের জন্য!


ফেরার পথেও সেই চিকন সর্পিল পথ, ব্রিজ আর ডজনখানেক বিভিন্ন সাইজের ঝরনা! আমার পছন্দ হয়ে গেল রাস্তার পাশে জন্মানো কচুগাছ! কিন্তু হাওয়াই থেকে মেইনল্যান্ডে কিছু আনা যাবে না! সময়মতো ফিরে এলাম গন্তব্যে।

সমুদ্র্রের পাশে স্বামীর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
সমুদ্র্রের পাশে স্বামীর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

এর পরদিন আবারও পাহাড় ডাকছে আমায়! সঙ্গে রাস্তার পাশের আম ভরা গাছ! কেউ খায় না! যেদিকে তাকাবেন অসহ্য সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ! রাস্তার পাশে সূর্যমুখী খেতে নেমে গেলাম পাহাড়ের পথে! পাহাড় হাইক করে এবার অন্য পথ! বৌদ্ধমন্দির, ট্যুরিস্টদের জন্য দোকানপাট—মানে হাঁটব! যেখানে পার্ক করলাম, সেখানে দেখি গাছে গাছে তেঁতুল ঝুলছে। কোনোটাই হাতের কাছে না। কৃষ্ণচূড়া ফুল আর দুশো বছরের বিশাল বটবৃক্ষ। পাশেই বিচ! সারাটা দিন আমরা সেখানেই কাটালাম!


পরদিন গেলাম প্ল্যান্টেশন দেখতে—মানে খেত। হাওয়াইতে আনারস হয় অনেক! নারকেল তো এন্ডলেস! মাঠের পর মাঠ সবজি আর ফলবাগান! ট্যুরের ব্যবস্থা আছে! এরাই নিয়ে যায় গাড়িতে করে! বের হয়ে দোকান থেকে ফ্রেশ ফ্রুট সালাদ খেতে মন্দ নয়! যে বাটিতে করে সার্ভ করে, সেটাও পাতার বাটি—পরিবেশবান্ধব এরা।


কোনো বিচে এতটুকু ময়লা দেখিনি! কাঁকরার গর্ত দেখেছি বরং, আর সেগুলো নিয়ে খেলতেও আনন্দ!

সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। ছবি: সংগৃহীত
সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সৈকতে। ছবি: সংগৃহীত

পরদিন শেষ দিন—আমাদের সেই ভল্কেনোতে হাইকে যাবার কথা! এত দিন ঘর–সংসার ভুলে ছিলাম! বাসা থেকে ফোন পেতেই দেখি আমার বর উত্তেজিত! ফোন আমাকে দিয়ে বলে, একটু কথা বলো!
আমার ছোট ভাই আমরা হাওয়াই যাবার দুদিন পরে বাবা-মাকে দেখতে এসেছে! বলছে, আমার ছেলে বাইকিং অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। একটু ব্যথা পেয়েছে!


আমার ছেলে ভীষণ চঞ্চল। অ্যাক্সিডেন্ট ওর প্রতিদিনের সমস্যা। কিন্তু কান্নাকাটির ধাত এক্কেবারে নেই! আমি সেই ছেলের ভয় আর ব্যথা মিশ্রিত চিৎকার শুনতে পাচ্ছি ব্যাকগ্রাউন্ডে! ছেলেকে শান্ত করতে ফোনটা হাতে নিলাম আর ভাইকে বললাম ইনজুরির ছবি পাঠাতে! কী কী করতে হবে তার ইনস্ট্রাকশন দিয়ে ছেলেকে সেই হাজার মাইল দূর থেকে শান্ত করার চেষ্টা।

রিসোর্টে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
রিসোর্টে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে উইকএন্ডে সব ক্লিনিক বন্ধ! একটু পরপর খোঁজ নিচ্ছি! আমার ভল্কেনো হাইক শিকেয় তুলে, ছেলের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত! আমার বাবা–মায়ের মন খারাপ, তাদের কাছে থেকে ছেলেটার ইনজুরি হলো! তারা জানে, ছেলেটা বেশি চঞ্চল বলে, প্রতিদিন ওরে মনে করায়ে দিই, সেফটি প্রিকশন। ছোটমোট আঘাত ও পারলে আমার কাছে লুকিয়েই রাখে—প্রতিদিন চেক করাটা আমার রুটিন। ভাই আর মেয়ে মিলে যে ছবি পাঠাল, তাতে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল! আমি আমার কাজের জায়গায় ফোন দিলাম যে ওরা এক্স–রে করতে পারবে কি না! ও বলে, এখন তো সন্ধ্যা, আমরা তো বন্ধ। আমি ভুলেই গেছি সময়ের ব্যবধান! আবারও সব ইনস্ট্রাকশন দিয়ে—আমি ঘরে ফেরার ব্যাগ গোছালাম! পেছনে পড়ে থাকল অসংখ্য স্মৃতি! আসলে ঘরে ফিরলাম হাজারো স্মৃতি নিয়ে! সঙ্গে উৎকণ্ঠা আরও ১২+ ঘণ্টা, তার আগে ছেলেটাকে দেখতে পাব না! ফ্লাইট ছাড়ার আগে শুধু জানলাম, একটু ভালো—ছেলে আপাতত ঘুমাচ্ছে। সকালে দেখা হবে!