আমাদের দেখা হোক মহামারি শেষে, জিতে এসে

কাল (কয়েক দিন আগে) খবরে এল পুরো ইউরোপের মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে ইউকেতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক লোক মারা গেছে। সংবাদটা দুঃখের এবং যথেষ্ট আতঙ্কের। তারপরও আশা ছাড়তে পারিনি। খারাপ হওয়া মনটাকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

লেখক
লেখক

দুই মাস হয়ে এল আমাদের এই অন্য রকম জীবনের। প্রথম দিকে ভয় ও দুশ্চিন্তা প্রবল পরিমাণে শরীর ও মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এখন আমরা কিছুটা ধাতস্ত হয়েছি। যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বুঝি মানুষ বলেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়। এখন আর মৃত্যুভয়ে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে না। বরং ঠান্ডা মাথায় আমরা চিন্তা করছি পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয়, তাহলে কীভাবে সামাল দেব। সব নিয়মকানুন মেনে চলছি, যত রকম সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার, সব করে চলছি। অযথা প্যানিকড হওয়ার চেয়ে যদি সত্যি নিজেদের ওপর করোনা নামের বিপদটি নেমে আসে, তাহলে যেন তার সঙ্গে যুদ্ধ করে জিততে পারি, এই মুহূর্তে সেটা মাথায় রাখার দরকার বলে আমার মনে হয়। এ দেশে লকডাউনের সময় যেহেতু আরও বাড়ানো হয়েছে, আশায় আছি এরপর হয়তো দেশটা একটু হলেও ঘুরে দাঁড়াবে, খারাপ খবরগুলো কমে আসা শুরু করবে। আমি আশাবাদী মানুষ, তাই প্রচণ্ড দুঃসময়ের মধ্যেও ইতিবাচকভাবে ভাবতে চেষ্টা করি।

সামনে পবিত্র ঈদ। এবারের ঈদ অন্য সব ঈদের থেকে অন্য রকম। দামি বা নতুন কাপড় পরে নয়, এবারের ঈদ শুরু হবে খোদার কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর মাধ্যমে। কৃতজ্ঞতা কারণ তিনি আজও আমাদের সুস্থ রেখেছেন, ভালো রেখেছেন। যদি বেঁচে থাকি, নতুন কাপড় পড়ে আর আট পদের খাবার খেয়ে ঈদ পরেও করা যাবে। এবার আমরা ঠিক করেছি ঈদের কাপড় ও অন্যান্য শখের জিনিস কেনার জন্য যে বাজেট আমাদের আছে, তা আমরা গরিব ও অসহায় মানুষকে সাহায্য করার কাজে ব্যয় করব। কিছুদিন আগে আমার মেয়ের জন্মদিন গেল, তখনো আমরা তা–ই করেছি। তার জন্মদিনে তার জন্য দামি যে উপহার কিনে দেব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম, তা না করে সেটা আমরা চ্যারিটিতে দিয়েছি। আমাদের অতি সামান্য প্রয়াস যদি দুজন অভুক্ত মানুষকেও এক বেলার ভাত জোগান দিতে পারে, সেই আনন্দ আমার পাঁচ বছরের মেয়ের মুখের হাসির থেকে কোনো অংশেই কম মূল্যবান নয়।

বেডফোর্ডশায়ারের অন্যান্য এলাকার থেকে আমাদের এলাকাটি অপেক্ষাকৃত নতুন। মাত্র কয়েক বছর আগে এখানে জনগোষ্ঠীর বসবাস শুরু হয়েছে। ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর, মাঝেমধ্যে অনেকগুলো ঝকঝকে পরিষ্কার বিশাল আকৃতির মাঠ, মাঠগুলোর পাশে সরু নদী বয়ে চলেছে, আর সেই নদীতে টলটলে পানি। এই হলো এখানকার বৈশিষ্ট্য। জায়গা হিসেবে বেশ নিরিবিলি। হাঁটা এবং সাইকেল চালানোর জন্য আদর্শ জায়গা বলা চলে। এখানকার মানুষগুলোও ভীষণ ভালো এবং দায়িত্বশীল। যাঁদের শারীরিক সুস্থতার জন্য রোজ কিছু সময় হাঁটাচলা করা আবশ্যক, তাঁরা হাঁটতে ঠিকই বের হচ্ছেন, কিন্তু একে অপরের সঙ্গে অনেকখানি দূরত্ব বজায় রেখে। এখানকার কমিউনিটির মানুষদের একটা জিনিস খুব ভালো লেগেছে। তা হলো, এরা যতটা স্বাস্থ্যসচেতন, তার চেয়েও বেশি নিয়মকানুন মানার ব্যাপারে সতর্ক। একটি কাপল হয়তো হাঁটতে বের হয়েছেন, যেই দেখবেন ১০ হাত দূর থেকে আরও কেউ একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন, অমনি তাঁরা রাস্তা ক্রস করে বিপরীত রাস্তায় চলে যাবেন। যেন মুখোমুখি হওয়ায় কোনো সম্ভাবনাই তৈরি না হয়। এত সুন্দর করেও যে সোশ্যাল ডিসট্যানসিং মেইনটেন করা যায়, তাঁদের দেখে শিখলাম।

হয়তো এ কারণেই লন্ডন এবং অন্য সব ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর চেয়ে এখন পর্যন্ত শহরতলি এবং ছোট ছোট গ্রামগুলোয় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেকাংশে কম। জানি না আরও কত দিন সবাই এ রকম সতর্ক থাকতে পারবে। এও জানি না আরও কত দিন লাগবে সবকিছু একটু স্বাভাবিক হতে, পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতে। তবু আশায় বুক বেঁধে থাকি আর প্রার্থনা করে যাই। আর এ প্রার্থনা শুধু নিজেদের জন্য আর বাংলাদেশের জন্য নয়, প্রার্থনা সবার জন্য। প্রার্থনা আমাদের সেই আগের চেনা পৃথিবীকে ফিরে পাওয়ার জন্য।

*লেখক: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী