আইসিইউ ও একজন জুয়ানিটার গল্প

হাসপাতালে জুয়ানিটা নিটালা। ছবি: বিবিসি
হাসপাতালে জুয়ানিটা নিটালা। ছবি: বিবিসি

ভেন্টিলেটরের সুইচ অফ করে দিলে নিশ্চিত মৃত্যু। জুয়ানিটা নিটালার কাজ হচ্ছে সেই সুইচটা অফ করে দেওয়া!

লন্ডনের বিখ্যাত রয়েল ফ্রি হাসপাতালের সিনিয়র নার্স হচ্ছেন জুয়ানিটা নিটালা। কাজ করেন ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। একজন অভিজ্ঞ ভেন্টিলেটর অপারেটর হিসেবে তাঁর রয়েছে আলাদা সুখ্যাতি।

করোনায় আক্রান্ত এই সময়ে জীবন-মৃত্যুর তফাৎ গড়ে দিচ্ছে ভেন্টিলেটর নামের এই যন্ত্র। ফুসফুস যখন বুকের ভেতরে বাতাস টেনে নিতে পারে না, তখন ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে শরীরে পৌঁছে যায় মহামূল্য অক্সিজেন। জীবন তখন দম নিতে পারে, দমে দমে টিকে থাকে বাঁচার আশা। করোনার এই নিদানে ভেন্টিলেটরকে বিবেচনা করা হচ্ছে জীবনরক্ষার অন্যতম শেষ অস্ত্র হিসেবে।

শেষ অস্ত্রটি সব সময় শেষ কথা বলে না। বহুবার ভেন্টিলেটরকে ব্যর্থ করে দিয়ে শেষ কথা বলে ওঠে মৃত্যু। আর যখন মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন ডাক পড়ে জুয়ানিটার, যাঁর কাজ হচ্ছে, ভেন্টিলেটরের সুইচ অফ করা।

৬ বছর ধরে ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট বিশেষজ্ঞ নার্সের দায়িত্ব পালন করছেন জুয়ানিটা। কাজটা মোটেও সহজ নয়। অনেক সময় মনে হয়, যেন মানুষের মৃত্যুর দায়ভার গ্রহণ করা। ১৬ বছর পার করেও তাই মাঝেমধ্যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিপন্ন বোধ করেন জুয়ানিটা। করোনাকালে এসে প্রতিদিন অসংখ্য মৃত্যুর মিছিলে জুয়ানিটা যেন আরও বেশি বিপন্ন, আরও বেশি বিধ্বস্ত। ৪২ বছর বয়সী জুয়ানিটা বলেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয় আমিই সুইচ বন্ধের জন্য দায়ী।’

ভেন্টিলেটর কেবল শরীরে অক্সিজেন পৌঁছে দেয় না, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস মেরামতে মুমূর্ষু জীবন তখন লড়াই করার জন্য বাড়তি সময়ও পায়। তবে এই সময়টুকু সবার বেলায় কাজে আসে না। হাসপাতালের মেডিকেল টিমকে তখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অবশ্য তার আগে হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিবেচনায় আনা হয় রোগীর বয়স, আগের কোনো গুরুতর অসুস্থতার ইতিহাস। তারপর অনুমোদন হয় মৃত্যুর সনদ। ঠিক তখন ডাক পড়ে জুয়ানিটার। ভেন্টিলেটরের সুইচ অফ করে দেন তিনি।

আইসিইউতে রোগী। ছবি: বিবিসি
আইসিইউতে রোগী। ছবি: বিবিসি

মধ্য এপ্রিলের এক ভোরবেলা। প্রতিদিনকার মতো সকালের শিফটে কাজ শুরু করেন জুয়ানিটা। এই সময়ে ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটের রেজিস্ট্রার তাঁকে জানিয়ে দেন, আজ জুয়ানিটার প্রথম কাজ হচ্ছে ভেন্টিলেটরে থাকা করোনায় আক্রান্ত ৫০ বছর বয়সী একজন নারীর চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া। তার মানে হচ্ছে, ভেন্টিলেটরের সুইচ অফ করা।

কাজটি শুরু করার আগে জুয়ানিটা একবার রোগীকে দেখেন। এই নারীও ছিলেন একজন নার্স। মানুষের সেবা করে কাটিয়েছেন জীবন। আজ তাঁর চলে যাওয়ার বেলা। করোনা এতই করুণাহীন শেষযাত্রায় আত্মীয়স্বজন, পরিজন কারও দেখা পাবেন না তিনি, কেউ তাঁকে দেখতে পাবে না।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ওই নার্সের মেয়েকে ফোন করেন জুয়ানিটা। বলেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আপনার মায়ের ভেন্টিলেটরের সুইচ অফ করে দেব।’

ফোনের ওপাশ থেকে মেয়ে বলেন, ‘আমার মায়ের কি খুব কষ্ট হচ্ছে। তিনি কি ব্যথায়-যন্ত্রণায় ছটফট করছেন? কথা বলতে গিয়ে কান্নায় গলা ভেঙে যায় মেয়ের।

জুয়ানিটা আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আপনার মা শান্তভাবে ঘুমিয়ে আছেন। দেখে মনে হয় না একটুও কষ্ট হচ্ছে তাঁর।’ এরপর মেয়ের কাছে জানতে চান, মায়ের কোনো শেষ ইচ্ছা ছিল কি না অথবা ছিল কি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা পালনের নির্দেশনা।

কথা বলতে বলতে বেডের চারপাশে পর্দা টেনে দেন জুয়ানিটা। ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে এই নারী কাটিয়েছেন টানা আট দিন। বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম শেষে এখন তিনি অনেকটাই নিস্তেজ। হাসপাতালে ভোরবেলাও এভাবে জীবনের বহু সূর্য ডুবে যায়।

করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালে সহকর্মীদের সঙ্গে জুয়ানিটা নিটালা। ছবি: বিবিসি
করোনা চিকিৎসায় হাসপাতালে সহকর্মীদের সঙ্গে জুয়ানিটা নিটালা। ছবি: বিবিসি

মোবাইল ফোনটি রোগীর একদম কানের কাছে রাখেন জুয়ানিটা। মেয়েটি তখন মায়ের কানে শেষ কথাগুলো বলেন। ফোনের ওপাশ থেকে তখন বুকভাঙা কান্নার আওয়াজ ভাসে। কেঁদে কেঁদে মেয়েটি প্রার্থনা করেন। মহান স্রষ্টার বাণী মায়ের কানে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে তখন আবহসংগীতের মতো হালকা শব্দে একটা গান বাজে। মেয়েটি অনুরোধ করেছিল যেন মায়ের প্রিয় এই গানটি বাজানো হয়। তার অনুরোধ রাখা হয়েছে।

এর মধ্যে বন্ধ করা হয় ভেন্টিলেটরের সুইচ। মনিটরে তখন সতর্ক বাতি জ্বলে ওঠে। জীবনের বাতি নেভানোর এই কর্মযজ্ঞে মাত্র পাঁচ মিনিট ব্যয় হয়।

নার্স ওই নারীর হাত ধরে ছিলেন জুয়ানিটা। এবার হাতটি সরিয়ে নেন। মোবাইলের ওপাশে তখনো মায়ের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিল মেয়েটি।

এরপর সহকর্মীদের সহায়তায় মৃতদেহের গোসল করানো হয়, কাপড়ে জড়িয়ে দেহটি ব্যাগে ভরা হয়। ঠিক তার আগে মৃত নারীর কপালে ক্রসচিহ্ন এঁকে দেন জুয়ানিটা।

হাসপাতালের এক সকালের এমন অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জুয়ানিটা নিটালার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে এমন অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়, কিন্তু করোনাভাইরাসে মৃত্যুর এত ব্যাপকতায় আমরা বিহ্বল হয়ে আছি। মুমূর্ষু রোগীর জন্য রয়েল ফ্রি হাসপাতালে আগে যেখানে ৩৪টি বেড ছিল, এখন সেটি ৬০ করা হয়েছে। আগে যেখানে এই ইউনিটে একজন রোগীর জন্য একজন নার্স বরাদ্দ ছিল, এখন সেখানে প্রতি তিনজন মৃতপ্রায় রোগীর জন্য একজন নার্স কাজ করছেন। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

জুয়ানিটার মতো নার্সরা প্রকৃত অর্থেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। করোনায় বেঁচে থাকার এই লড়াইয়ে তাঁরা শক্তি হয়ে এসেছেন, সাহস হয়ে এসেছেন। অযুত–লক্ষ মানুষের ভরসা হয়ে থাকা জুয়ানিটারাও অসুস্থ হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন। তবু তাঁরা সাহসহারা হচ্ছেন না, আমাদের সাহস হারাতে দিচ্ছেন না।

প্রতিদিন শিফট শুরুর আগে ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটের নার্সরা একে অন্যের হাত জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করেন, শপথ করেন, বেঁচে থেকো, বাঁচিয়ে রেখো! তাঁদের এমন প্রার্থনায় এই মরা সময়েও গোলাপ ফোটে।
জুয়ানিটাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। (বিবিসি অবলম্বনে)