বিদেশে বন্ধুযোগ ও বাটপারের খপ্পরে

গেল বছরের নভেম্বর মাস। বেড়ানোর উদ্দেশে রোমে যাওয়া। উঠেছি টেস্টাভেরে নামক জায়গায়, একটি হোটেলে। ঠিক হোটেল নয়, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। আমিসহ তিনজন। দুজন আমার সিনিয়র অফিসার। রোম থেকে অবশ্য একটু দূরে। দুটি স্টেশন পরে রোম সেন্টার।

জায়গাটার নাম টেস্টাভেরে হলেও রোমে থাকা বাঙালিরা জায়গাটিকে ঢাকার ধরনে নিজের মতো করে নাম দিয়েছেন ‘তেস্তিবাড়ি’! শুনে মনে হয় তেজগাঁও বা তেজকুনিপাড়ার আশপাশের কোনো জায়গা। স্টেশনের পাশেই, বলা যায় প্রথম আবাসিক ভবনটিতেই হোটেল। কিন্তু চিনতে পারছি না। কোনো সাইনবোর্ড নেই। আবার তখন ইতালির সিম কার্ডও নেই যে কল করব। অনলাইনে বুকিং দেওয়া ছিল। যোগাযোগ হয়েছে ই-মেইলে। বুকিংয়ের সময় রোমে থাকা এক বন্ধুর মোবাইল নম্বর দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কাছে ইতালির সিম না থাকায় বিপদে পড়েছি।


তুরিন থেকে আমরা বিকেলে রওনা দিয়েছিলাম। পথেই সন্ধ্যা এবং এখানে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেছে। এদিক-ওদিক ঘুরছি আমরা। সঙ্গে লাগেজ। তিনজনেরই। আমি আর একজন সেগুলোর দিকে লক্ষ রেখে দাঁড়ালাম, আর অন্যজন খুঁজতে থাকলেন। কাছেই অবশ্য দুটি রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল। তার মধ্যে একটি রেস্টুরেন্টে একজন বাঙালি পাওয়া গেল, চাকরিজীবী। তার চেয়ে আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এল সেখানে খেতে আসা বাঙালি ছেলে রাজু। আমাদের পরের দিনগুলোর ভ্রমণসঙ্গী। রাজু ফোন করে যোগাযোগ করলে হোটেলের প্রতিনিধি এলেন আমাদের নিয়ে যেতে। দেখলাম আমরা প্রায় আধা ঘণ্টা অবধি হোটেলটিরই গেটে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করেছি। গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে গিয়ে অবশ্য জিজ্ঞেস করারও সুযোগ ছিল না। যাহোক, রাজুর সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গতা হয়ে গেল। সে বেশ কয়েক বছর এখানে আছে। পরিবারের সবাই থাকে এখানে, নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। কথায়-আচরণে রাজুকে বেশ আপন মনে হলো আমাদের। রাজুর নিজের গাড়ি আছে। সে আমাদের প্রস্তাব করল রাতেই রোম শহর দেখার জন্য। আমাদের পরিকল্পনা ছিল পরের দিন সকালে বের হব, সারা দিন বাইরে কাটিয়ে রাতে রুমে ফিরব। কলোসিয়াম, রোমান ফোরাম, ভ্যাটিকান সিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে যাব যতটা পারি, যেটা কাভার করতে যদি না পারি পরদিন সকালে যাব, কারণ সেদিন বিকেলে ফেরার টিকিট। রাজুর প্রস্তাবে আমরা রাতেই বের হলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে বের হয়েও পড়লাম।


রাজুর গাড়ি স্টেশনের সামনেই পার্ক করা ছিল। চললাম চারজনে রোম সিটির দিকে। রাতের রোম অবশ্য বেশ ব্যস্তই দেখলাম। পরের দিন যেখানে যেখানে যাওয়ার কথা তার সবগুলো জায়গা রেকি করে এলাম। রাতে খেয়েও নিলাম ‘আল মদিনা’ নামে এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের মালিক খুব যত্ন করে খাবার পরিবেশন করলেন। খিচুড়ি আর গরুর মাংস। সেদিনের বেড়ানো শেষ করে রুমে ফিরলাম। পরের দিন সকালে উঠেই চলে গেলাম কলোসিয়ামে। ভোরবেলায় রাজু গাড়ি নিয়ে এসে নিচে অপেক্ষা করছে, ইতস্তত করে ডাকেনি প্রথমে। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আমাকে ফোন করে জানাল নিচে অপেক্ষা করছে। দ্রুত বের হয়ে আমরা প্রথমেই গেলাম কলোসিয়ামে।


লম্বা লাইন। অন্যান্য দিন টিকিট করে ভেতরে ঢুকতে হয়। কোনো বিশেষ উপলক্ষে আজ ফ্রি। আগের রাতেই ওখান থেকে তথ্যটা জেনেছিলাম। গেট খোলার প্রায় এক ঘণ্টা আগে থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছি, তবু মনে হলো শ পাঁচেক মানুষের পেছনে লাইনে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দর্শনার্থীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেল (আনুমানিক)। একটু দূরে টিকিট কাউন্টার, সেটা বন্ধ। কিন্তু যারা জানে না যে আজ ফ্রিতে ভেতরে যাওয়ার সুযোগ আছে, তারা শুরুতেই টিকিট কাউন্টারের সামনে যাচ্ছে। ওখানে কয়েকজন মানুষ টিকিট বিক্রি শুরু করেছে। গেট খুললেই সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দেবে। ৩৫–৪০ ইউরোর মতো চাইছে। বলছে এত বড় লাইনে দাঁড়ালে ৩–৪ ঘণ্টার আগে প্রবেশ করতে পারবেন না আর আমাদের টিকিটের মাধ্যমে লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াই প্রবেশ করতে পারবেন। আমরা বাঙালি। এ রকম ধান্দাবাজির সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। বুঝে গেলাম এখানে দালাল আছে। অন্য কথায় ধান্দাবাজ। তাদের ধান্দাবাজিতে কান না দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি আমরা। তাদের ওখানেও কয়েক শ মানুষ হয়ে গেছে। গেট খোলার পর দেখলাম বেশ দ্রুতই ভেতরে প্রবেশ করছে মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারলাম। একই সময়ে সেই ধান্দাবাজদের থেকে টিকিট নেওয়া মানুষও প্রবেশ করেছে।

কলোসিয়ামের ভেতরটা দেখলাম, ভেতরের ধ্বংসাবশেষ দেখলাম। ছবি তুললাম। বেশ খানিকটা সময় ঘুরে ঘুরে দেখে বের হয়ে ভ্যাটিকান সিটির দিকে এগোলাম। ভ্যাটিকান সিটির ওখানেও কিছু ধান্দাবাজও চোখে পড়ল। প্রচুর দেশি মানুষ পেলাম দুই জায়গাতেই। গাইড, হকার, ব্যবসায়ী। রাজুর ব্যস্ততা থাকায় তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম আমরা। রাতে আবার রোম শহরে আমাদের সঙ্গে থাকবে সে। অনেক জায়গাতেও যাওয়া হলো তার সৌজন্যে, যেগুলো আমাদের জন্য অপরিচিত ছিল। রাতে আবার আগের দিনের মতো বাঙালি হোটেলে খেতে চাইলাম। রাজুকে অনুরোধ করলাম আরেকটা হোটেলে নিয়ে যেতে। রাজু বারবারই বলেছে নিয়ে যাবে। হোটেল আছে। শেষে শহর থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে গেল। গাড়ি পার্ক করে গেট খুলে ওপরে যেতে থাকল। আমাদের ডাকল। আমরা উঠতে গিয়েও থমকে গেলাম, বাড়িটাকে হোটেল মনে হলো না। আবাসিক বাসা মনে হলো। রাজুকে জিজ্ঞেস করায় হেসে বলল, অসুবিধা নেই, আসেন, বাঙালি খাবার। এতক্ষণে আমরা বুঝে গেছি রাজু তার বাসায় নিয়ে এসেছে। হঠাৎ এভাবে বাসায় যাওয়ায় আমরা বিব্রত হয়ে পড়লাম। কোথাও বেড়াতে গেলে অন্তত উপহারসামগ্রী নিয়ে যেতে হয়, এটাই আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি। কিন্তু আমরা তো শূন্য হাতে আছি এখন, উপরন্তু সারা দিন ঘুরে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। রাজুকে বুঝিয়ে আমরা ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং প্রাণপণে তিনজন রাজুকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিছুদূর এগিয়েও চলে এলাম। কিন্তু এর মধ্যে রাজু বাসায় কল করেছে। হঠাৎ দেখি একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসছেন। তিনি এমনভাবে বললেন বাসায় যেতে যে তখন আর আমরা কেউ উপেক্ষা করতে পারলাম না। তিনি রাজুর মা। অগত্যা লজ্জাকে সঙ্গী করেই তাঁদের বাসায় যেতে হলো। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এতটা আন্তরিক মনে হলো বাঙালির অতিথিপরায়ণতার নজির পেলাম সবখানে। এখানে চাষ করা বাংলাদেশি জাতের লাউ, সবজি, শাক এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাংস দিয়ে নানান পদের তরকারি। আমি মূলত ভ্রমণরসিক, ভোজনরসিক নই, তবু বেশ তৃপ্তিসহকারে প্রায় সব পদই একটু করে পরখ করলাম। অসাধারণ একটি পরিবারের সঙ্গে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে আমাদের আবাসে ফিরে এলাম।


পরদিন সকালটা আমরা নিজেদের মতো কাটালাম, দুপুরে ফেরার কথা। তার আগেই আজও রাজু চলে এসেছে। আমরা স্টেশনে গেলাম ট্রেনে বিমানবন্দরে যাওয়ার উদ্দেশে। রাজুও যেতে চাইল সঙ্গে। কিন্তু বুঝিয়ে আমরা তাকে নিবৃত্ত করলাম। দেখলাম তার মন খারাপ হচ্ছে, বুঝলাম আমাদের সঙ্গও সে উপভোগ করেছে। আমাদের খুব খারাপ লাগছিল তাকে ছেড়ে আসতে। আমাদের তিনজনের কাছেই একাধিক ব্যাগ। আমার নিজেরও একটা লাগেজ এবং একটা ব্যাকপ্যাক। শীত তেমন নেই। ব্লেজার পরেছি, শার্টের ওপরে, ব্লেজারের বোতাম খোলা। ওয়ালেট রেখেছি ব্লেজারের পকেটে। একই পকেটে পাসপোর্ট, বিমান টিকিট। ট্রেনের সময় হওয়ার আগে আগে স্টেশনে বেশ ভিড় জমতে শুরু করল। ইতিমধ্যে রাজুকে বিদায় জানালাম। ট্রেন এসে পড়ল, আমরা একটি দরজা দিয়ে উঠেও দুদিকে ভাগ হয়ে গেলাম লাগেজ রাখার সুবিধার্থে। আমি একদিকে, অন্য দুজন অন্যদিকে। আমি যেদিকে গেলাম, সেদিকটা বেশ ফাঁকা। আমি দুই সিটের মধ্যে লাগেজ রেখে বসতে যেতেই দুটো মেয়ে আমার শরীর ঘেঁষে পাশের সিটে বসতে গেল।


বেশ স্মার্টই মেয়ে দুটো, স্টেশনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন দেখেছি। আমি নিচু হয়ে লাগেজ সোজা করে রাখার সময় মনে হলো একজনের হাত আমার বুকের ভেতর পাশটার ব্লেজারের পকেটে রাখা ওয়ালেটে ছুঁয়ে গেল। আমি হঠাৎ সোজা হতেই মেয়ে দুটি বারবার জানতে চাইল এখানে বসতে পারবে কি না। আমি বুক করেছি সব সিট! কিন্তু আমি সোজা হওয়ার সময় একটা মেয়ের হাতে কিছু ইউরো দেখতে পেলাম, পরমুহূর্তেই তার হাতে তাকিয়ে দেখি নেই। দ্রুত আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমার মনে পড়ল কলোসিয়াম দেখার সময় রাজু সতর্ক করেছিল যে এখানে অনেক পকেটমার আছে, ট্রেনেও আছে, বিশেষত রোমানিয়ার মেয়েরা পকেটমারায় সিদ্ধহস্ত! এই সুন্দরী মেয়ে দুটি কি পকেটমার! দ্রুত ওয়ালেট বের করে দেখি আমার বাংলাদেশি টাকা আছে, বিমান টিকিট আছে, পাসপোর্টও আছে—ইউরো নেই। ইউরোর পরিমাণটা আমার জন্য কম নয়। আমি বুঝে গেলাম আসলেই এরা পকেটমার এবং আমার ইউরো নিয়ে নিয়েছে। আমি বারবার খুঁজে দেখলাম না, নেই আমার ইউরোগুলো। দেখলাম আমার সিনিয়র অফিসারের একজন লাগেজ নিয়ে এই কামরায় এলেন, সম্ভবত ওপাশে সিট পাননি। আমি মেয়ে দুটিকে বললাম আমার ওয়ালেটে ইউরো ছিল তোমরা নিয়েছ, ওরা না বোঝার ভান করে একে অন্যের দিকে তাকাল। আমি আমার সহকর্মীকে ডেকে বললাম, স্যার এরা পকেটমার, ওরা আমার ইউরো নিয়ে গেছে। আর ওদের দিকে ধমকের মতো বললাম, তোমরা এখানে দাঁড়াও, তোমরা আমার ইউরো চুরি করেছ। ওরা একটু থতমত খেয়ে গেল মনে হলো। আমি আবার ওয়ালেট দেখার চেষ্টা করতেই একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাত দিয়ে আমার কোলের ওপর ইউরোগুলো ফেলল আর আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল তোমার ইউরো পড়ে গেছে। আমি দেখেও অবশ্য না দেখার ভান করলাম। ইউরোগুলো হাতে নিয়ে বার কয়েক গুনে দেখলাম পুরোটাই আছে। আমি ওয়ালেটে রাখতেই ওরা বলল, বুঝেছি এই সিটগুলো তোমার বুকিং করা। আমরা অন্যদিকে যাই, বলেই দুজন কিছুটা খারাপ মন নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।


এত বর্ণনা দিলেও এই ঘটনা ঘটল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। একবার ভাবলাম পুলিশ খুঁজে ধরিয়ে দিই, আবার দেখলাম সে সুযোগ আমার নেই। ফোন নম্বর থাকলে কল করতে পারতাম পুলিশে। অবশ্য এ রকম নাকি প্রায়ই হয়। অনেকেরই টাকা চুরি যায়, আমার পরিচিত একজনেরও বেশ বড় অঙ্কের টাকা হারিয়েছে এভাবে। তাই ওদের চলে যাওয়া দেখলাম, যেন আমার বলার কিছু ছিল না। একটু দূরের সিটে বসে একজন যাত্রী সব দেখেছেন, সম্ভবত ইতালিয়ান। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ওরা আমার সঙ্গের কি না! আমি না বলতেই বললেন ওরা তোমার পিছে পিছে উঠেছে, আমি পেছন থেকে দেখেছি ওরা তোমার কোট ধরে ছিল, আমি ভেবেছি ওরা তোমার লোক! আমি না বলতেই ভদ্রলোক বললেন যে ওরা তাহলে চোর, প্রায়ই এমন চোর মানুষের সর্বনাশ করে। তাঁকে জানালাম যে আমার ইউরো ফেরত দিয়েছে। সহকর্মী জানালেন তিনি পাশে যাওয়ার সময়ও কেউ তাঁর পকেট হাতড়েছে। কিছু অবশ্য পায়নি। জানালাম, স্যার, ওরা আমার টাকা তো ফেরত দিয়ে গেল! স্যার হেসে বললেন, আপনার হালাল টাকা তো, সেই জন্য ওরা নিতে পারেনি!


আমিও হেসে দিয়ে বললাম, তাই বলে ইউরোপের দেশে এসেও এমন বাটপারের খপ্পরে পড়তে হবে, তা তো ভাবিনি!