থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে ৭

কানাডার সাসকাচুয়ান নদী। ছবি: লেখক
কানাডার সাসকাচুয়ান নদী। ছবি: লেখক

ছোট শহর সাস্কাতুন। বাড়িঘরগুলো অনেক জায়গাজুড়ে তুলিতে আঁকা ছবির নরম রং মেখে নৈঃশব্দ্য নিয়ে চুপচাপ একাকী দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটা বাদামি তো কোনোটা গোলাপি, কিংবা আকাশ নীল। সাজানো–গোছানো বাড়ির আঙিনায় নানা জাতের ফুল নিমগ্ন ঘুমে ব্যস্ত। বাড়ির কোনায় লাগানো চেরি ফুল গাছের রং বদলাচ্ছে একটু একটু করে। ঝোপাল গোলাপের ডালপালায় যেন প্রজাপতি রং লাগার অপেক্ষা। এখনো তাদের সময় হয়নি চোখ মেলে তাকানোর। ২০ মার্চ। এপ্রিলে বসন্ত আসার অফিশিয়াল তারিখ।

ছিমছাম ছোট শহরটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে শান্ত, টলমলে জলভরা একটি নদী। নদীর নাম সাসকাচুয়ান রিভার। শীতকালে সাদা বরফের আস্তরণে ঢাকা থাকে নদী। আকাশের নীল এসে পড়ে সেই বরফনদীতে। নীল অপরাজিতা ফুলের মতো নীলাভ ছটায় মাঝেমধ্যে ঝলকে ওঠে, শাড়ির আঁচলের ফাঁকে লুকানো চুমকির ঝিলিমিলি রূপে। নিস্তব্ধ বরফভাসা নদীতে ফিরছে পাখির ঝাঁক। পাখির কলরবে নৈঃশব্দ্য ভেঙে শোনা যায় কখনো পাখির প্রাণবন্ত কলরব।

খুব বেশি জনবসতি নেই। এখানে জনসংখ্যা তিন লাখের কাছাকাছি। বড় বড় আকাশছোঁয়া অট্টালিকাও নেই। আছে হাতে গোনা কয়েকটি উঁচু দালান। ভীষণ নিরিবিলি, শান্ত নদীটির মতোই চুপচাপ শহর। শহরের পাড়ায় পাড়ায় স্কুল। এরা বলে নেইবারহুড। সকালবেলায় বাচ্চাদের কলকাকলিতে মুখর থাকে পাড়াগুলো। এ সময় সবাই খুব সাবধানে গাড়ি চালায়।

বসন্ত আসবে আসবে করেও আসছে না। কিন্তু দুপুরে রাস্তায় বরফ গলে গলে রাস্তার দুই পাশে পানি থইথই করছে। সেই পানিতে ধুলাবালু জমে কালো কুৎসিত রং ধারণ করেছে। সেই পানি ছিটকে পড়ছিল গাড়ির কাচে। এইট স্ট্রিট ধরে গাড়ি চলছিল মন্থরগতিতে। এই রাস্তা লম্বা সাপের মতো সোজা গিয়ে মিলেছে পূর্ব পাড়ের নদীর ব্রিজে। অনেক ব্রিজ নদীর ওপর দিয়ে পূর্ব আর পশ্চিম দুই ভাগে ভাগ করেছে শহরটিকে। পশ্চিম ভাগে থাকে মূলত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা। এখন বেশ কিছু অভিবাসীও বসতি গেড়েছে পশ্চিমে। এ দেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা মূলত গরিব। বেশির ভাগ সরকারি অনুদানেই চলে তারা। একসঙ্গে থাকতে ভালোবাসে, যৌথ পরিবার বলতে আমরা যা বুঝি এরা তাই।

আজ মার্চের ২০ তারিখ আমাদের শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ, এই শহরে কয়েক দিন আগেই কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া গেছে। এরপর হঠাৎ করেই যেন শহরটা থমকে গেছে।

যাঁরা বাসায় বসে কাজ করতে পারবেন, তাঁদের বাসায় বসেই কাজ করতে বলা হয়েছে। আমার কর্মক্ষেত্রে আজই শেষ দিন। এরপর ছুটি। কিছুটা অনিশ্চয়তা, কিছুটা আশঙ্কা নিয়েই যাচ্ছি আমি। বেতন পাব কি না, কত দিনের পাব, বাসায় বসে কী কাজ করতে হবে, অনেক কিছু নিয়েই অনিশ্চয়তা।

আজ আমাদের স্টাফ মিটিং। অন্য সময় মিটিংয়ে চা-নাশতা খাওয়ানো হয়। কিন্তু আজ দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ। সব সময়ই গ্রীষ্মকালীন বন্ধের আগে স্কুলের সবাইকে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়। কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছুই আজ উল্টে গেছে।

স্কুলটা হঠাৎ করেই নিষ্প্রাণ লাগছে। কী ভীষণ সুনসান নীরবতা। আজ কোনো ছাত্রই আসেনি। স্কুলের রাঁধুনি বিয়ানা টেবিল সাজাচ্ছিল। প্রিন্সিপাল তাকে সাহায্য করতে করতে হাসছে। বিয়ানার বয়স ২৭ থেকে ২৮ হবে। ভীষণ সুন্দরী আর মুডি মেয়ে। যখন ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে চুল পরিপাটি করে জিনস স্কার্ট পরে, কালো হিল জুতার সঙ্গে ওকে অসাধারণ লাগে। চোখ ফেরানো যায় না। এত রূপবতী, সে কারণেই কি না জানি না, মাঝেমধ্যে আমাদের দেখেও না দেখার ভান করে। আজ কী চমৎকার হাসি হাসি মুখ। প্রিন্সিপাল যেন তার ফ্রেন্ড, ভাবখানা এমন।

সোশ্যাল ডিসট্যান্স শুরুর কথা বলা হচ্ছে। সে কারণেই জিমে (Jym) ছয় ফুট দূরে চেয়ার–টেবিল পাতা হয়েছে। রাঁধুনি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, প্রিন্সিপাল—সবাই একসঙ্গে বসে খাবার খায়, এটাই নিয়ম এখানে। এ দেশে কাজের ক্ষেত্রে উঁচু-নিচু, জাতপাত দেখা হয় না। সব কাজেরই সমান মর্যাদা। সব কাজই সম্মানের। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। আমি ফাঁকা একটি টেবিলে বসলাম। আমার যেহেতু ঠান্ডা–কফ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই ভালো। আমার টেবিলের আরেক কোনায় এসে বসলেন প্রিন্সিপাল। আমি শুধু একটু সবজি নিয়েছি। কাটা চামচে একটু মুখে পুরতেই তিনি হেসে বললেন, তোমাকে কদিন দেখিনি, অসুস্থ শুনলাম। কী হয়েছিল?

একটু কাশি ছিল। এখন অবশ্য ভালো আছি।

সাসকাচুয়ানের বিস্তৃত আকাশ। ছবি: লেখক
সাসকাচুয়ানের বিস্তৃত আকাশ। ছবি: লেখক

তিনি একটু চমকালেন যেন। আমি একটু জড়সড় হয়ে বসলাম। এই হয়েছে এক যন্ত্রণা। জ্বর কিংবা কাশির কথা শুনলেই লোকজন ভাবে, করোনা নয় তো? এক সপ্তাহ ধরে লোকজনের সামনে গেলেই ভয়ে থাকি, কখন না আবার কাশি চলে আসে। পানি খেলে কাশি বন্ধ হয়। একটা পানির বোতল নিয়েছি, গলা খুসখুস করলেই গলায় ঢেলে দেব।

স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জুন পর্যন্ত সবাইকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পুরো বেতনই দেবে। শর্ত হচ্ছে বাসায় থাকতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে। বাসায় বসে শুধু কিছু প্রশিক্ষণ নিতে হবে, পাঠদান পরিকল্পনা ইত্যাদি কিছু কাজ করতে হবে। সবাইকে প্রতি সপ্তাহে জানানো হবে, কী হচ্ছে পরবর্তী সরকারি নির্দেশনা।

মিটিংয়ের মধ্যে রোদেলার ফোন, আমি দৌড়ে হলওয়েতে গেলাম।

সে বেশ অস্থির কণ্ঠেই বলল, মা, আমি চলে আসব। বাবাকে বলো আজকেই টিকিট কাটতে। কারণ, টিকিটের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

কত দাম?

৬০০ ডলার দেখলাম।

আসা-যাওয়া?

না মা, শুধু আসা। ওয়ান ওয়ে।
কী বলো?

৬০০ ডলার দিয়ে তো যাওয়া-আসা যায়।

ঠিক বলেছ মা। দাম আরও বাড়বে। এয়ারলাইনস এই সুযোগে ব্যবসা করবে। তোমরা কিন্তু যত তাড়াতাড়ি পারো টিকিট কাটবে। পারলে আজকেই কাটো।

বছরে তিনটা বড় ছুটিতে মেয়ে আসে আমাদের কাছে। এবার ফেব্রুয়ারির ছুটিতে আসেনি। কারণ, দেরিতে টিকিট কাটতে গিয়ে দেখা গেল টিকিটের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

সে–ই বেঁকে বসল, না, সাত দিনের জন্য ১ হাজার ২০০ ডলার খরচ করে আসব না।

এসব শুনে ওর বাবা ভীষণ গাঁইগুঁই করল, আশা করেছিলাম মেয়েটা আসবে। দেখা হয় না দুই মাস।

আমি তাকে তেমন পাত্তা দিলাম না। মেয়ে তো ঠিকই বলেছে, সাত দিনের জন্য ১ হাজার ২০০ ডলার মানে অনেক টাকা। কানাডীয় বিমান ছাত্রদের ছুটির সময় আকাশচুম্বী করে টিকিটের দাম। এত নিয়মের দেশে এটা কী অনিয়ম না? বড় বড় ব্যবসায়ীদের পৃথিবীর সব দেশই তোষামোদ করে। এয়ারলাইনসের এসব বাণিজ্য করায় কেউ গা লাগায় না।

তিন মাস পর আমাদের ভালোবাসার ধন, একমাত্র মেয়ে আসছে, মনটা ভালো লাগারই কথা। কিন্তু আজ কিছুতেই আনন্দ হচ্ছে না। শুধু তো আমি নই, এর আগে স্কুল বন্ধ হওয়ার দিন সবাই ভীষণ রকম আনন্দিত হতো। আজ অন্য রকম দিন, অন্য রকম পৃথিবীতে।

সাসকাচুয়ান নদীর তীরে ভাই–বোনের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
সাসকাচুয়ান নদীর তীরে ভাই–বোনের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

সবাইকে বিদায় বলে অজস্র দম বন্ধ করা সময়কে সঙ্গে নিয়ে বাসায় এলাম। ২০ মার্চ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস বন্ধ। হয়তো সেপ্টেম্বরে খুলবে স্কুল। কাজ না করে বেতন পাওয়া যাবে তাই থাকা–খাওয়ার সমস্যা নেই, কানাডায় চিকিৎসা ফ্রি, কাজের জায়গা থেকে ইনস্যুরেন্স আছে, অসুস্থ হলে ওষুধ কিনতে পারব, বড় হাসপাতাল আছে।

বারবার মনে হচ্ছিল, মানুষ কিন্তু শুধু একা ভালো থাকতে চায় না। তার আশপাশে সবাইকে সঙ্গে নিয়েই সুস্থ জীবন কাটাতে চায়। আমি তো তার ব্যতিক্রম নই। জীবনের এত নিশ্চয়তা নিয়েও ভয়ংকর এক শঙ্কায় সবকিছুই অর্থহীন মনে হচ্ছে। কোভিড নামের মস্তিষ্কবিহীন অণুজীবটি এতই ভয়ংকর যে সে অনায়াসে ধ্বংস করে দিচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। বিশ্বজুড়ে প্রলয় সৃষ্টি করেছে এই আণুবীক্ষণিক জীব করোনাভাইরাস। গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মানবজাতির সভ্যতা ও বিজ্ঞানের দম্ভ। কোনো ওষুধ নেই, প্রতিষেধক নেই। শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা। চাপ চাপ ভয় গলা থেকে পেটের দিকে চলে যাচ্ছে। বুকের ভেতর চেতনহীন বোধ তৈরি হলো। হয়তো মৃত্যুর শঙ্কা এমনই হয়। মানুষের মৃত্যুভয় সবকিছুই অসাড় করে দেয়। ভীষণ দমবন্ধ লাগে।

বাসার দরজা খুলেই দেখি, ঘরের পশ্চিমের জানালায় বিকেলের মিষ্টি রোদ। সেই রোদ ছুঁয়ে দিতে চাইলাম, রৌদ্র মুঠোয় নিয়ে মনে হলো এত হতাশ হওয়ার কী আছে? মানুষ এখন কত কিছু পারে, আর একটা করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার, সে আর কী কঠিন, এই তো এল বলে।

আমি বাস্তববাদী মানুষ, বিজ্ঞানে আমার অগাধ বিশ্বাস। বিজ্ঞান অত্যন্ত শক্তিশালী, তাই বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রা এগিয়েই যাবে। ইবোলা, জলবসন্ত, কলেরার মতো মহামারি তো বিজ্ঞানের কল্যাণেই জয় করা সম্ভব হয়েছে। করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স বের করতে বিজ্ঞানীরা সময় নিয়েছেন মাত্র দুই সপ্তাহ। বিজ্ঞান যখন কারণ বুঝতে পারে, তখন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সহজ হয়ে যায়। হয়তো শিগগিরই আলোঝরা এক ভোরে ঘুম ভেঙে শুনব, আজ থেকে করোনার টিকা দেওয়া হবে, সবাই চলে আসুন। চলবে....