মহাকালের মহামারি ও একালের করোনা

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

হালের প্রচলিত মহামারি শব্দটি আবহমান প্রাচীন বাংলার গৃহস্থালিতে বহুল প্রচলিত মড়ক শব্দের সমার্থক রূপ। ধরিত্রীজুড়ে লাশের মিছিল আর মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্তনাদ যখন ভারী হয়ে ওঠে, তখন মড়ক শব্দটি যেন হয়ে ওঠে মহামারির যথার্থ প্রতিস্থাপন। প্রাচীন বাংলায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মন্বন্তর ও দুর্যোগ মহামারি যেন শুধু মানুষের মৃত্যুকেই উপস্থাপন করত। তাই এটিকে মহামারি না বলে মড়ক নামেই বুঝি অভিহিত করা হয়েছিল।

মৃত্যুর ভয়াবহতাকে মড়ক শব্দের মাধ্যমে যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসে তিনি ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে অগণিত মানুষের মৃত্যুকে মড়ক শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

হালের মহামারি শব্দটি ইংরেজি শব্দ ‘পেস্টিলেন্স’ থেকে এসেছে, যা মূলত ল্যাটিন পেস্টিলেন্সিয়া থেকে উদ্ভূত। কোনো সংক্রামক রোগ যখন ব্যাপক আকারে, বৃহৎ পরিসরে বিস্তৃত হয়ে অগণিত মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, তখন সেটিকে পেস্টিলেন্স বা মহামারি বলা হয়। পেস্টিলেন্সকে আবার প্লেগও বলা হয়। মূলত পেস্টিলেন্স শব্দটির উদ্ভব হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর ও বীভৎস–বিপর্যয় কালো মৃত্যু বা ব্ল্যাক ডেথকে উপস্থাপন করতে, যা ছিল মূলত একটি প্লেগ মহামারি। সে সময় ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে ব্ল্যাক ডেথ নামক মানব ইতিহাসের এই ভয়ংকর বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছিল। এই কালো মৃত্যুর মহামারিতে ১৩৪৬-১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়ার প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে এ রোগের উৎপত্তি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তৎকালীন কালো মৃত্যুতে আক্রান্ত হয়ে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৩০-৬০ ভাগ মানুষ মারা যায়। কালো মৃত্যু মহামারির ফলাফলস্বরূপ চতুর্দশ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে প্রায় ৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। ত্রয়োদশ শতকে ঘটে যাওয়া ব্ল্যাক ডেথ নামক ভয়ংকর মহামারির আগে-পরেও পৃথিবীতে অনেক মহামারি মানবসভ্যতাকে বিপর্যস্ত করেছে। মূলত ভাইরাস বা ক্ষুদ্র অণুজীব পৃথিবীর প্রায় সব মহামারির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। পৃথিবীর বয়স আজ প্রায় ৪৫৫ কোটি বছর। ধরিত্রীর বুকে প্রথম প্রাণের স্পন্দন শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে। সে হৃৎস্পন্দন শুরু হয়েছিল মূলত অণুজীবের মাধ্যমে। মনুষ্যবিহীন সে পৃথিবীতে ছিল এই অণুজীবের একচ্ছত্র আধিপত্য। আজ থেকে প্রায় তিন লাখ বছর আগে পৃথিবীতে মানব প্রজাতির আবির্ভাব ঘটে। সেই থেকে এই মানব প্রজাতি আজ পর্যন্ত এই ভাইরাস বা অণুজীবের অন্যতম পোষক। এই ক্ষুদ্র অণুজীবঘটিত মহামারিতে বিশ্বব্যাপী যেমন অগণিত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তেমনি মৃত্যু হয়েছে কোটি কোটি মানুষের।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই অণুজীব ঘটিত উল্লেখযোগ্য মহামারির ক্রমপঞ্জি দেখলে লক্ষ করা যায়, প্রথম মহামারিটি ঘটেছিল ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিসে। মূলত উত্তর আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলের দেশসমূহ তথা ইথিওপিয়া, লিবিয়া ও মিসর হয়ে তা গ্রিসে ছড়িয়েছিল। ঐতিহাসিক থুকিডাইসিসের রচনা থেকে জানা যায় সে সময় গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে চলছিল পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ। সেই সংকটকালীন টাইফয়েডজনিত এ মহামারিতে এথেন্সের দুই–তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এ কারণে স্পার্টানদের জয়লাভ করা সম্ভব হয়েছিল। সমগ্র অঞ্চলব্যাপী প্রায় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।

১৬৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যও গুটি বসন্তজনিত মহামারির কবলে পড়ে। রোম যেন জনমানবশূন্য হয়ে ভূতের নগরীতে পরিণত হয়। প্রতাপশালী রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুইসিয়াস ভেরাসের মৃত্যু হয় এই মহামারিতে। ২৫০ খ্রিষ্টাব্দে আবার সাইপ্রিয়ান প্লেগ মহামারি বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে জাস্টিনিয়ান প্লেগ মহামারি রোমান সম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেয়। এই শতাব্দীতে রোমান সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান রোম সাম্রাজ্যকে আগের প্রতাপশালী অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিউবোনিক প্লেগ মহামারিতে তাঁর মৃত্যু সেই সম্ভাবনাকেও শেষ করে দেয়। পরবর্তী ২ শতাব্দীতে এই বিউবোনিক প্লেগে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়, যা তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ। এই রোগ ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য তথা ইরাক, ইরান ও মেসোপটেমীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ষষ্ঠ শতকে ভয়ংকর প্লেগ মহামারিতে পুরো পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। লাশের দুর্গন্ধে সে সময়ে আকাশ–বাতাস দূষিত হয়ে পড়েছিল।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

৭৩৫-৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দ—এ দুই বছরে জাপানের এক–তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। এই ভয়ংকর প্লেগ মহামারিতে সে সময়কার সমৃদ্ধ বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। একাদশ শতাব্দীতে ইউরোপজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে কুষ্ঠ রোগ। ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে ভুগে মৃত্যু ঘটেছিল লাখো মানুষের। পরবর্তী ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীতে আসে ব্ল্যাক ডেথ বলে পরিচিত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মহামারি, যার প্রভাবে পৃথিবীর এক–তৃতীয়াংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এই প্লেগ মহামারির কথা সাহিত্য বা ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত। সেই সময়ে পৃথিবীব্যাপী গোটা ব্রিটেনের সামন্তব্যবস্থা এই প্লেগের কারণে বিপর্যস্ত হয়েছিল। দুনিয়াকাঁপানো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের ভাইকিং জলদস্যুরা এই মহামারির ফলে সমুদ্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে আসা একজন আফ্রিকান দাসের মাধ্যমে গোটা অ্যাজটেক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে গুটিবসন্ত, যা বয়ে আনে ভয়ংকর মহামারি। সমসাময়িক গবেষণা বলছে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানদের বয়ে আনা জীবাণুর কারণে আমেরিকা মহাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। আদিবাসীদের এই গণমৃত্যু আমেরিকা মহাদেশজুড়ে ইউরোপিয়ানদের আধিপত্যের সুযোগ করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসবাসীর মাধ্যমে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকদের মতে, এই গুটিবসন্ত মহামারিতে সে সময় প্রায় ২ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন’ মহামারিতে লন্ডনের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কুকুর–বিড়ালের মতো গৃহপালিত পশুপাখির মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার হয়েছে ভেবে নির্বিচারে কুকুর-বিড়াল নিধন শুরু হয়েছিল।

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ‘ইয়োলো ফিভার’ মহামারিতে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ উপনিবেশ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সৈনিক ও নাবিকদের মাধ্যমে এশিয়া ও ভারতবর্ষে কলেরা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, যাতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষ ছাড়াও স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। সব মিলিয়ে সে সময় বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৩ লাখ মানুষ মারা যায়। পরবর্তী দেড় শ বছরে প্রায় এই কলেরা মহামারিতে বিভিন্ন দফায় সারা বিশ্বে প্রায় দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স উপনিবেশ আলজেরিয়ার ওরান শহরে প্লেগ মহামারি আকার ধারণ করে। সেই সময় সাব সাহারান অঞ্চলে এই মহামারিতে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়। যার বর্ণনা পাওয়া যায় আজ থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৪৭ সালে আলবার্ট কামু রচিত মহামারির উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’-এ। সাম্প্রতিক করোনা মহামারিতে কামুর সেই ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি বেশ পাঠক সমাদৃত হয়েছে। যার ফলস্বরূপ ‘দ্য প্লেগ’–এর ব্রিটিশ প্রশাসক পেঙ্গুইন ক্লাসিক জানিয়েছে, এই গেল ফেব্রুয়ারির এক সপ্তাহে বইটির ১ হাজার ৫০৪ কপি বিক্রি হয়। বইয়ের জোগান দিতে প্রকাশক রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।

১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্লেগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। চীন থেকে যার সূত্রপাত হয়ে হংকং ও ভারতে ছড়িয়ে মহামারি আকার ধারণ করে। এই ভয়ংকর মহামারিতে প্রায় দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। ১৮৬০ সালে প্লেগ পুনরায় মহামারি আকার ধারণ করে। এ সময় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।

১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দেখা দেয় ‘রাশিয়ান ফ্লু’, যা ছিল ফ্লুর মাধ্যমে সৃষ্ট প্রথম মহামারি। সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তানে এর সূচনা হয় এবং পরবর্তী সময়ে পোল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। ইউরোপ ছাড়িয়ে উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলেও এই ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। এই ফ্লু মহামারিতে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে মহামারি প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসে প্লেগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই ভ্যাকসিনের আবিষ্কার বহু মানুষের প্রাণ বাঁচায়। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে পুনরায় প্লেগের সূত্রপাত হয়। ভ্যাকসিনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী তার প্রাদুর্ভাব কমে যায়। সে সময় শুধু চীনের মাঞ্চুরিয়াতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তিস্থল চীন

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এক মহামারি। যার নাম ছিল ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। এই ফ্লু মহামারিতে বিশ্বের প্রায় ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। সংখ্যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের চেয়েও বেশি। সে সময় এই স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয়। এই প্রাণঘাতী স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তিস্থল ছিল চীনে। চীনা শ্রমিকদের মাধ্যমে কানাডা হয়ে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। স্পেনে এই ফ্লু সবচেয়ে মহামারি আকারে রূপ নেয়। তা ছাড়া স্পেনের সংবাদমাধ্যমগুলো এ খবর মুক্তভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছিল। সে জন্য একে ‘স্পানিশ ফ্লু’ নামে অভিহিত করা হয়। শুধু স্পেনেরই প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এই ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। এটি কে ‘দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক’ নামেও অভিহিত করা হয়।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে হংকং থেকে চীনে ছড়িয়ে পড়ে ‘এশিয়ান ফ্লু’ নামে আরেক মহামারি। পরে তা আমেরিকা হয়ে যুক্তরাজ্যেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৫৮ সালে এশিয়ান ফ্লু আবার দ্বিতীয় ধাপে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু আমেরিকাতেই ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ মারা যায়। ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগ এই মহামারি দমনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আফ্রিকায় দেখা দেয় ইবোলার প্রাদুর্ভাব। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে এ রোগে অন্তত ১১ হাজার মানুষ মারা যায়। এই ভাইরাসে মৃত্যুহার প্রায় ৫০ শতাংশ। এটি এতটাই ভয়াবহ যে এ রোগে সংক্রমিত হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যু অবধারিত।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয় এইচআইভি বা এইডস ভাইরাস। বিজ্ঞানীদের মতে, ১৯২০ সালের দিকে পশ্চিম আফ্রিকায় এই ভাইরাসের উদ্ভব ঘটে। ১৯৮৪ সালে শুধু আমেরিকাতেই এ রোগে মারা যায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার কৃষি শহর নিপাহতে দেখা দেয় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। প্রথমদিকে শূকরের মধ্যে এ রোগ শনাক্ত হলেও পরবর্তী সময়ে বাদুড় এই ভাইরাসের অন্যতম বাহক হিসেবে কাজ করে। এ রোগে মৃত্যুহার ৭৯ শতাংশের মতো। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতিবছর এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। ২০০২ থেকে ২০০৩ সালে সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাসে সারা বিশ্বের ১৭টি দেশে প্রায় ৭৭৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়। চীনে এ ভাইরাসের উদ্ভব ঘটে। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু বা এইচ ওয়ান এন ওয়ান ফ্লুতে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার মানুষ মারা যায়। ধারণা করা হয়, বিশ্বব্যাপী এ ফ্লুতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো। ২০১০ সালে হাইতিতে ঘটে যাওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পের পরে কলেরা মহামারিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে মার্স (মিডল ইস্ট অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় সৌদি আরবে। পরে তা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, উট থেকে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটে। এই সময় প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালে এশিয়ার দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ। এতে শুধু ফিলিপাইনেই মারা যায় প্রায় ৯০০ মানুষ। বাংলাদেশেও শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায় এই ডেঙ্গুতে।

কোভিড–১৯ প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব। ছবি: রয়টার্স
কোভিড–১৯ প্রতিরোধে একটি ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় আছে পুরো বিশ্ব। ছবি: রয়টার্স

করোনা অর্থ মুকুট
এবার আসা যাক হালের করোনাভাইরাস প্রসঙ্গে। করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন শব্দ করোনা থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ক্রাউন বা মুকুট। এই ভাইরাসের দেহ গঠনে অগণিত মুকুটসদৃশের উপস্থিতি বুঝি এর নামের যথার্থতা বহন করে। জুন আলমেইদ্যা ও ডেভিড টাইরেল নামে দুজন বিশেষজ্ঞ ১৯৬০–এর দিকে প্রথম এই হিউম্যান করোনাভাইরাস পর্যবেক্ষণ ও এ–সম্পর্কিত বিস্তারিত অধ্যয়ন করেন। পরে ১৯৬৮ সালে একদল প্রখ্যাত ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এটিকে নতুন ভাইরাসের ফ্যামিলি হিসেবে চিহ্নিত করে ‘নেচার’ জার্নালে উপস্থাপন করেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসটি মানুষের দেহকোষের মধ্যে গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিতে ও সংখ্যা বৃদ্ধিতে সক্ষম। এ জন্যই এটি বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। করোনাভাইরাসের অনেক প্রজাতি আছে। তার মধ্যে সাতটি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে সক্ষম। করোনাভাইরাসের আরেক নাম কোভিড-১৯। ২০১৯ সালের একবারে শেষ ও ২০২০–এর শুরুর দিকের মাঝামাঝি সময়ে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে উদ্ভব হয় এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের। পৃথিবীর ১৮৫টি দেশের আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩৪ লাখের বেশি। মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের। বাংলাদেশে এই রোগে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার মানুষ, মৃত্যু শতাধিক।

মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে পৃথিবীর আগের অনেক মহামারির তুলনায় করোনা মহামারি হয়তো অতটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা নয়। হালের করোনা মহামারি মূলত গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের শিখরে অবস্থান করেও মানুষ কর্তৃক এই ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে। আধুনিক রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থা ও বিজ্ঞানের এই স্বর্ণযুগে সামান্য ভাইরাসের মতো অণুজীবের মারাত্মক ছোবলের কাছে মানুষের তীব্র অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। রঙ্গলীলার এক গতিময় পৃথিবীর হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া ও অগণিত লাশের মিছিল আমাদের অনেক কিছু নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। মানুষ এই পৃথিবীর সর্বেসর্বা চালিকা শক্তি নয়। আদিকাল থেকে মানুষের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় এই ধরনের মহামারি মানুষকে সর্বদা শিক্ষা দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা নির্বোধ মানুষ সেটা বারবার উপেক্ষা করেছি। আমাদের অমানবিক ও নোংরা কর্মফলের বাস্তব উদাহরণ হলো এই প্যানডেমিক করোনা মহামারি। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ যখন বিশৃঙ্খল হয়েছে, এক মানুষ যখন অন্য মানুষের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে চেয়েছে, নিয়তি তখন বারবার এমন মহামারির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা দিতে চেয়েছে। তার বাস্তব উদাহরণ হলো এই করোনা মহামারিতে হিংসাত্মক পৃথিবীর হঠাৎ মানবিক হয়ে ওঠার জ্বলন্ত প্রয়াস। এই মহামারি আমাদের জাত, শ্রেণি, পেশা ভুলে এক কাতারে আনতে অনেকখানি সফল। আমাদের নৈতিকতা, সততা ও মানবীয় মূল্যবোধের যথার্থত জাগরণই হতে পারে এমন সব বীভৎস মহামারির একমাত্র রক্ষাকবচ। পরিশেষে করোনা–পরবর্তীকালের যাত্রায় যদি বেঁচে ফিরি, তাহলে আশায় থাকব অধিকতর সংবেদনশীল ও মানবীয় এক নতুন পৃথিবীর।

* লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি গবেষক, হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান