ফরমোজা প্রণালির তীর থেকে

থার্মালে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
থার্মালে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

জুনান শহরের এক প্রান্তে পাহাড়বেষ্টিত চোখজুড়ানো এলাকায় ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এখন থেকে যাচ্ছি চংলি শহরে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে সেমিনারে যোগ দিতে। যাত্রা ট্রেনে।


ট্রেনের এই যাত্রাপথে এক পাশে ফারমোজা প্রণালি, যা তাইওয়ানকে চীন থেকে পৃথক করেছে। অন্য পাশে বিশাল সব পাহাড়। ট্রেনের জানালা দিয়ে সাগরের তীরে সারি সারি ঘূর্ণমান বায়ুকল দেখতে দেখতে ভাবছিলাম প্রিয় দেশের কথা। অজানা আতঙ্কে দেশের সাধারণ জনমানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন যখন এলোমেলো, তখন তাইওয়ানের সবকিছুই প্রায় আগের মতোই সচল।


আমাদের দেশে যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অজানা সময়ের জন্য বন্ধ, তখন এ দেশে স্কুল-কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস-পরীক্ষা, খেলাধুলা সবকিছুই হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনীতির চাকা যেখানে স্থির হয়ে গেছে, তখন এখানে প্রায় আগের মতোই সরকারি কিংবা বেসরকারি কলকারখানা, অফিস, সুপারশপ, গণপরিবহনব্যবস্থা সচল। বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো তাইওয়ান করোনাভাইরাসকে চীন সাগরে আটকে রাখতে পেরেছে বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে।


আজকের এই অবস্থায় আসার জন্য তাইওয়ানকে করতে হয়েছে অনেক পরিশ্রম এবং নিতে হয়েছে আগাম সব ব্যবস্থা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ছোট অভিজ্ঞতার কথা। এই বছরের জানুয়ারি মাসে আমি গিয়েছিলাম ভারতের নয়াদিল্লির তাইপেই ইকোনমিক অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে। তখন চীনে করোনাভাইরাস নিয়ে সবেমাত্র কথা হচ্ছিল। সেই শুরুর সময়েই তারা কালচারাল সেন্টারে প্রবেশের আগে রেসপিরেটরি ডিজিজ প্রতিরোধের প্রাথমিক তিনটি নিয়ম, মাস্ক পরা, হাত জীবাণুমুক্তকরণ এবং শরীরের তাপমাত্রা মাপা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিল। যদিও সে সময়ে ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ছিল দিল্লি থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে চীনের উহানে, এমনকি তখন ভারতে কেউ আক্রান্ত হয়েছে এমন তথ্যও ছিল না। তারপরও তারা যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেটা হলো আগাম প্রতিরোধব্যবস্থা। এ সময়ে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে এনে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছে, সেই সঙ্গে নিয়েছে বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থা।

ফরমোজা প্রণালি। ছবি: লেখক
ফরমোজা প্রণালি। ছবি: লেখক

বাসে ওঠার সময় বাসচালক ইশারা দিয়ে মনে করিয়ে দিলেন মাস্ক ব্যবহারের কথা। আসলে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্থান থেকে শুরু করে বাস, ট্রেন, ক্লাসরুমসহ প্রায় সবখানে ফেস মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। না হয় বড় অঙ্কের জরিমানার মুখে পড়তে হবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মাস্কের জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এটা হয়নি। একদম শুরুর দিকেই মাস্ক উৎপাদন এবং বিতরণের মধ্যে ভারসাম্য করা হয়েছে। প্রথম দিকে বিতরণব্যবস্থা সরকার নিজের হাতে নিয়ে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সপ্তাহে দুটি মাস্ক নিশ্চিত করেছিল, এখন যা বাড়িয়ে করা হয়েছে তিনটি।


মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় এমন রোগপ্রতিরোধের অন্যতম প্রধান উপায় হলো, লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার দ্রুততম সময়ের ভেতর আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা করে ফেলা, যেন অন্য কেউ সংক্রমিত না হয়। একই সঙ্গে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যেন তার মৌলিক চিকিৎসা দেওয়া যায়। করোনাভাইরাস বাহকের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষণ যেহেতু শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, তাই তাইওয়ানের প্রতিটি মেট্রোরেল স্টেশনে থার্মাল স্ক্যানার লাগানো। সারিবদ্ধভাবে যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে, আর তাদের অজান্তেই মাপা হচ্ছে তাদের গায়ের তাপমাত্রা। এমনকি প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাসরুমে ঢোকার আগেই ইনফ্রারেড থার্মোমিটার ব্যবহার করত, এখন আর এসবের ব্যবহার না হয়ে প্রবেশমুখে স্থান নিয়েছে স্ক্যানার। এভাবে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখার পাশাপাশি সব প্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখে রাখা আছে হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা। সত্যি কথা বলতে, এখানে থার্মাল স্ক্যানারের প্রাচুর্য দেখে হীনম্মন্যতা আর আফসোস দুটোই খুব বেড়েছে।
করোনাভাইরাস ক্রাইসিসের শুরুর দিকে আমাদের দেশের খবরের কাগজে পড়েছিলাম, বিমানবন্দরের থার্মাল স্ক্যানার বিকল, এমনকি স্থলবন্দরগুলোতেও ছিল না কোনো ব্যবস্থা। যদি আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একটু আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে হয়তো আজকের এই অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি হতো না। যদিও আক্রান্ত হওয়ার পর ব্যবস্থা যাকে আমরা বলি রোগ প্রতিকার, এই নীতির ওপর চলতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছে ইউরোপ আর আমেরিকা। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর রোগ প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত লোকবল রয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে খুব দ্রুতই রোগের বিস্তার অনেকটা সীমিত সীমার ভেতর নিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু এই প্রতিকারের নীতি আমাদের মতো গরিব দেশগুলোর জন্য বড্ড বেমানান।

তাইওয়ানে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রথম দিকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার ব্যবহার করা হতো। এখন স্ক্যানারে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা হয়। ছবি: লেখক
তাইওয়ানে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রথম দিকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার ব্যবহার করা হতো। এখন স্ক্যানারে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা হয়। ছবি: লেখক

বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল তাইওয়ান মডেল। একাগ্র চিত্তে কাজ করলে অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব। যার জন্য এখন প্রয়োজন প্রচুর টেস্ট, আর সেই সঙ্গে আক্রান্ত রোগীদের শনাক্ত করে দ্রুততম সময়ের ভেতর আলাদা করে ফেলা। ব্যাপক সংখ্যায় পরীক্ষা, সেই সঙ্গে আইসোলেশন—এই দুটোকে এখন বলা হচ্ছে গেম চেঞ্জার। এটাই বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে করা হচ্ছে, তাদের প্রাথমিক ভুল বুঝতে পেরে এখন তারা প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসছে। দক্ষিণ কোরিয়া এই নীতিতেই সফল হয়েছে। না হলে তারাই হতো চীনের পর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। আমাদের দেশেও এটা করতে হবে, সেই সঙ্গে উৎসাহিত করতে হবে গবেষণায়, দেশীয় প্রযুক্তিতে বের করতে হবে কীভাবে অল্প খরচে কম সময়ের ভেতর বড় সংখ্যক রোগীকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করে ফেলা যায়। এ ক্ষেত্রে দেশে উদ্ভাবিত কিট হতে পারে খুব ভালো বিকল্প ব্যবস্থা। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা সংক্রামক রোগ, এটা গোপন করলে শুধু নিজের ক্ষতি নয়, আমাদের চারপাশের সুস্থ মানুষদের জন্যও ভয়ানক। তেমনিভাবে এটা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার জনগণের ওপর হুমকিস্বরূপ যেসব বাহক আছে, তাদের বের করে আইসোলেশনে রাখা, যত দিন পর্যন্ত না তারা পুরোপুরি ভাইরাসমুক্ত হন। আমরা আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছি। এখন আবার যদি আর একটা ভুল করি, এটার মাশুল অনেক বড় আকারের হয়ে যেতে পারে।

*লেখক: স্টুডেন্ট ইন মলিকুলার মেডিসিন, ডিপার্টমেন্ট অব ইনফেকশিয়াস ডিজিজেস অ্যান্ড ভ্যাক্সিনোলজি, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান। badruzzaman@nhri. edu.tw/ badruzzaman. [email protected]