সবকিছুই করোনাময়

বৃদ্ধ নারীকে এগিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা। ছবি: সংগৃহীত
বৃদ্ধ নারীকে এগিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা। ছবি: সংগৃহীত

ছগির আলি একসময়ের তুখোড় ব্লগ লেখক, ফেসবুকে প্রতিদিন যার অন্তত ৫-১০টা কবিতা–গল্প লেখা হতো। বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় পাতায় নিয়মিতই যার কবিতা–গল্প ছাপা হতো। এই তো গত বইমেলাতেই যার দুটি উপন্যাস ও একটা কবিতার বই বের হয়েছে। এসব তো চাট্টিখানি কথা নয়।

ফেসবুকেই ছগির আলির প্রায় পাঁচ হাজার বন্ধু। সেই সঙ্গে পনেরো হাজার ফলোয়ার। সেই ছগির আলির হাত অথবা কলম কোনোটাই আজ আর চলছে না।

ছগির আলি মূলত রোমান্টিক লেখক হিসেবে পরিচিত। কবিতার অঙ্গনেও যার একজন বিদগ্ধ কবি হিসেবে অবাধ বিচরণ। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে আজ অবধি ছগির আলি একটাও মনের মতো কবিতা লিখতে পারেননি। প্রথম দিকে দু–চারটা করোনাবিষয়ক কবিতা লিখলেও এখন আর কোনো লেখাই আসছে না। গৃহবন্দী জীবনে ছগির আলির অবস্থা যেন শুকিয়ে যাওয়া তেজপাতা। এমনিতেও ছগির আলি খুব একটা কাজটাজ করেন না। বাবার রেখে যাওয়া ওই প্রেসটাই সম্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার পরও ভালো কোনো চাকরি আর খোঁজা হয়নি। লেখালেখি করে একদিন অনেক বড় কিছু হবেন, সেই ভাবনাতেই কেটে গেল জীবনের প্রায় ৪২ বসন্ত।

জীবনটা অনেক অপূর্ণই রয়ে গেল ছগির আলি। বিবাহিত জীবনের স্বাদ আস্বাদনও হলো না তার জীবনে। একাকী জীবন এত দিন চুটিয়ে উপভোগ করলেও আজকাল আর ভালো লাগে না। ছগির উদ্দিন তার বিবাহবিষয়ক উন্নাসিকতা এখন এ গৃহবন্দী জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। হঠাৎ হঠাৎ মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে, সেই দীর্ঘশ্বাসই বলে দেয়, ছগির, একবার চিন্তা করো তো আজ যদি তোমার একটা বউ থাকত। দু–দুটো ছেলেমেয়ে থাকত, তোমার এ ঘরবন্দী জীবন এতটা পানসে মনে হতো না। এসব ভাবতেই ছগিরের দীর্ঘশ্বাসের মাত্রা আরও দীর্ঘ হতে থাকে। মনের অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই লেখালেখিই যতসব অনিষ্টের মূল। আবার পরক্ষণেই অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেন ছগির।

তবে ছগিরকে তার অনেক ভক্তই অনেক সময় প্রশ্ন করে, এমন রোমান্টিক যার লেখা, সেই মানুষের জীবনে কেন প্রেম এল না, কেন কোনো প্রিয়জন পাশে নেই—এসব। ছগির ওই সব দিকে আর যেতে চান না। মনের সিন্দুকে বন্দী করে রাখা এক পাখি, যাকে কোনো দিনও আর ডানা মেলে আকাশে উড়তে দিতে পারবেন না ছগির। সেসব কথা থাক।

করোনাভাইরাসের দুনিয়াব্যাপী ধ্বংসলীলা শুরু হওয়ার পর থেকে ছগিরের জীবনে যেটা হয়েছে, তা হলো, তিনি লিখতে পারছেন না। কবিতা লিখতে গেলেও কবিতা হয়ে যাচ্ছে করোনাময়। যদিও বহুকষ্টে কবিতা থেকে করোনা বিষয়টি কেটেছেঁটে একটা রূপ দিতে চাচ্ছেন, পরক্ষণেই সেই কবিতা আর নিজের কাছেই পাঠ্য মনে হচ্ছে না। চারদিকে এত সব বাস্তব গল্প, জীবনের কাব্য যে কল্পনাপ্রসূত কোনো কাহিনিই তার ধারে কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আর পাঠকও এখন করোনাসংক্রান্ত লেখাই বেশি পছন্দ করছে। যদিও ফেসবুকে ইদানীং কোনো লেখাতেই খুব একটা মন্তব্য অথবা লাইক পড়ছে না। একটা কারণ হতে পারে, হয়তো অনেকেই এখন ফেসবুকবিমুখ। সবাই নিজের কথাই ভাবছে, কখন কী হয়।

ছগিরের জন্য এ ঘরবন্দী একাকী জীবন সত্যই বিষময়। নিভৃতচারী হওয়ার কারণে খুব একটা বন্ধুবান্ধবও ছগিরের নেই, যাদের সঙ্গে তিনি প্রাণ খুলে দুদণ্ড কথা বলতে পারেন। যা আছে, তা ওই ফেসবুকেই। লেখা না লিখলে সেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার মতো কেউ নেই। সবাই বলছে, ছগির ভাই লেখা দেন, কতদিন আপনার লেখা পড়ি না। কিন্তু বললে কী হবে, মন থেকে লেখা আসতে হবে তো। এই গত তিন–চার দিনে ছগির অন্তত ৪-৫টা কবিতা লিখতে শুরু করেছিল, কিন্তু কোনোটাই শেষ করতে পারেনি। একটু আগেই একটা কবিতা শুরু করেছিল এভাবে:

পৃথিবীর এই করোনাদিনে

কে আছে আমার বলো তুমি বিহনে

কবে হবে এই দিন শেষ

তুমি আমি দেব আড্ডা জম্পেশ।

নিজের লেখা কবিতার লাইন পড়ে নিজের ওপরেই নিজের রাগ হলো ছগির আলির। এত খারাপ কোয়ালিটি? কেটেকুটে আবার লিখতে বসলেন:

ধরো তুমি আমি একদিন

হাত ধরে আছি

করোনাবিহীন পৃথিবীতে

খুব কাছাকাছি।

ধ্যাত , এসব কী! কবিতা তো মনে হচ্ছে, ওয়ান–টুতে পড়ার সময় যেসব ছড়া লিখত ছগির, তেমন মনে হচ্ছে। কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে লেখা সব ডিলিট করে দিল। দু–দুবার আদা আর লবঙ্গের চা খেয়ে আবার লিখতে বসলেন। এবার আর কবিতা নয়। অসমাপ্ত দুটো উপন্যাস রয়েছে। ওইগুলো শেষ করা দরকার। সারা জীবন তো আর করোনা থাকবে না। আগামী বইমেলাতেই ওসব প্রকাশ করতে হবে। নিজেরই তো প্রেস, সমস্যা কী? প্রথম উপন্যাসটার দু–তৃতীয়াংশ লেখা শেষ। কয়েক দিন লিখলেই শেষ হয়ে যাবে। এখন আস্তে আস্তে ক্লাইমেক্সের দিকে এগোতে হবে। এই যাহ, এখানেও দেখি অনেক বড় ঝামেলা বেঁধে গেল। ‘তোমার বদলে যাওয়া দিনে’ শিরোনামের উপন্যাসটির নায়িকা সদ্য পাস করা একজন ডাক্তার। যতদূর লেখা হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্লাইমেক্সে পৌঁছতে হলে কোনোভাবেই এ উপন্যাসে করোনা ইস্যু ঢোকানো যাবে না। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ছগির একটা লাইনও লিখতে পারছেন না। ঘুরে ফিরে করোনা আসছেই। ছগির চাইলেও তার উপন্যাসের নায়িকা এই ডাক্তারকে করোনা ইউনিটে ডিউটি না দিয়ে পারছেন না। আর ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, তার নায়িকা যদি করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হয়, তা হলে ফলাফলটা কী দাঁড়াতে পারে। ছগির সিদ্ধান্ত নিল এ মুহূর্তে উপন্যাসটি নিয়ে আর এগোবেন না।

দ্বিতীয় উপন্যাস ‘তবুও জীবন’, যেটা কিনা প্রায় শেষ। একটা মধ্যবিত্ত জীবনের সাদামাটা গল্প। যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসার, যিনি শিগগিরই অবসর জীবনে যাবেন। একজন পুলিশ অফিসারের জীবনকে ঘিরে এই উপন্যাস রচিত হচ্ছে। শেষের দিকে এসে কোনোভাবেই এই অফিসার কে করোনাসংক্রান্ত কোনো দায়িত্বের বাইরে রাখা যাচ্ছে না। এটারও সমাপ্তি কোনো না কোনোভাবে করোনা দিয়েই করতে হবে। ছগির এবার ক্লান্ত–পরিশ্রান্ত হয়ে কম্পিউটার থেকে উঠে পড়ে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে অদূরে রাস্তার মোড়ে একজন বৃদ্ধা একটা চটের ব্যাগ হাতে নিয়ে হেঁটে চলেছেন। বারবার ব্যাগটি মাটিতে রাখছেন, আবার উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। মনে হচ্ছে, বৃদ্ধার দেহের তুলনায় তার হাতের বস্তাটারই ওজন বেশি। আরও দূরে টহলরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা দ্রুত পায়ে বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে বৃদ্ধাকে কী একটা বলে তার হাতের ব্যাগটি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। ছগির অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখতে লাগলেন। পুলিশ অফিসার বৃদ্ধাকে অনুসরণ করছেন। ছগিরের বুঝতে বাকি থাকে না পুলিশ অফিসার ওই বৃদ্ধাকে সাহায্য করার জন্যই এগিয়ে এসেছেন। দৃশ্যটি ছগিরের কাছে শুধু অবাক করার মতোই নয়, অনন্যসাধারণ।

ছগিরের যেহেতু আর কোনো কাজ নেই, প্রেসও বন্ধ, ভেবেছিলেন তুমুলভাবে লেখালেখি করে গৃহবন্দীর এই সময় পার করবেন। প্রথম দিকে ভেবেছিলেন দু–এক মাসের মধ্যেই লিখে ফেলবেন জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা অথবা গল্প অথবা উপন্যাস। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। ছগির মনে হয় তার ক্রিয়েটিভিটি হারিয়েই ফেলেছেন। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে এই সময়ে বড় বড় লেখকেরা কী করছেন না? যেমন আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন অথবা নির্মুলেন্দু গুণের মতো কবি? তাঁরাও কি ছগিরের মতোই খেই হারিয়ে ফেলছেন লেখালেখিতে? এখন তো আর সেসব জানার কোনো উপায় নেই। জানা যাবে আগামী বইমেলায়। তবে দেশের একজন মোটামুটি স্বনামধন্য সংগীত পরিচালকের সঙ্গে ছগিরের প্রায়ই কথা হয় এবং কথার এক ফাঁকে সেই পরিচালকও বলছিলেন কয়েকজন গীতিকার তাকে কয়েকটা গান লিখে পাঠিয়েছেন সুর করার জন্য, যার বেশির ভাগই করোনাসংক্রান্ত। সব লেখার সারমর্ম মোটামুটি একই। ভাবার্থ করলে দাঁড়াবে এই রকম ‘এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে, এই দিনেরে...’।

ছগিরের নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। আজকাল আর খবরও দেখতে ইচ্ছা করে না। মাঝেমধ্যে পৃথিবীর নামকরা দু–একটা পত্রিকার হেড লাইনগুলো দেখেন। খুঁজে ফেরে কোথাও কোনো আশার কথা আছে কি না। সবই সম্ভাবনার কথা। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনো আশাপ্রদ কোনো ফলাফল পায়নি। ছগির নিজেকেই জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা সত্যিই যদি এভাবেই চলতে হয় আরও দু–এক বছর? সে কি সম্ভব? বেঁচে থাকতে গেলে তো সম্ভব করতেই হবে। এই অবস্থার মধ্যে দিয়েই মানবসভ্যতাকে এগিয়ে যেতে হবে। তত দিন হয়তো করোনা করোনা বিষয়টা একটু হালকা হয়ে আসবে। করোনা আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়াবে। নিশ্চয় নতুন কোনো পথ আবিষ্কৃত হবে, কীভাবে চারদিকে বাতাসে ভয়ংকর ভাইরাস কণা থাকার পরেও নিজেদের ইনফেকশনমুক্ত রাখা যায়। কারণ, এই গৃহবন্দিত্বের জীবন তো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আপাতত এমন প্রত্যাশাতেই কাটাতে হবে আরও অনেক দিন।

ছগির তার কম্পিউটারে ফিরে আসেন। তাকে লিখতেই হবে। লেখালেখিই যেহেতু কাজ, না লিখে তো আর চলবে না। হোক না সব লেখা আপাতত করোনাময়। তবে নিজেকে করোনামুক্ত রাখার কোনো বিকল্প নেই।