বিমর্ষ সন্ধ্যা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সন্ধ্যা হয়ে এল। বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। সাকি অ্যাসাইনমেন্ট করছে। এডুকেশন অ্যান্ড সাপোর্ট নামে একটা কোর্স করছে সে। আমিও উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের ‘লর্ড অব দ্য ফ্লাইস’ বইটি পড়ছি আর মাঝেমধ্যে চায়ে চুমুক দিচ্ছি।

স্যান্টিনিয়্যাল পার্কের ওপর দিয়ে দেখা যায় সিডনি টাওয়ার। হিল ডিস্ট্রিক্টের দিগন্তছোঁয়া শান্ত নিবিড় পাহাড়। বিচিত্র রঙের মেঘের ভেতর দিয়ে ডুবন্ত সূর্যের নরম আলো বিছিয়ে পড়েছে পার্কের ঘন সবুজ গাছে। এসবের মধ্যে আমার আমি। ভালো লাগছে। তাই আমাদের মধ্যে তেমন কথা হচ্ছে না। ঠিক তখনই উদ্‌ভ্রান্তের মতো নিরেনের উদয়।

কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে লাল চোখ দুটো বড় করে সাকির দিকে চেয়ে আছে।


কী রে নিরেন, কী খবর? কোত্থেকে এলি এখন?


আমার দিকে রূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বলে, সাকি ভাবির কি কোনো বোন আছে?

নিরেনের মুখ থেকে উৎকট গন্ধ বেরোচ্ছে।


এই দোস্ত, তুই এসব কী বলছিস? ভাবির সঙ্গে আবার বুঝি ঝগড়া করেছিস? আয়, ভেতরে আয়।


ও হে, সাকি ভাবি তো একমাত্র মেয়ে। কোনো বোন-টোন নেই। তাই তো বলেছিস। ঠিক আছে। আমি ভাবিকেই বিয়ে করব। সাকিকে আমি চাই-ই চাই।
এই গাধা, চুপ কর! কী সব পচা কেরোসিন খেয়ে এসে এখন আবোলতাবোল বকছিস।


নিরেনকে জোর করে ধরে ভেতরে এনে লাইব্রেরি রুমে শুইয়ে দিয়ে বললাম, হইচই করিস না। কিছুক্ষণ ঘুমোতে চেষ্টা কর।
নিরেন কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে বটে। আজ খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছে। সাকি কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। বেডরুমে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিয়েছে। নক করে আস্তে আস্তে ডাকছি...। দরজা খুলতেই দেখি বেচারি বেশ নার্ভাস।


কাঁপাকাঁপির কিছু নেই। স্বাভাবিক থাকো।
নিরেন ভাইয়ের কী হইছে?


কী আর হবে, মনে হয় ভাবির সঙ্গে ঝগড়া করেছে। কেরোসিন খেয়ে টাল হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।
ওদের স্বামী-স্ত্রীতে মাঝেমধ্যে ঝগড়া হয়। ওই ঝগড়ায় ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বিবেচনা থাকে না। কেবল হেরে যায় নিরেন। দুজনই নালিশ করে আমার কাছে। আমি উপায়ান্তর না দেখে মহামানবদের দু-একটা বাণী শুনিয়ে দুজনকে মিলেমিশে চলার উপদেশ দিয়ে চলে আসি। কারণ, আমি ভালো করেই জানি, ন্যায়কে ধারণ করার মতো অবস্থা এই দম্পতির নেই। ঘণ্টাখানেক পর লাইব্রেরি রুমের দরজাটা আস্তে করে খুলে দেখি, নিরেন বেহুঁশ ঘুমে। এরই মধ্যে আমাদের ডিনার শেষ হয়।


বেডরুমে বসে সাকি অ্যাসাইনমেন্ট করেই যাচ্ছে; এদিকে আমি ড্রয়িংয়ে বসে বইটা পড়ছি, পাশাপাশি লিখছি।
রাত ১০টার দিকে নিরেন আস্তে করে ড্রয়িংয়ে এসে আমার সামনে বসে।
কী রে, ঘুম ভাঙল?
হুম।
যখন-তখন পাবে যাওয়া...। এত কেরোসিন কেন খাস?
খাই, কিছুক্ষণ নিজেকে ভুলে থাকা যায়। ভালো লাগে।
এই অসুস্থ ভালো লাগা কি তোকে মানায়?


নিরেন প্রসঙ্গ আড়াল করে বলে, দোস্ত, তোর বাবা মৃত্যুর আগে যে ছয় মাস অসুস্থ ছিলেন, তখন আংকেলকে দেখাশোনা কে করেছে?
আরে, এ কথা এখন কেন? তুই কেমন আছিস, তাই বল।
না, বল।
এই তো, ছিল তো সবাই। তোর ভাবি সাকিই সার্বক্ষণিক বাবার সঙ্গে ছিল।
আর খালাম্মা?


আর বলিস না, তুই তো দেখেছিস। এখানে আমাদের সঙ্গে কত যত্নে ছিল। দুই বছর থাকার পর চলে গেল দেশে। দেশের জন্য নাকি মন কাঁদে। এখন আবার আসতে চাচ্ছে। দেশে কী করে থাকবে, বল। কেউ নেই তো। অ্যাপ্লাই করে দিয়েছি। ভিসাটা হয়ে গেলেই মাকে নিয়ে আসব। আমি একা গেলে হবে না। সাকিকে নিয়ে যেতে হবে, নইলে আসবে না। কী সব কাণ্ড। আর বলিস না। একবারে বাচ্চার মতো আচরণ।
আচ্ছা দোস্ত, তোর মনে কি কোনো কষ্ট আছে?


হুম, নাহ্! তেমন বড় কোনো কষ্ট নেই তো। এই তো ভালো আছি।
নিরেন চিৎকার করে ওঠে, তুই ভালো আছিস কেন? কেন এত হাসিখুশি তোরা!
আরে, আস্তে বল। রাত সাড়ে ১০টা বাজে। পাশের বাড়ির লোকজন তো পুলিশে কল করে দেবে।


সাকি বেডরুমের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিতেই ওকে ভেতরে যেতে ইশারা করি। সাকি ভেতরে গিয়ে আবার দরজা লক করে দেয়।
হঠাৎ খেয়াল করে দেখি, নিরেনের দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। জড়ানো গলায় বলে, আমার বাবা বলতে গেলে অযত্নে-অবহেলায় বাড়িতে পড়েই মারা গেছে। আমরা কেউ পাশে ছিলাম না। তারপর থেকে মা অরক্ষিত অবস্থায়। মা যে এত অসুস্থ...
বলিস কী! চিকিৎসা...


হ্যাঁ, চিকিৎসক তো আছেই। আমার ফুফাতো ভাই-ই তো চিকিৎসক। মায়ের সার্বক্ষণিক সুপারভিশন, পাশাপাশি ডিজোপেন ট্যাবলেটটা কন্টিনিউ করতে বলেছিল।
আহা, এই শেষ বয়সে একা থাকা। খুব কষ্ট। আরে, একা থাকলে তো আমি নিজেও পাগল হয়ে যাই। এক কাজ কর, দোস্ত। আন্টিকে নিয়ে আয়। তুই তো খুব ব্যস্ত থাকিস। কাগজপত্রগুলো আমাকে দে, এখনই অ্যাপ্লাই করে দিই। মাকে যখন আনতে যাব, আন্টিকেও নিয়ে আসব।
অ্যাপ্লাই করবি। মাকে নিয়ে আসবি। তুই বললেই হবে?


মানে? তোর শ্বশুর-শাশুড়ি তো তোদের সঙ্গে আছে আজ প্রায় চার বছর ধরে। আন্টি দোষ করল কী?
চোখমুখ লাল করে নিরেন আবার চেঁচিয়ে ওঠে, আমার মায়ের অনেক দোষ, অনেক দোষ। মাকে শুধু আমিই মা ডাকি। আর কেউ না। ওই মহিলা মরে না কেন। এটাই তার দোষ!
বলেই নিরেন উঠে দাঁড়ায়। ওর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে।


বিষয়টা বুঝতে আর বাকি রইল না। এটা আমাদের ঐতিহ্যগত সমস্যা। ‘পথের পাঁচালী’র ইন্দিরা ঠাকরুণ চরিত্রটা দেখে বহুবার কেঁদেছি। অস্ট্রেলিয়াতেও এমন আছে। তবে এ দেশে রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা অনেক। তাই এখানে শেষ বয়সে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও আর্থিক সংকট না থাকলেও সামাজিক দারিদ্র্য আছে। এই যেমন একাকিত্ব আর আপনজন থেকে দূরে থাকা। সুস্বাস্থ্য নিয়ে একটা মানুষ ৫০-৬০ বছর বয়সে হঠাৎ মরে গেলে এ সমস্যায় পড়তে হয় না। বেঁচে থাকলে একদিন বুড়ো হতেই হবে। তাই আমার জীবনের পরিকল্পনা, এ রকম মন উজাড় করে মানুষকে ভালোবাসব; আদর করব, সম্মান করব। সাধ্যমতো মানুষের উপকার করব। না পারলে সরি বলব। এর বাইরে আর কিছু বুঝব না, জানবও না। এড়িয়ে চলব সব ঝামেলা। মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে ভালোবাসা। মানুষের প্রতি যদি আমার ভালোবাসা থাকে, শেষ বয়সটা আমার আনন্দময় হতেও পারে।
আচ্ছা বস, কথা শোন।


তুই চুপ থাক। আমার কথা শোন। ভাবিকে তুই কোথায় পেলি? আমাকে ভাবির মতো একটা মেয়ে খুঁজে দে।
ওর এসব বকবকানি মোটেই ভালো লাগছে না। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এই! তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব খিদা নিয়ে বসে আছিস। কিছু যদি খেতে চাস খা। নইলে চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি।
নিরেন জড়ানো কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ খাব, তবে বাসায় যাব না। আমার আর কিচ্ছু দরকার নেই।
আবার এলোমেলো কথা শুরু করলি!


না রে, দোস্ত। এলোমেলো কথা নয়। একদম সত্যি বলছি। আজ সকাল সাতটায় দেশ থেকে একটা দুঃসংবাদ এসেছে।
দুঃসংবাদ, বলিস কী! কী হয়েছে রে?
চোখ মুছতে মুছতে নিরেন কী যেন বলতে চেয়ে আর পারছে না। বারবার গলা আটকে যাচ্ছে।