করোনা আমাদের কী শিক্ষা দিল

সারা পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম করোনা। খালি চোখে দৃশ্যমান নয়, এমন একটা ভাইরাস সারা বিশ্বের চেহারা পাল্টে দিয়েছে রাতারাতি। মানুষ এখন অনেকটাই ঘরবন্দী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যেন প্রকৃতি একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে। সেই সঙ্গে মানুষকেও অনেক কিছু উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। 

আমরা প্রায়ই নিজেদের কিছু স্বপ্নের কথা বলতাম, যেমন বাচ্চারা বলত স্কুল না থাকলে ভালো হয়; স্ত্রী চাইতেন তার স্বামী যেন সারাক্ষণ তার আশপাশে থেকে, তাকে সংসারের কাজে সাহায্য করে; স্বামী চাইতেন অফিস থেকে একটু অবসর। করোনাভাইরাস মনে হয় সবার মনের কথাটায় পড়তে পেরেছিল। তাই সবার মনের আশাই কমবেশি পূরণ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে করোনাভাইরাস তার কর্তৃত্ব পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

করোনা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য যে কতটা প্রকট। পাশাপাশি এটাও দেখিয়ে দিল, শহর ও গ্রামের মধ্যে জীবনপ্রণালি এবং মানসিকতার বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থা বোঝানোর জন্য বিজ্ঞজনেরা যতই উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও জিডিপির কথা বলুক না কেন, করোনা দেখিয়ে দিল বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোরই এখন পর্যন্ত কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।

করোনায় আক্রান্তের পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাগাড়ম্বর করে আসছিল তাদের পূর্ব প্রস্তুতি আছে। কিন্তু বাস্তবিকই যখন করোনা মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখন দেখা গেল করোনা মোকাবিলায় সরকারের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি তো ছিলই না বরং কোনো প্রকার সমন্বয়ও নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর কোনো মন্ত্রীকেই আর দেখা গেল না। শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিভিন্ন রকমের ভুলভাল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এলেন। করোনা মোকাবিলায় একটা সমন্বয় সেল গঠন করলেন, যার তদারকি তিনি নিজেই করবেন।

বাংলাদেশের চিকিৎসায় কোনো ত্রুটি হলেই সবাই সরাসরি চিকিৎসকদের দিকে আঙুল তোলেন। করোনা ছড়িয়ে পড়া শুরু করলেও এমনই একটা ধোঁয়া তুলে সমগ্র স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর দিকটি আড়াল করার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু দিনশেষে ডাক্তার ও নার্সরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। শুরুতেই পিপিইর সংকট দেখা দিল। সেখানে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও এগিয়ে এসেছে, কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে পিপিই সরবরাহ করা হয়েছিল, সেগুলো নাকি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডের ছিল না। পিপিই যদি নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডের না হয়, তখন সেটা জীবনের সুরক্ষা না করে জীবনঘাতী হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে করোনা শনাক্তকরণের জন্য সুলভ মূল্যের কিট তৈরি করেও গণস্বাস্থ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মানুষের দেখা পাচ্ছে না। মহামারির এই সময়েও মানুষ মুনাফাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

এরপর এল করোনা প্রতিরোধের উপায়। জানা গেল, মানুষ যত কম চলাফেরা করবে, এই ভাইরাস তত কম ছড়াবে। কারণ, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস শুধু মানুষকেই আক্রমণ করেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে একটা বাঘের শরীরেও করোনার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে আটকে রাখার জন্য ছুটি ঘোষণা করা হলো, তখন দেখা গেল সবাই এই ছুটিটাকে কাজে লাগানোর জন্য নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেল। আসলে মানুষ শুধু পেটের দায়ে ঢাকা শহরে থাকে। তাই সুযোগ পেলেই আবার সে গ্রামের দিকে ছুটে যায়।

মুশকিল হলো দিন আনা দিন খাওয়া মানুষকে নিয়ে। তাদের পেটের দায়ে ঘরের বাইর যেতেই হচ্ছে। যদিও কর্ম অনেক কমে গেছে। তবে সবচেয়ে মুশকিল হলো পোশাক কারখানার কর্মীদের নিয়ে। তাঁরাও ছুটি পেয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। কিন্তু মাঝপথে আবার কারখানা খুললে তাঁরা এলেন ঢাকায়। যেহেতু সব পরিবহন বন্ধ, তাই তাঁদেরকে ফিরতে হলো পায়ে হেঁটে। আবার কেউবা ফিরে এলেন মালামাল পরিবহনের কন্টেইনারে করে। এমনকি অনেকে মাছ পরিবহনের ড্রামে বসেও ফিরে এলেন। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমালোচনার মুখে আবারও কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলো। তখন পোশাক কারখানার কর্মীরা পড়লেন উভয়সংকটে। ঘরের বের হলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় কিন্তু আবার কাজে না গেলে পেটে ভাতও জুটবে না। অবশেষে কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। কারণ করোনা মাফ করলেও ক্ষুধা এই মানুষগুলোর নিত্যসঙ্গী।

এর মধ্যেই অবশ্য খবর পাওয়া গেল, অনেক পোশাক কারখানা কর্মীদের বেতন না দিয়েই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই শ্রমিকেরা ছুটি উপেক্ষা করে মজুরির দাবিতে রাস্তায় রাস্তায় আন্দোলন করছেন। এ ছাড়া পোশাক কারখানা খোলা বা বন্ধ থাকা নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে কারখানার মালিকশ্রেণি নিজেদেরকে শ্রমিকদের মালিক বলেই দাবি করে বসলেন। ব্যাপারটা অনেকটা আগেকার দিনের আদম ব্যবসার মতো। যেখানে মানুষ বেচাকেনা হতো এবং প্রত্যেক শ্রমিকের একজন করে মনিব থাকত। এই যদি হয় বাংলাদেশের সার্বিক সামাজিক অবস্থা, সেখানে বিভিন্ন মানদণ্ডে বাংলাদেশের উন্নয়ন কতখানি ঠুনকো, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সামান্য মানবতার যেখানে ঠাঁই নেই, সেখানে সমস্ত উন্নয়ন খুবই বেখাপ্পা দেখায়।

এর মধ্যেই লকডাউনে থাকা ধনিকশ্রেণির বিভিন্ন প্রকারের বিলাসিতার প্রচারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৯.৮০ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করেন, তার মানে এখানে শুধু এই শতাংশ মানুষের সমস্যা এবং ধ্যানধারণাই প্রতিফলিত হয়। যেমন তারা গরিব মানুষগুলোর বাইরে বের হওয়া নিয়ে খুবই খিস্তি করছে। আসলে ঘটনা এমন যে তারা এই মানুষগুলোর জীবন নিয়ে শঙ্কিত নয়। করোনা সংক্রমণ বাড়লে তাঁরা ঘরের মধ্যে বসে মণ্ডামিঠাই খেয়েও রক্ষা পাবে না। সে জন্যই তারা এগুলো করছে। এর পাশাপাশি তারা ভালো থাকার অভিনব সব পন্থা বের করছে, যেগুলো দেখলে বোঝা যায় তাদের অন্তরটা কতটা অন্তঃসারশূন্য। যাহোক তবুও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণেই সরকার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

করোনা আবারও বাংলাদেশের শ্রেণিবৈষম্যটা সামনে নিয়ে এসেছে। করোনার রোগীদের মধ্যেও ভিআইপি এবং সাধারণ মানুষ খোঁজা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ভিআইপি রোগীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সমালোচনার মুখে সরকার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, এমন কোনো কিছুই করার পরিকল্পনা সরকারের নেই। কিন্তু আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে চায়, কেউই সেটা আটকাতে পারবে না। এ ছাড়া শুরু হয়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিভিন্ন প্রকার প্রণোদনা ঘোষণা। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, চাকরির শ্রেণি অনুযায়ী প্রণোদনারও শ্রেণি আছে। আমার ভাবতে খুবই অবাক লাগে, শ্রেণি ব্যবধানে মানুষের যদি শারীরিক গঠনে এবং ক্ষুধার তারতম্য না থাকে, তাহলে প্রণোদনার মধ্যে শ্রেণিব্যবধান করাটা নিতান্তই হাস্যকর।

এরপর আসছে সাধারণ মানুষের সাহায্য করার বিষয়, যেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই জরুরি। কারণ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর জন্য এটাই ঘরে থাকার একমাত্র উপায়। ত্রাণ বণ্টন নিয়ে চলছে একধরনের লুট। আমরা যারা গ্রামের ছেলেমেয়ে, তারা ছোটবেলা থেকেই মেম্বর–চেয়ারম্যানদের এসব চুরি দেখে দেখে অভ্যস্ত। ফেসবুকের কল্যাণে এবার সেটা সবাই জেনে গেছে এবং শহুরে ভদ্রলোকেরা খুবই অবাক হয়েছেন। আসলে সম্পদের সুষম বণ্টন হলে কবেই বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য পালাত কিন্তু সেটা যে এখনো হয়নি, করোনা আবারও সেটা দেখিয়ে দিল। চাল–ডাল থেকে শুরু করে কী নেই চুরির তালিকায়।

এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে শুরু হয়েছে আরেক অত্যাচার, যার নাম ধান কাটা। স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের দেশপ্রেমিক এবং কৃষি ও কৃষকপ্রেমিক প্রমাণ করতে খেতে নেমে গিয়ে ধান কাটছেন। সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন একগাদা ক্যামেরা। উনাদের পোশাক–পরিচ্ছদ দেখলেই বোঝা যায় যে উনারা ধান কাটার মডেলিং করছেন। অনেকে আবার কাঁচা ধান কেটে ফেলছেন ভুল করে। আর উনাদের কেটে যাওয়ার পর খেতের ধান গোছাতে গিয়ে কৃষকের বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।

এত কিছুর পরও মানবতা বেঁচে আছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। দাঁড়াচ্ছেন দুর্গত মানুষ এবং কৃষকের পাশে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, মানুষ মানুষের জন্য নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন অনেক দায়িত্ব। বিদ্যানন্দ ত্রাণ বিতরণে ইতিমধ্যেই অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণ করছে সেনাবাহিনী এবং বিজিবির সহায়তায়। এতে তাদের সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হচ্ছে। মানুষ মানুষের জন্য ডাক্তারদের পিপিই তৈরি এবং বণ্টনের পাশাপাশি এখন ত্রাণ বণ্টনেও হাত দিয়েছে এবং বেশ ভালোভাবেই তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। আর এসব বেসরকারি উদ্যোগে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরা। তাঁরা তাঁদের সর্বোচ্চ দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এভাবেই আসলে বিভিন্ন ধরনের মহামারি পার করে মানবসভ্যতা টিকে থাকে।

যখন করোনার প্রকোপ শুরু হলো, তখন ভেবেছিলাম করোনাকালীন বাংলাদেশ হবে একটা শ্রেণিবৈষম্যহীন বাংলাদেশ। কারণ করোনা ধনী–গরিব, শিক্ষিত–অশিক্ষিত, আমলা–কৃষক কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সমস্যাগুলো আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই শঙ্কিত। কারণ, করোনা–উত্তর বাংলাদেশের দরকার হবে অনেক খাদ্যের, যার যোগানদাতা আমাদের কৃষক। কিন্তু এখন পর্যন্ত কৃষকদের বাঁচানোর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। উপরন্তু তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত সবজির ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এভাবে চললে করোনা–উত্তর বাংলাদেশ খাদ্য নিয়ে সমস্যায় পড়বে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই কৃষকদের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনা ঘোষণার মাধ্যমে ধান থেকে শুরু করে সব খাদ্যশস্যের সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে; তাহলেই শুধু বাংলাদেশের মানুষ বাঁচবে।