গল্পটা হয়তো অনেকেরই...

নবনীতা চৌধুরী। বয়স উনচল্লিশের ব্যস্ত উঠোন পেরিয়ে এখন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। জীবনসংগ্রামের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে অসংখ্য নাবলা যুদ্ধের গল্প। এক নির্ভীক, সংগ্রামী নারী।

স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি বলে একমাত্র সন্তান অভিককে নিয়ে এখন নবনীতা চৌধুরীর আলাদা বাস।

বিচ্ছেদের খাতায় এখনো স্বাক্ষর সংসার ভাঙনের সুর না তুললেও স্বামীর জীবনে নতুন কারও আবির্ভাব হচ্ছে, সেই গুঞ্জন এখন আকাশে বাতাসে। এটা নিয়ে এখন আর নবনীতা দুশ্চিন্তা করে সময় নষ্ট করে না। যে জীবন থেকে অনন্তকালের ছুটি নিয়েছে, সে জীবনের দিকে উঁকি দেওয়ার রুচিটুকু এখন আর নেই। তবে যেদিন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে আপন আঁধারে, সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত আপদের আনাগোনা। একজন শিক্ষিতা, স্বাবলম্বী, সুন্দরী নারী স্বামীহীন একাকী জীবন যাপন করছে, এই ধ্রুব সত্যটা অনেকের কাছেই এখন চরমভাবে দৃষ্টিকটু। এক সমুদ্র কামনার অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে অসংখ্য পুরুষ আবেগীয় চোখে নিত্য গ্রাস করে নবনীতাকে।

নবনীতার অপরূপ সৌন্দর্য কখনো বয়সের হাত ধরে সমানতালে চলেনি। এখনো দেখলে বোঝাই যায় না নবনীতার দশ বছরের একটি ছেলেও আছে। নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নবনীতার পরিপাটি সাজসজ্জা বরাবরই ঈর্ষণীয় ছিল অনেকের কাছে। অজিতের সংসার ছেড়ে আসার পর ছেলে অভিককে নিয়ে একান্ত জীবন ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু বিড়ম্বনা শুরু হলো যখন থেকে নতুন পাড়ায় বসবাস শুরু করল। বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে এলাকার উঠতি বয়সের ছেলেটাও যেন নবনীতার প্রেমে হাবুডুবু খায়। অফিস থেকে ফেরার পথে মোড়ের দোকানটায় প্রায়ই নবনীতা টুকিটাকি কিনতে যেত। বাবার বয়সী দোকানদারের তীর্যক চাহনি আর অসংলগ্ন আচরণে ইদানীং সেখানে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে নবনীতা। অফিসের বস এবং কিছু সহকর্মীর নবনীতার একাকিত্ব ঘোচানোর আপ্রাণ প্রয়াস দেখে আজকাল নবনীতার চাকরিটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু একমাত্র অবলম্বনের কথা ভেবে মুখ বুজে সব সহ্য করে নেয়। ছেলেটাকে সত্যিকারের মানুষ বানাতে হবে। অমানুষের ভিড়ে যেন ছেলেটা মানুষ হতে পারে।

সারা দিনের ক্লান্তি শেষে যখন বিছানায় শুয়ে নিজের জন্য নবনীতা একান্ত কিছু সময় কাটাতে মোবাইলটা হাতে নেয়, তখন রাজ্যের রুচিহীন কাঙাল ম্যাসেঞ্জারে উঁচিঝুঁকি মারে। রাতের আঁধারে কত বুনো হায়েনার অযথা হাপিত্যেশ নবনীতার জন্য। বুকের পাঁজর যেন ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায় যখন নবনীতার নামের পাশে সবুজ বাতিটা জ্বলে থাকে। বিনা অনুমতিতেই ম্যাসেঞ্জারে ফোন দিয়ে বলে, 'ভাবি ঘুম আসছে না? আসবে কী করে? এখন কোথায় স্বামীর বুকে মাথা রেখে স্বপ্নের ফানুস ওড়াবেন, তা না করে একা একা! যাক সে কথা, ঘুম না এলে আমার সাথে কথা বলতে পারেন। আমিও রাত জেগে থাকি। আমার স্ত্রীর হার্টের সমস্যা। অসুস্থ মানুষ। পড়ে পড়ে ঘুমায়। আপনার সাথে জমবে বেশ।' অফিস সহকর্মীর এমন কটূক্তিতে ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসে নবনীতার।

মোবাইল বন্ধ করে নিস্তব্ধ রাতের আঁধারে দাঁড়ায় খোলা বারান্দাটায়। আকাশে তখন একফালি চাঁদ! নির্বাক তাকিয়ে রয় বেশ কিছুক্ষণ। নীরবে পাশে এসে দাঁড়ায় অভিক। বিমর্ষ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,'কী হয়েছে মা? তোমার কি মন খারাপ?' ছেলের মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে নবনীতা বলে, 'বাবা, জীবন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। এই যুদ্ধক্ষেত্রে সবাই একেকজন যোদ্ধা। তোমার মা–ও একজন যোদ্ধা। সমাজে একজন নারীকে অনেক যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। নারীর জীবনের যুদ্ধটা সেই শৈশব থেকেই শুরু হয়। জীবনের পরতে পরতে কত সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বদলায়নি। নারীকে এখনো সমাজ শুধু এক টুকরো মাংসপিণ্ড মনে করে। সুযোগ পেলে কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। আমি চাই তুমি নারীকে সম্মান করতে শিখবে, মর্যাদা দিতে শিখবে। নারীকে পাওয়ার বাসনায় নিজের ব্যক্তিত্বের বলি দেবে না। এই সমাজের সব পুরষ কিন্তু এক নয়। কিন্তু কিছু কুরুচিসম্পন্ন মানুষের দোষের ভাগ অনেকের নিতে হয়। তুমি সেসব মানুষকে অনুসরণ করবে, যারা নারীকে দিয়েছে সম্মান এবং মর্যাদা।' অভিক মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে। শান্ত কণ্ঠে বলে, 'মা, তুমি যখন বাইরে যাও, মানুষ তোমার দিকে কেমন করে তাকায়, এটা–সেটা বলে। আমি ছোট হলেও বুঝি ওই লোকগুলো ভালো না। যারা একজন মাকে সম্মান করতে জানে না, তাদের আমি ঘৃণা করি। আমি আমার চারপাশের সব নারীকে শ্রদ্ধা করব। কারণ, আমার মা আমার কাছে একজন সম্মানিতা নারী। মা আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, আমি তা–ই মান্য করে চলব।'

নবনীতা অভিককে বুকে টেনে নেয়। একরাশ প্রশান্তি যেন ছুঁয়ে যায় অন্তরে। মনে মনে ভাবে, সমাজটাকে যদি আবারও নতুনরূপে সৃষ্টি করা যেত, যদি প্রতিটি সন্তানকে জন্মের পরই নৈতিকতা, মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে বড় করা হতো, তবে হয়তো নবনীতার মতো একাকী যোদ্ধাদের সম্মান নিয়ে সমাজে টিকে থাকা সহজ হতো। তবুও সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে নবনীতা এগিয়ে যেতে চায় সামনের দিকে। পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন, নবনীতার আত্মবিশ্বাস নবনীতাকে আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। একাকী জীবনযুদ্ধে পরাজিত হলে চলবে না। এমন অসংখ্য নারী আজও সমাজে টিকে আছে সব অন্ধকার পায়ে মাড়িয়ে।