মধ্যবিত্ত

মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের মধ্যে আবার তিনটা শ্রেণি আছে। উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। শায়েরদের পরিবারকে আসলে কোনো শ্রেণিতে সঠিকভাবে ফেলা যায় না। বস্তুত, ওদের পরিবারের অবস্থানটা ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গায়।
শায়ের তখন অনেক ছোট, প্রাইমারি স্কুলের কোনো এক ক্লাসে পড়ে। এর মধ্যে একদিন স্কুল থেকে আসার পর দেখা গেল শায়েরের উৎসাহ-উদ্দীপনার যেন আর শেষ নেই। কারণ শায়েরদের ঘরে আজ একটা নতুন ফ্রিজ আসবে। শায়েরদের পরিবারের জন্য এটা অনেক আনন্দের একটা ব্যাপার। যদিও ফ্রিজ কেনার পেছনের ইতিহাস ও কারণটা খুবই বিচিত্র।
ইতিহাসটা দিয়েই শুরু করি। শায়েরের বাবার বয়স হয়ে গিয়েছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একদিকে যেমন বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের উপদ্রব বাড়ছিল, অন্যদিকে তেমনি মোটরসাইকেল চালিয়ে দাবড়ে বেড়ানোর ক্ষমতা ও আগ্রহ দুটোই দিনকে দিন কমে আসছিল। তাই শায়েরের বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন এবার তিনি মোটরসাইকেলটা বিক্রিই করে দেবেন। শায়েরের মায়ের পরামর্শে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মোটরসাইকেল বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি তাঁর পরিবারের জন্য একটা সস্তা দামের ফ্রিজ কিনে আনবেন।
এবার ফ্রিজ কেনা সিদ্ধান্তের পেছনের কারণটা বলি। ফ্রিজ কেনার ভাবনাটা মূলত শায়েরের মায়ের। তবে ভাবনাটা কোনো ধরনের বিলাসিতা থেকে নয় কিংবা উচ্ছিষ্ট খাবার অকারণে সামলে রাখার উদ্দেশ্যেও নয়। শায়েরদের পরিবারের তৎকালীন অর্থনৈতিক অবস্থান যেহেতু নিম্ন মধ্যবিত্তের সামান্য ওপরে ছিল, তাই তখনকার দিনে হঠাৎ করে কোনো মেহমান এলে, অতিথি আপ্যায়নের জন্য চটজলদি বাজারে গিয়ে খুব আয়েশি খরচা করার মতো স্বাধীনতা তাদের ছিল না। শায়েরের মা অনেক চিন্তা করে বের করলেন, ঘরে যদি একটা ফ্রিজ থাকে, তাহলে মেহমানের সামনে মধ্যবিত্ত পরিবারের ইজ্জত রক্ষা করাটা তাঁর জন্য কিছুটা সহজ হবে। হাতে যখন টাকা থাকবে, তখন কিছুটা উন্নতমানের আমিষ কিনে ফ্রিজে রেখে দিতে পারবেন। মাসের অন্যদিনগুলো এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। ফ্রিজে রাখা আমিষ খাবারগুলো তার সন্তানদের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য নয়। তার মধ্যবিত্ত পরিবারের ইজ্জত রক্ষার সংগ্রামে ঢাল হিসেবেই ব্যবহার করবেন।
শায়েরের বাবা শহর থেকে ফ্রিজটা কিনে ঠেলা ভ্যান দিয়ে সেটাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেল। শায়ের সেদিন রাতে ঘুমাচ্ছিল না। মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে শুধু কথাই বলে যাচ্ছিল। ‘জানো মা, আমার বন্ধুরা বলেছে, নিজেদের ঘরে ফ্রিজ থাকলে অনেক মজা। সিভিটার জুস পাউডার পানিতে গুলে ফ্রিজে রেখে দিলে নাকি আইসক্রিম হয়ে যায়। তুমি কিন্তু আমাকে রোজ আইসক্রিম দেবে। ভাংতি টাকা হাতে নেই বলে আর না করতে পারবে না। দিবে না মা? প্রতিদিন আমাকে একটা করে আইসক্রিম? আমি তোমার সব কথা শুনব, সব হোমওয়ার্ক করব, বলো মা দেবে না?’
শায়েরে মা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন আর মনে মনে ভাবছিলেন, ছোট্ট শায়েরকে তিনি কীভাবে বোঝাবেন, সীমিত আয়ের পরিবারে প্রতিদিন একটা করে আইসক্রিম বানানোর জন্য যতটুকু সিভিটা জুস পাউডার অতিরিক্ত লাগবে, সেটা কেনার মত মুরোদ তাঁর পরিবারের নেই। তবে মা শায়েরকে কোনো মিথ্যা আশ্বাস দিতে চান না। আবার অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথা শুনিয়ে ছোট্ট শায়েরের মনোবলটা নষ্ট করতেও চান না।
শায়ের কথা বলেই যাচ্ছে। ‘বাবা তো তাঁর মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তো আমি হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যাওয়া-আসা করি। অনেক ক্লান্ত লাগে মা। তুমি যদি স্কুল থেকে আসার পর একটা আইসক্রিম দাও, তাহলে আমার আর কোনো ক্লান্তি থাকবে না। বলো মা, দেবে না আইসক্রিম?’
মা তখন খুব ঠান্ডা গলায় বলতে শুরু করলেন। ‘বাবু আমার, তুমি আইসক্রিম খুব পছন্দ করো, তাই না সোনা? আমি তোমাকে আইসক্রিম দেব। তবে আমার কথাগুলো তুমি মন দিয়ে শোনো। তুমি যে সিভিটা জুস পাউডার দিয়ে আইসক্রিম বানানোর কথা বলছ, সেই সিভিটা জুস পাউডার বানাতে কি লাগে জানো? চিনি লাগে আর রং লাগে। রং যেহেতু স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না, তাহলে আমরা শুধু চিনি দিয়েই তো আইসক্রিম বানাতে পারি, তাই না? আর প্রতিদিন একটা করে আইসক্রিম খাওয়াও তো ঠিক না বাবা। দুটো কারণ আছে। প্রতিদিন আইসক্রিম খেলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে; সর্দি-কাশি হয়ে যাবে। আর যেহেতু আইসক্রিম তোমার অনেক পছন্দের, তাই প্রতিদিন আইসক্রিম খেতে নেই। প্রতিদিন খেলে ধীরে ধীরে আইসক্রিমের প্রতি তোমার রুচি নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি আর তখন আইসক্রিম খেতেই পারবে না। তুমি নিশ্চয়ই চাও না যে, তোমার আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ হয়ে যাক। তাই না বাবা? তাই আমি এক কাজ করব; সপ্তাহের ছুটির দিনে পানিতে কিছু চিনি গুলে আইসক্রিম বানাব এবং শুধু তোমার জন্য না, তোমার ভাইয়া আর দিদির জন্যও আইসক্রিম বানিয়ে দেব। তোমরা সবাই মিলে একসঙ্গে খেলে অনেক মজা হবে, তাই না বাবু?’ শায়ের সম্মতিতে শুধু ‘হুঁ’ বলল এবং মায়ের কথায় খুব আশ্বস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
চিনি গুলানো পানির বরফ হয়ে যাওয়া আইসক্রিমটা তিন ভাইবোন মিলে খুব আয়েশ করে খেলেও, ফ্রিজের প্রতি শায়েরের বিরক্তি আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই। একদিন বিকেলে শায়েরদের বাড়িতে দুজন মেহমান এলেন। তাঁরা সন্ধ্যার পরপর চলে যাবেন বলেই শায়েরের মা আর দিদি মিলে ফ্রিজে রাখা আমিষগুলো বের করে খুব তড়িঘড়ি করে সব রান্না করলেন। শায়ের তার দিদির সাথে লেগে ছিল দেখার জন্য; কিভাবে ফ্রিজ থেকে বের করা মাছ মাংসগুলো গলানো হচ্ছে, কাটা হচ্ছে, মসলা দেওয়া হচ্ছে...। শায়েরের আগ্রহের কোনো শেষ ছিল না সেদিন। শায়েরের দিদির রান্নার হাত খুব ভালো ছিল। মা অন্য সব কিছু করলেও, গরুর মাংসের ভুনাটা শায়েরের দিদি রান্না করেছিল। ভুনার গন্ধে পুরো রান্নাঘর একদম মউমউ করছিল। শায়েরের পেটে যেন তেলাপোকা কেটে গেল, জিবে পানি এসে যাচ্ছিল। আর মনে মনে ভাবছিল মেহমানরা খাবার পর যা থাকবে, তা নিশ্চয়ই ওরা রাতের বেলা ভাগাভাগি করে খাবে। শায়ের মনে মনে ঠিক করল সে আর অন্য কিছু নেবে না, শুধু দিদির হাতের রান্না করা গরু মাংসের ভুনা দিয়েই পেট পুরে খাবে।
সন্ধ্যার সময় মেহমানরা খেয়ে নিলেন। মেহমান বিদায়ের পর ঘরের সবাই মিলে বিটিভির সাপ্তাহিক নাটক দেখতে বসল। কিন্তু শায়েরের মনে খেলা করে যাচ্ছিল গরুর মাংস ভুনার সেই ঘ্রাণ। নাটক দেখা শেষ হলে রীতিমতো সবার ডাক পড়ল খাবার টেবিলে। শায়ের তো প্রায় উড়াল দিয়েই এল খাবার ঘরে। এসেই যে বিপত্তিকর পরিস্থিতি দেখল, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না শায়ের। খাবার টেবিলের নিত্যদিনের আয়োজনের বাইরের সেই মাংস ভুনাটা নেই। সবাই যখন নাটক দেখছিল তার ফাঁকে শায়েরের মা মাংস ভুনাটাকে ঘাতক ফ্রিজের ভেতরে রেখে দিয়েছিলেন। অভিমানী শায়ের তার দিদিকে শুধু প্রশ্ন করেছিল, ‘আর কিছু নেই আজকে?’ দিদি চুপ করেছিল। প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। শায়ের সেদিন আর একটা কথাও বলেনি খাবার টেবিলে বসে।
শায়েরের মা জানতেন দুদিন পরে আবার মেহমান আসবে। ইজ্জত রক্ষা করার তাগিদে, বেঁচে যাওয়া ভুনা মাংসটুকু তাঁকে সংরক্ষণ করে রাখতেই হবে। শিশু ছেলের সব আবদার পূরণের ক্ষমতা তাঁর মতো মায়েদের থাকে না। এশার নামাজের পর মা জায়নামাজে বসে বসে চোখের পানি লুকিয়ে লুকিয়ে মুছেই যাচ্ছিলেন...
গোথেনবার্গে আসার পর প্রথম চার দিন শায়ের নিজের জন্য রান্না করার সুযোগ পায়নি। বিদেশি খাবার খেয়েই কাটিয়ে দিল প্রথম ছুটির দিনের আগ পর্যন্ত। ছুটির দিন সকালবেলা শায়ের বাজার করতে যাচ্ছে আর ভাবছে, আজকে সে তার পছন্দের সব খাবার রান্না করবে। তারপর তৃপ্তির ভূরিভোজ দিয়েই সে নতুন শহরটাকে দেখতে বের হবে। শায়ের হাঁটছে আর মনে করার চেষ্টা করছে। আচ্ছা, তার পছন্দের কোন খাবারটা সে আজকে রান্না করবে? তার সবচেয়ে পছন্দের খাবারটা কি? কোন পছন্দের খাবারটা সে অনেক দিন ধরে খায়নি? এসব ভাবতেই তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার দিদির হাতে রান্না করা সেই গরু মাংসের ভুনা, আর ছোটবেলার সেই বেয়াড়া ফ্রিজের নিষ্ঠুরতার কথা। গোথেনবার্গ যাওয়ার প্রায় চার বছর আগেই, অসুখের কারণে ডাক্তারবাবু শায়েরকে কড়া করে নিষেধ করে দিয়েছেন। ‘রেড মিট’ খাওয়া একদমই চলবে না।
দিদির হাতের রান্না করা গরু মাংসের ভুনা দিয়ে ভূরিভোজের উপলক্ষ শায়েরের জন্য অনাগতই থেকে যাবে আজীবন ...।