রূপসা আমার প্রথম প্রেম

রূপসা সেতু। ছবি: লেখক
রূপসা সেতু। ছবি: লেখক

প্রথম যৌবনে পদার্পণ করে যখন বাস্তব জীবনের পথ চলতে শুরু করলাম, তখন সমস্ত ভালো লাগা দুচোখের পাতায় এসে ভর করেছিল। অজানাকে জানার তুমুল আকর্ষণ ভাবতে শেখাত। কখনো কাউকে দুরন্ত সাহস দেখিয়ে ভালো লাগার কোনো বার্তা শোনাতে পারিনি।

পারিবারিক দৈন্যদশায় হলুদ হয়ে গিয়েছিল আমার সেই প্রথম যৌবনের সবুজ উদ্যান। সেই প্রচণ্ড ভেঙে পড়ার মুহূর্তে যে সাড়াজাগানো ধ্বনিতে কর্ণপাত করেছিলাম, সেটা ছিল একটা নদী। রূপে–যৌবনে আশাজাগানিয়া মোলায়েম নাম ছিল তার। সেই থেকে ভালোমন্দের পার্থক্য শেখার শুরু। সে ছিল আমার রূপসা। সেদিন থেকে রূপসা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম।

রূপসা ছিল আমার আরেকটি অস্তিত্ব। প্রিয়জনদের প্রতি আমার হৃদয়ের টানে রূপসা এসে ভাগ বসাতে শুরু করেছিল। আমিও রূপসাকে আমার মনেপ্রাণে স্থান দিয়েছিলাম। প্রিয়জনদের প্রতি আমার সকল টান রূপসাকে দিয়ে আমি হয়ে যেতাম মুক্ত ও স্বাধীন।

যদিও আমার অনেক কষ্ট হতো, এরপরও দূর থেকে কষ্টকে চাপিয়ে রাখার অভিনয় করতাম। সবার প্রতি মায়া কমাতে বেশি সময় দিতাম রূপসাকে। রূপসার মধ্যে আমার সকল সুখ খুঁজে নিতাম। রূপসার পাড়ে বসে রোজ ভাঙাগড়ার গল্প শুনতে পেতাম। আমার মনের ব্যথার উল্লম্ফন চাপিয়ে রাখতাম রূপসার কাছে গিয়ে।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অথবা বন্ধুদের সঙ্গেও এতটা সময় দিইনি, যতটা সময় আমি রূপসাকে দিয়েছি। রূপসা নদীর পাড়ে বসে থাকতে থাকতে কখন যে মধ্যরাত হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। মা অপেক্ষায় থাকত কখন বাসায় ফিরব। বাসায় ফিরলে মা জিজ্ঞেস করত, এতটা সময় কোথায় কাটিয়েছিস? আমার তো জানা ছিল বরাবরের মতো সেই একই উত্তর! বলতাম বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ছিলাম। মা বলত, কাল থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসবি। আমি চুপচাপ ঘরে গিয়ে খাবার টেবিলে বসতাম। রূপসার জন্য কতবার কতজনের সঙ্গে যে মিথ্যা বলেছি তার কোনো হিসাব নেই!

আমার প্রথম যৌবনে প্রথম প্রেয়সী রূপসা। লাজশরমের মাথা খেয়ে রূপসা কাছে ডাকত যখন-তখন। ফিরে যেতাম রূপসার কাছে। রাত যতই গভীর হতো, ততই রূপসার সঙ্গে একান্ত হতাম। রাতের নীরবতায় রূপসা আমাকে খুলে দেখাতো হাজার বছরের সমস্ত রূপের মহিমা। আমি বিমুগ্ধ হয়ে পাড়ে বসে দেখতাম তার সকল রূপ।

ঢেউয়ের সৌন্দর্যের মধ্যে পানকৌড়ির ডুবসাঁতার দেখে নিজেকে আবিষ্কার করতাম বারবার। পরিবারের টানাপোড়েনে যখন কাউকে প্রেয়সী বলে দাবি করতে পারিনি, তখন রূপসার প্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেদিন থেকে আজীবন রূপসার সম্মুখে বসে থাকার সম্মতি জানিয়েছিলাম। এখন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, আমার প্রথম প্রেমিকা কে ছিল? আমি বুক ফুলিয়ে চিৎকার করে বলব, রূপসা আমার প্রথম প্রেম। রূপসা আমার প্রথম প্রেমিকা।

প্রতিদিন বাড়িতে মায়ের এটা-ওটা রান্না চলত। আমি আর কোনো কিছুতে বাধা দিতাম না। শুধু শুধু মন খারাপ করার কীই–বা দরকার। যদিও আমি অতিরিক্ত ব্যয়ের পক্ষে কোনো দিন নই। যতটুকু প্রয়োজন, তার ঊর্ধ্বে কোনো কিছু নয়। আমার মিতব্যয়ী চালচলন পরিবারের কেউ তেমন পছন্দ করত না। তারা বলত, আজ মারা গেলে কাল দুই দিন! এত হিসাবের কী আছে?

তাদের সেই হিসাবের কাছে আমি হয়ে যেতাম আলাদা মানুষ। প্রয়োজনের অধিক ব্যয়ের বরাবরই ঘোর বিরোধী। আমার মিতব্যয়ী চালচলন দেখে কেউ কেউ বলত, এত হিসাব করে জীবন চলে না। এই কথাটি এখন বন্ধুরাও বলে। তারা বলে, জীবনকে মাঝেমধ্যে একটু নাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেখতে হয়। চুপচাপ নীরবে থাকার চেয়ে আওয়াজ দিয়ে থাকা দোষের কিছুই নয়। অন্তত আশপাশের কেউ তো বুঝতে পারে এই তল্লাটে কেউ একজন আছে। ভাবি, মানুষকে বোঝানোর কী আছে। নিজ জীবন যেমন নিয়মে বাঁধব, সেটাই আসল জীবন।

রূপসা নদীতে নৌকায় মানুষের যাতায়াত। ছবি: লেখক
রূপসা নদীতে নৌকায় মানুষের যাতায়াত। ছবি: লেখক

মানুষের মৃত্যু হয়ে গেলে একটা জীবনের মৃত্যু হয়। কৃতকর্ম যুগ-যুগান্তর মানুষকে জীবিত রাখে। দেহটা মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায়। একটা সময় মাটির উর্বরতা কমে যায়, কিন্তু কৃতকর্মের সতেজতা থাকে উত্তম।

মা বলত, আর কয়দিন মাত্র মধ্যে আছে তুই বিদেশে যাবি। এই কয়টা দিন অন্তত বাড়িতে থাক। ভাবলাম, সত্যিই তো বিদেশে চলে যাব আপন মানুষদের মায়া-মমতা ছেড়ে, কয়টা দিন বাড়িতে থাকি। বাড়িতে সবার সঙ্গে থাকলে যে আবার মায়াজালে জড়িয়ে যাব। সবার মায়া-মমতার জাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের সঙ্গে নিজে রোজ যে অভিনয় করেছি, তার কী হবে! সেসব অভিনয় মিথ্যা হয়ে যাবে। না, আবার নতুনভাবে মায়ায় জড়িয়ে নিজের ভেতর তোলপাড় করতে পারব না। বেরিয়ে যেতাম ভালোবাসার টানে রূপসা কাছে।

সারা দিন বাড়িতে থেকে যেন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। মাকে মিথ্যা বলে সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে পড়তাম সবার মায়া-মমতা ভুলে থাকতে। যেখানে গেলে একেবারে আলাদা হয়ে যাই। নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে অন্যকে আশার পথ দেখিয়ে হয়ে যাই উদার। যার রূপের মায়াজালে বন্দী হয়ে শিখেছি দুঃখ ভোলার মূলমন্ত্র, সেই রূপসার কাছে। কীভাবে জোয়ার-ভাটার মতো জীবনে উত্থান–পতন আসে তা-ও আমি দেখেছিলাম রূপসার কাছে গিয়ে। দুঃখ–দুর্দশা পেছনে ফেলে কীভাবে একাধারে বয়ে যেতে হয় সামনের দিকে, সেটাও আমি শিখেছি রূপসার পাড়ে বসে।

রূপসা, আর কত স্রোতোধারায় বয়ে যাবে তুমি? বেদের বহর, জেলের নৌকা আর কত দিন ভাসাবে তোমার বুকে? হৃদয়ের রাখিবন্ধন, মঙ্গলসূত্র—সবই ডুবিয়ে দিয়েছি তোমার অতল গহ্বরে। আজও নিভৃতে কান পেতে শুনি তোমার উল্লম্ফন। হৃদয়ের টান হৃদয় বোঝে। তুমি বোঝো ভাঙতে দুকূল। সব ভুলে কোনো এক দিক আমাদের ভালোবাসায় গড়ব দুকূল। কৃষক ফিরে পাবে তার আবাদি জমি। গর্ভবতী সবুজ খেতে ভূমিষ্ঠ হবে সোনার ফসল।
আজও মনে হয় সাদা কাশফুলের নিবিড় ভালো লাগায় বিমোহিত হয়ে চেয়ে থাকি রূপসার পাড়ে বসে কিছুটা সময়। বটবৃক্ষের ছায়াতলে বসে হাঁপিয়ে ওঠা জীবনে ক্লান্তিবিনোদনের আখড়া জমাই। ঢেউয়ের মধ্যে শুশুকের কাঁথা সেলাইয়ের ফোড় দেখি। প্রেয়সী রূপসার ঢেউয়ের মধ্যে ভালোবাসার গুনগুনানি শুনি।

মনের অজান্তে কে কখন মায়ার শিকলে বন্দী হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। স্বপ্ন এসে ভর করে চোখের পাতায়। মনের আবদ্ধ জানালায় উঁকি দেয় ভালোবাসার স্বর্গীয় অনুভূতি। নদীর মতো বয়ে যায় আমাদের বহমান জীবনধারা।