দুঃসময়ের সাহসী যোদ্ধা

করোনাকালে অনেকেই অনেকভাবে সহায়তা করছেন। দাফনের কাজে সহযোগীরাও তেমনি। ছবি: সংগৃহীত
করোনাকালে অনেকেই অনেকভাবে সহায়তা করছেন। দাফনের কাজে সহযোগীরাও তেমনি। ছবি: সংগৃহীত

মোবারক গুনে গুনে দেখল এইমাত্র যে মৃতদেহটি তারা দাফন করল, সেটা তার জন্য ১৮তম। গত ছয় দিনে মোবারক এবং তার দল সর্বমোট ২৩টি করোনায় আক্রান্ত মৃতদেহ খিলগাঁও তালতলার করোনা নির্ধারিত কবরস্থানে দাফন করেছে। মোবারক এক দিন কাজ করতে পারেনি, তাই বাকি পাঁচটি মৃতদেহ দাফনের ভাগ্য তার হয়নি। হিসাবে দিনে গড়ে তিনটি করে মৃতদেহ দাফন করলেও আজই করেছে সর্বোচ্চ পাঁচটি। বেলা ডুবেছে অনেক আগেই। আজকেই আরও দু-দুটি মৃতদেহ দাফন করার কথা। সর্বশেষ জানাজা করে মোবারক এবং তার দল সবেমাত্র পিপিই খুলে নতুন পিপিই পরিধান করল। 

প্রতিটি মৃতদেহেরই জানাজা পড়ান আকবর আলী। প্রতিবারই জানাজা শেষে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতে গিয়ে আকবর আলী চোখের জলে বুক ভাসান। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিবারই মোবারক আলীর মনে হয়েছে যেন তিনি তাঁর নিজের কোনো নিকটাত্মীয়কেই দাফন করছেন। দাফনকারী দলের বাকি পাঁচ সদস্যের সবারই মোটামুটি একই অবস্থা। এখন অপেক্ষা করছে আরও দুটি মৃতদেহ আসবে, সেই দুটো দাফন করে তবেই না আজকের মতো ছুটি। কিন্তু মোবারকের হাত-পা আর চলছে না। একটুও নড়তে পারছে না সে। হঠাৎ করে হালকা শিশিরভেজা ঘাসের ওপরই মোবারক বসে পড়ে। নিয়ম অনুযায়ী দাফনকারী দলের কেউ কারও কাছাকাছি আসতে পারবে না। শুধু দূর থেকেই কথাবার্তা যা কিছু বলার। এবার মোবারক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। মোবারকের কাছে কেন জানি মনে হয়, গত ছয় দিন সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। লাশ দাফন করতে করতে একরূপ নেশায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ লাশটি দাফনের পর মোবারক আর নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।


একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে মোবারক। ১৮ মার্চ থেকে তার অফিস বন্ধ। বাসায় বসে টুকটাক অফিসের কিছু কাজ করত সে। সেই সময় থেকেই করোনা-আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিদের সৎকারের বিষয়টি মোবারকের নজরে আসে। সবচেয়ে অবাক হয় যেদিন মোবারক পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারে, এক বাবার মৃতদেহ কবরস্থানে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তারই তিন মেয়ে। খবরটি দেখে মোবারক খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে, কী করে এর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে পারবে। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিরই অধিকার রয়েছে তার নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকার পাওয়ার। মোবারক সবচেয়ে কষ্ট পায় যখন দেখে কোনো কোনো মানুষ করোনা আক্রান্ত না হওয়ার পরেও তাদের সঠিকভাবে সৎকার করা হচ্ছে না, তাদের পরিবারের লোকজন দাফন অথবা জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। আবার শুধু মৃত ব্যক্তি নয়, তাদের পরিবার-পরিজনকেও সমাজে ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে। ব্যাপারগুলো মোবারক একদম মেনে নিতে পারেনি। সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে ব্যাপারটাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। পরিশেষে মোবারক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ পরিবহন ও দাফনের দায়িত্বে থাকা আল মারকাজুল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। লাশ দাফনের জন্য নিজেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিয়োগ করতে চায় মোবারক। তখনো মোবারকের বাসায় ব্যাপারটি কেউ জানত না। আল মারকাজুল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কনফার্মেশনের পর ব্যাপারটি বাবাকে জানায়। এ কথা শোনার পর মোবারকের বাবা একরকম বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলেন। মা একেবারেই বেঁকে বসলেন। ভাইবোনদের কেউ রাজি হলেন না। সবার উপদেশ অগ্রাহ্য করেই মোবারক আজ থেকে সাত দিন আগে প্রথম করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফন করতে যান। লাশ দাফন করতে গিয়ে মনের মধ্যে ভয়, শঙ্কা সবকিছুই ছিল। গত কয়েক দিনে সেই ভয় মোটামুটি কেটে গেছে। যদিও মোবারক ইতিমধ্যেই জেনেছে, লাশ দাফনকারী দলের দুই সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কাজেই সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই।


মোবারকের কাছে এই করোনা মোকাবিলায় অংশগ্রহণ তার জীবদ্দশায় জীবনের এক অনেক বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণের শামিল। এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সবাইকেই কোনো না কোনোভাবে যেতে হবে এবং বেঁচে থাকতে হবে। নিজেকে আড়াল করে অথবা লুকিয়ে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না মোবারকের। সেই ছোটবেলা থেকে শুধু মুক্তিযুদ্ধের গল্পই শুনে এসেছে বাবার কাছে। মায়ের কাছে শুনেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। একেকটি গল্প শুনে ভেতরে-ভেতরে আড়ষ্ট হয়েছে মোবারক। কিন্তু এখন চোখের সামনে যা দেখছে, শুনছে, তা কোনো অংশেই সেই যুদ্ধের ভয়াবহতার চেয়ে কম নয়। আর এখনকার যুদ্ধে সম্মুখ সমরে দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলেছে দেশের সব চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, আর্মিসহ অনেকেই। মোবারক ইচ্ছে করলেই ওই পেশাগুলোর কোনোটার সঙ্গেই নিজেকে জড়াতে পারবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে অবহেলিত, বিপজ্জনক লাশ দাফনের লোকগুলোর সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে মোবারক অনেকটাই গর্ব অনুভব করছে। বিশেষ করে যখন হাসপাতালের গেটে মৃতদেহগুলোকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয়, মৃত ব্যক্তির ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকেই দূর থেকে দেখতে এলেও কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, তাদের নিকটজনের শবযাত্রায় শামিল হতে পারে না। তখন মোবারক নিজেকে খুব ধন্য মনে করে। এক একটি লাশ দাফনের সময় মনে হয়, এ যেন তারই আপন কেউ। পরম যত্নে সবাই মিলে শেষকৃত্যের সব কাজ করে। জানাজা পড়ে, মাটি চাপা দিয়ে কবরের অদূরে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করে। দিনের বেলায় হলে কবরস্থানের অনেক দূর থেকে কোনো কোনো মৃত ব্যক্তির স্বজনদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। একেকটি করোনা-আক্রান্ত মানুষ যেন একেকটি হৃদয়বিদারক কাহিনি। দু-দুটি মৃতদেহ দাফনের পর আকবর ভাইয়ের কাছে শুনেছে, তারা ঢাকার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তাদের কোনো পরিজনকে পাওয়া যায়নি বিধায় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করতে হয়েছে। আবার অনেক মৃতদেহই করোনা-আক্রান্ত না হলেও করোনা-আক্রান্ত লোকজনের নির্ধারিত স্থানে দাফন করতে হচ্ছে। পরিজনেরা এটা জানা সত্ত্বেও জানাজায় অথবা দাফনে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।

হঠাৎ করে পিছন থেকে ‘মোবারক’ ডাকে সংবিৎ ফিয়ে পায়। আকবর ভাই যথারীতি ভরাট কণ্ঠে সবার উদ্দেশে বলেন, ‘এই আসো সবাই, লাশ এসে গেছে।’ কোনো ক্লান্তিই মোবারককে আর আটকিয়ে রাখতে পারে না। উঠে পড়ে লাশ দাফনের জন্য। আজকে দাফন শেষ করে হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১২টা বাজবে। মোবারক এবং তার দল লাশ দাফন শেষে মারকাজুল হাসপাতালে ফিরে গোসল সেরে পোশাক পাল্টিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম তো নয়, যেন একেকটা দুঃস্বপ্নের রাত। খাওয়াদাওয়াও হাসপাতালেই সারতে হয়। কারও বাসায় কোনোভাবেই কাউকেই বিরক্ত করা যাবে না। কাউকে বাসায় ফিরতে হলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষ করে যেতে হবে। গত সাত দিনে মোবারক বাসার কারও সঙ্গেই দেখা করতে পারেনি। শুধু টেলিফোনে কয়েকবার মায়ের কান্নাজড়িত কণ্ঠের আকুতি শুনেছে।


কিন্তু মোবারকের কিছুই করার নেই। যে যুদ্ধে সে নেমেছে, সেখান থেকে খুব সহজে ফেরা হবে না। করোনা-আক্রান্ত লাশের দাফন মোবারক এবং তার মতো আরও অনেকের জন্য এখন একটা অনেক বড় দায়িত্ব। ইচ্ছে করলেই সেই দায়িত্বকে অবহেলা করা যাবে না। এ কাজ করতে গিয়ে মোবারকের পরিবারের অনেককেই ওদের বাসার সামনে অথবা রাস্তাঘাটে প্রায়ই লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। তারা হুংকার দিয়ে বলেছে, মোবারক যেন কোনোভাবেই এই মহল্লাতে না ঢোকে। মোবারকের কাছে এসব আর কোনো ব্যাপারই নয়। মোবারক নিজেকে করোনাযুদ্ধের সম্মুখসমরের একজন সক্রিয় যোদ্ধা মনে করে। প্রতিটি লাশ দাফন করার পরে মোনাজাতে আকবর ভাই যেমন কেঁদে কেঁদে আল্লাহকে বলেন, ‘হে আল্লাহ, এই লাশটিই যেন করোনা-আক্রান্ত শেষ লাশ হয়। আমরা আর এই ভার বহন করতে পারছি না। আল্লাহ আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। সমস্ত পৃথিবী থেকে করোনাকে নির্মূল করে দিন।’ মোবারক এই একই দোয়া প্রতিনিয়তই করতে থাকে।


আজকের মতো লাশ দাফন শেষ। এই সময় এই কবরস্থানের দুজন গোরখোদক এসে সামনে দাঁড়ান। আকবর ভাইকে বলেন, ‘ভাইজান, আরও একটা গোর খুঁড়তে অইবো, লাশ আইতাছে।’ এবার সবাই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে আবারও মাটিতে বসে পড়েন।

আরও পড়ুন: