ফেরা অথবা ফিরে যাবার দোলাচল

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

সাহাবুদ্দিন ইতালি থেকে ঢাকায় এসেছে ১৭ দিন। আর আজকেই প্রথম ফারহানা সাহাবুদ্দিনকে ভালো করে দেখতে পেল।

সুদূর ইতালি থেকে ৩৫ ঘণ্টার প্লেন জার্নি করে এয়ারপোর্টের অনেক ঝক্কি–ঝামেলা পার হয়ে সাহাব যেদিন বাসায় এল, ফারহানার বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠেছিল। কেমন উসখুস মাথার চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মনে হলো কত দিন ভালো করে খায়নি। খুব ইচ্ছে করছিল সাহাবের কাছে যেতে, কাঁধের ব্যাগটা নিজ হাতে নামিয়ে নিতে। তার পর জিজ্ঞেস করতে, কেমন আছ? কিন্তু অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, সেই সুযোগটিও নেই।

অনেক আগে থেকেই সাহাবের জন্য দোতলার ঘরটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সাহাব এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ওই ঘরে গিয়ে উঠবে। হলোও তাই। গাড়ি থেকে নেমে শুধু একবার ফারহানার দিকে তাকিয়ে একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে সাহাব সোজা ওপরে চলে গেল। ফারহানার দেবর ওয়াহাব এবং ননদ শিউলি—ওরাই সব তদারক করছে। ওরা খুব সাবধানে ব্যাপারটা ম্যানেজ করছে। এয়ারপোর্ট থেকে কঠিনভাবে বলে দেওয়া হয়েছে হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়মগুলো মানার জন্য। আর ফারহানার শ্বশুর ইজিচেয়ারে বসে বসে নির্দেশনা দিচ্ছেন। এবার তিনি অনেকটা চিৎকার করেই বললেন, এই ওয়াহাব, শিউলি—দেখিস, ফারিয়া যেন ওর বাবার কাছে না যায়। এই ফারহানা, ফারিয়াকে সাবধানে রাখো। ফারিয়া ফারহানা আর সাহাবের তিন বছরের মেয়ে।

ফারহানা আর সাহাবের বিয়ে হয়েছে ছয় বছর আগে। সাহাব ইতালিপ্রবাসী। সেবার সাহাব দেশে বেড়াতে এসেছিল মাত্র কদিনের জন্য। সেই সুযোগে সাহাবের বাবা পাত্রী খুঁজছিলেন ইতালিপ্রবাসী ছেলের জন্য। পেয়েও গেলেন ফারহানাকে। ফারহানাকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই ওর বাবা একদিন রাতে ঘোষণা দিলেন, ‘মা রে, আগামী পরশু তোর বিয়ে।’ অনেকটা আকাশ থেকে পড়ার মতো। কিন্তু সাহাব ব্যাপারটাকে অন্যভাবে ম্যানেজ করেছিল। সাহাব ফারহানাকে বাসায় ফোন করে জানতে চেয়েছিল যে বিয়ের আগে একটা দিন নিজেদের একটু ভালো করে জানবার জন্য দেখা করতে পারে কি না। খুব কম সময়ের পরিচয়ে স্বল্পভাষী এবং বিনয়ী সাহাবকে ফারহানার ভালো লেগে যায়। এরপর অনাড়ম্বর বিয়ে, দুজন দুজনকে ভালো করে জানবার আগেই মাত্র বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় সাহাব ইতালি চলে যায়। না গেলে নাকি চাকরিই থাকবে না, এমনকি ভিসাও বাতিল হতে পারে।

এরপর সাহাব এসেছিল বিয়ের ঠিক দুই বছর পর। তখনো মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য সাহাব এসেছিল। সেই সময়েও সাহাব ফারহানাকে খুব একটা বেশি সময় দিতে পারেনি। সাহাবের মা অসুস্থ ছিল, ওনাকে নিয়ে বাসা আর হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি করতেই কেমন করে যেন দুই সপ্তাহ পার হয়ে যায়। ঠিক তখনি ফারহানা কনসিভ করে। ওদের একান্নবর্তী পরিবারে যুক্ত হয় ফারিয়া। এরপর এবারে সাহাব এল প্রায় চার বছর পর। বলতে গেলে সাহাবের সঙ্গে ফারহানার ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে এর আগে একসঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে ওই মাত্র তিন সপ্তাহ।

ফারহানা প্রথম যখন জানতে পারে সাহাব আসছে, কী অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে উঠেছিল ফারহানার মন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি যখন এই করোনাভাইরাসের দুনিয়াব্যাপী তাণ্ডব শুরু হয়। আর সেই তাণ্ডবের অংশ হিসেবে সাহাবকে বাধ্যতামূলক চৌদ্দ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। ভাগ্যিস, ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারেন্টিনে রাখেনি। বুকটা কেমন ফাঁকা হতে থাকে এই ভেবে কোয়ারেন্টিন শেষ হলেই হয়তো সাহাব আবার চলে যাবে। ওর তো বেশি দিন ছুটি পাবার কথা নয়। ফারহানা জানেও না সাহাব আসলে এবার কত দিন থাকবে। ইতালি থেকে আসার আগেও খুব একটা কথা হয়নি।

হঠাৎ করেই সাহাবকে দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ফারহানা তাই কখনো জিজ্ঞাসাও করেনি এসব। সাহাবের কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে খুব কষ্টে কেটেছে ফারহানার। নিজের চেয়ে মেয়ের জন্যই বেশি। মাথার ওপরে একটা ঘরে বাবা থাকছে, অথচ মেয়ে বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না, বাবা মেয়েকে আদর করতে পারছে না, এ কেমন কথা। ওয়াহাব আর শিউলির কড়া নজরদারি পেরিয়ে এবং শ্বশুরের সার্বক্ষণিক পাহারা অতিক্রম করে ফারহানার সুযোগ হয়নি ওপরে উঠে সাহাবকে একনজর দেখার। মাঝখানে দুই–দুইবার সাহাবই ফোনে টেক্সট করে ফারহানাকে ওপরে ডেকেছিল। বলেছিল, ‘অরে কী আর হবে, আমার তো আর করোনা হয়নি, ফারিয়াকে নিয়ে চলে আসো। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ঠিক ভয় থেকে নয়, তবে নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোটাও ফারহানার কাছে অনেক বড় একটা দায়িত্ব বলে মনে হয়েছে।

অবশেষে এল সেই দিন। কোয়ারেন্টিন শেষ। এখন আর কোনো সমস্যা নেই। ননদ শিউলি একবার ফারহানার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে গেল, ‘কী ভাবি, বাসরঘর সাজিয়ে দিব নাকি? ফারহানা বলল, ‘আর বাহাদুরি দেখাতে হবে না। অনেক দেখাইছ গত ১৪ দিনে।’ ফারিয়াকে কোলে নিয়ে আস্তে করে ফারহানা সাহাবের ঘরে ঢোকে। নিচ থেকে খিলখিল করে হাসতে থাকে ননদ শিউলি। ঘরে ঢুকে দেখে, সাহাব জানালার দিকে মুখ করে বাইরে তাকিয়ে আছে। ফারহানার উপস্থিতিতে সংবিৎ ফিরে পায়। ফারিয়াকে কোলে নিয়ে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে ধরে সাহাব। একরকম কেঁদেই ফেলে। মেয়েকে আদর করতে থাকে। ফারহানাকেও জড়িয়ে ধরে। দুজনেই কিছুক্ষণ কেঁদে নেয়। বহুদিন পরে জীবনের সবচেয়ে আপনজনকে কাছে পাবার আনন্দ। আনন্দের অশ্রুধারা বয়ে চলে কিছুক্ষণ। কেউই কোনো কথা বলতে পারে না। ফারহানার এই সাহাবকে পাবার আনন্দের মধ্যেও মনের মধ্যে অকস্মাৎ সাহাবকে আবার হারানোর বেদনা কুরে কুরে খেতে থাকে। খুব ইচ্ছে করে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারে না আবার কবে ফিরে যাবে সাহাব। নিজে নিজে যতখানি খবর দেখে অথবা খবরের কাগজ পড়ে জেনেছে, হয়তো সাহাবের খুব শিগগির ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সেটা অনিশ্চিত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সাহাব ইতালি ফিরে যাবে। আবার কয় বছরের জন্য যাবে কে জানে। ফারহানা আর এখন অত কিছু ভাবতে চায় না। শুধু ভাবে, হোক না মাত্র কটা দিন, তা–ও যদি একসঙ্গে কাটানো যায়।

এরপরে এক মাস পার হয়ে গেছে। সাহাব এক দিনও বাসা থেকে বের হয়নি। বাবা অনেকবার বলেছে, ‘এই সাহাব, যা না বাবা, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আয়।’ সাহাব যায়নি। পুরোটা সময় ফারিয়া আর ফারহানার সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছে। ফারহানার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়টুকু কাটিয়ে দিয়েছে গত এক মাসে। প্রতিক্ষণেই মনে হয়েছে, এই বুঝি সব ঠিক হয়ে গেল, এই বুঝি সাহাব চলে গেল। আবার সেই অনিশ্চিত সময়ের জন্য অপেক্ষা। ফারহানার সেই অপেক্ষার জীবন ভালো লাগেনি, কোনো দিন লাগবেও না। আবার এটাও জানে, সাহাবকে ফিরে যেতেই হবে। বাস্তবতা এটাই। সাহাবের আয়ের ওপরেই পুরো পরিবারটা চলছে। এ কেমন এক জীবনের টানাপোড়েন। ফারহানা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে যায়। তবু মাঝে মাঝে কেন জানি ফারহানার নিজেকে একটু স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করে। মনে হয় খুব শিগগির যেন সাহাব ফিরে না যায়। আরও কিছুদিন থাক, কয়েকটা মাস, হোক না এক বছর। আচ্ছা, সাহাব যদি আর ইতালিতে ফিরেই না যায়? না, অতটুকু ভাবতে পারে না ফারহানা। সেটা অন্য এক অনিশ্চিত জীবন, সেই জীবনের পুরোটাই ফারহানার অজানা। এই জানা জীবনেই সাহাব না হয় আর কয়েকটা দিন থেকে যাক।

ফারহানা আজকাল আর খবর দেখে না। সাহাব সারাক্ষণই ইতালির খবর দেখতে থাকে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে শত শত মানুষ। একটা করে দিন যায় আর সাহাবের হতাশা যেন বাড়তে থাকে। প্রতিদিনই ইতালিতে ফোন করে খোঁজ নেয়। ইতালিয়ান ভাষায় কী সব জিজ্ঞেস করে, ওপাশের নেতিবাচক উত্তর শুনে সাহাব চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ফারহানাকে একটুও বুঝতে দেয় না। ফারহানা জিজ্ঞেস করলেই মুচকি হেসে সাহাব উত্তর দেয়, ‘কিচ্ছু ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ফারহানা জানে না কী ঠিক হবে সব। এইটুকু বোঝে, কিছু একটা সমস্যা তো আছেই। মাঝে মাঝে খুব দুশ্চিন্তা হয়, আচ্ছা, সাহাব আবার যেতে পারবে তো? ওরা আবার ডাকবে তো? যদি আর না যেতে পারে? অত দূর ভাবতে পারে না ফারহানা। আপাতত এই মুহূর্তগুলোকেই পুরোপুরি উপভোগ করতে চায় সে।

একদিকে আপনজনকে কাছে পাবার আনন্দে ফারহানা যেমন বিভোর, প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহ তাআলার কাছে জীবনের এই শ্রেষ্ঠ সময়টুকুর জন্য শুকরিয়া আদায় করে, আবার অন্যদিকে অনাগত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আল্লাহকে বলে, সব যেন খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ফারহানা নিজেকে প্রশ্ন করে—জীবন এমন কেন?

একদিকে যেমন খুব স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করে, সাহাব আর ইতালিতে ফিরে না যাক, অন্যদিকে অনিশ্চিত জীবনের হাতছানি ফারহানাকে আড়ষ্ট করে। জীবনের বাস্তবতার কাছে নিজের স্বার্থপরতা তখন খুব ক্ষুদ্র হয়ে যায়। ফারহানা এখন প্রতি মুহূর্তে প্রার্থনা করে, সবকিছু খুব দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যাক। সাহাব ফিরে যাক ইতালি। নাই–বা দেখা হলো আরও তিন অথবা চার বছর, তাতে কী। সাহাবের অর্জিত আয়ে এই পুরো পরিবারটার হাসি অটুট থাকুক। বাবার আদর নাই–বা পেল ফারিয়া কিন্তু সে বেড়ে উঠুক পরিবারের আরও অনেকগুলো হাসিমুখ দেখে, মমতায় আর ভালোবাসায়। এ আশীর্বাদই হোক সাময়িক পিতৃস্নেহবঞ্চিত ফারিয়ার জীবনের সামনে এগিয়ে যাবার শক্তি। আর নিজের জন্য? সুন্দর একটা সোনালি ভোরের অপেক্ষা করবে ফারহানা আরও অনেকগুলো বছর। ফারহানা উপলব্ধি করতে পারে জীবনের আনন্দ একা একা উপভোগ করা যায় না। নিজের এতটুকু ত্যাগ যদি অনেকগুলো মানুষের জীবনের আনন্দের কারণ হয়, সেই আনন্দই জীবনের সবচেয়ে উপভোগ্য নয় কি?

ফারহানা এখন প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করে, এই পৃথিবী খুব শিগগির কোভিড-১৯ মুক্ত হোক। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হোক। সাহাবের মতো মানুষেরা আবার তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যাক। পৃথিবী হোক শান্তির নীড়।

*আগামীকাল পড়ুন: সবকিছুই করোনাময়

আরও পড়ুন