মুক্ত করো, না হয় মরতে দাও

লেখক
লেখক

ইংরেজিতে বলা হয়, ক্রাইসিস শেইপ হিস্ট্রি। আমাদের যাপিত জীবনের ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে। করোনা নামের ক্রান্তিকাল পার করছি। করোনাভাইরাস নিয়ে প্রতিদিন নতুন কিছু পড়ছি। আমরা কমবেশি সবাই সচেতন—ভীতু, শঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে আছি দেশে ও বিদেশে।

আমাদের ঘরবন্দী জীবন একেবারে নতুন ধারণা। সবকিছু নতুন, অভিনব ও অবিশ্বাস্য। যেন ব্লকব্লাস্টার কোনো সিনেমা দেখছি। এই মহামারি ভয়কে উসকে দেয়। ফলে ব্যক্তিগত জীবন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচরণকে সে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে। অসুখ না অভাব? জীবন বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে—এই ধারণা আমার চিন্তাকে অচল করে দেয়। অভাব সঙ্গে করে আরও কিছু সঙ্গীসাথি নিয়ে আসে। অপরাধ, অবক্ষয়, নীতিহীন জীবনব্যবস্থা—যেগুলো সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়। উন্নত দেশে সরকার মানুষের পাশে। দরিদ্র দেশগুলো নিয়ে চিন্তা। সব পেশার মানুষ অভাবি হবে, একশ্রেণি ব্যতীত। সবার সাহায্যে সরকার এগিয়ে আসতে পারবে না।


জাতিসংঘ রিপোর্ট করেছে, সমগ্র দুনিয়ার প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ কাজ হারাবে এ মারাত্মক ভাইরাসের কারণে। গ্লোবাল ফরেন সরাসরি বিনিয়োগে শতকরা ৪০ ভাগ নিম্নচাপে থাকবে। এই বিশ্বব্যথার বিষ আমাদের নীল করে দেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সে এক অদেখা ভিলেনের সঙ্গে লড়ে যাওয়া আমাদের। কোভিড–১৯ গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের ওপর মূল আঘাত হানবে। পাওয়ার শিফটিং বা ক্ষমতার বদল দুনিয়া দেখবে। দ্য ইউএন ট্রেড বলেছে, গ্লোবাল অর্থনীতির ক্ষতি হবে কম করেও এক ট্রিলিয়ন ডলার।

এবার আমি আমার চারপাশের অবস্থা দেখে নিজের ভাবনা শেয়ার করছি। ব্রিটেনে প্রচুর মানুষ কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়েছে। ১ লাখ ৩০ হাজার আক্রান্তের বেশির ভাগ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। দেহের শক্ত ইমিউন এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়ছে, লড়বে। আমার প্রতিবেশী, পরিচিতজন এই ভাইরাসে ভুগেছেন। তাঁরা ভালো হয়েছেন। লেখাটি লেখার সময় মারা গেছে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ। হাসপাতাল চাপে পড়বে, এই ভয়ে বিশ্ববাসী লকডাউনে চলে গেল। এর বাজে প্রভাব আমাদের প্রভাবিত করবে। আমেরিকায় লকডাউনের ভয়াবহতা আন্দাজ করে মানুষ মিছিল করছে। এই লকডাউন আমাদের ফ্রিডম ছিনিয়ে নিয়ে গেল। রাষ্ট্র আমাদের বেঁধে দিল, বন্দী করে ফেলল তাদের সারভিলেন্স নিয়ম দিয়ে। এটা কি আমরা টের পাচ্ছি? যার প্রথম চল শুরু হয়েছে নয়–এগারো দিয়ে। বিমানবন্দরে নিরাপত্তার চাপে ছিলাম, এখন ঘরে–বাইরে।

মন্দা, দুর্ভিক্ষ দরজায় কড়া নাড়ছে। আমেরিকার এক মিছিলকারীর প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘Live free or Die’। আসলেই ঘরবন্দী জীবন উপভোগ্য তখনই, যখন ঘরে খাবার, ইন্টারনেট কানেকশন, নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখা যাবে। কিন্তু গরিবের জন্য অভিশাপ এটা। অনাহারে শিশু কাঁদবে, মা–বাবা খাবার দিতে পারবেন না। মধ্যবিত্তরা লজ্জায় সাহায্য চাইতে পারবেন না। তখন অবস্থা তাঁদের দেয়ালে ঠেকাবে। কানাডা ও আমেরিকায় মানসিক অবসন্ন রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ভয়ের মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। এর দায়ভার কে নেবে? আমাদের ভিন্ন সলিউশন দরকার ছিল। আমার কষ্ট হয়, ২০১৯ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে প্রায় ৬ লাখ মানুষকে। ইরাক ও ইয়েমেনের হিসাব দিলাম না। এই জেনোসাইডগুলো নিয়ে আমরা নীরব। কোনো মৃত্যুই আমাদের ফ্রিডম নিয়ে খেলেনি। আমাদের বন্দী করেনি। আমি বিশ্বাস করি, মহামারির কারণে আমরা প্রিয়জনকে হারাব। সৃষ্টির আদিকাল থেকে হয়ে এসেছে। কিন্তু বিশ্ববাসীকে ঘরবন্দী করে, তাদের অভাবের দিকে ঠেলে দিয়ে ভয় ও অবিশ্বাসকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন রাজনৈতিক নেতারা, মিডিয়া—আর এক বিশেষ ব্লাডলাইন তিলকে তাল করে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র নাবারু বলেছেন, কোভিড-১৯ একদম চলে যাবে না, এর সঙ্গে বসবাস করার সন্ধি করতে হবে। লকডাউন শুধু একমাত্র সমাধান হতে পারে না। আমি বন্দী পশু না, মরার আগেই ভয়ে মরার পিল খেতে চাই না।