থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে ৮

জাস্টিন ট্রুডো
জাস্টিন ট্রুডো

সাসকাতুন শহরে এ সময়ের সকালটা ভীষণ আলো ঝলমলে হয়। কিন্তু আজ রোদ ভীষণ মনমরা আর ম্রিয়মাণ যেন। ভাইরাসের ভয়ানক বিভীষিকায় এই ছোট্ট শহরের মানুষেরাও দমবন্ধ অবস্থায় আছে। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা নদীটা সাসকাচুয়ান রিভার। শান্ত নদীটি যেমন বরফের আস্তরণে ঢেকে আছে। বিষণ্ণতা নিয়ে তেমনি বিশাল এক অবসন্ন মন নিয়ে, কুঁকরে বসে আছি লিভিং রুমের সোফায়।


সকালে ঘুম ভেঙে চোখ খুলতে পারছিলাম না। চোখ আটকে আছে আঠালো ময়লা দিয়ে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, প্রচণ্ড গা ব্যথা, মনে হচ্ছিল যেন কেউ লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে, মাথায় যন্ত্রণা। যখন প্রতিদিনই মিলিয়ে দেখি করোনার লক্ষণের সঙ্গে মিলে কি না। রিসার্চ বলছে, শরীরে ভাইরাস প্রবেশের ১৪ দিনের মধ্যে দেখা দিতে পারে এই সব লক্ষণ। আমার শরীরে ভাইরাস ঢুকেছে আজ দুই সপ্তাহ হলো। এ ভাইরাস করোনা কি না, সেটি পরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না।


কোনোরকমে চোখ কচলে উঠে এক গ্লাস পানি খেলাম। আমার পারিবারিক ডাক্তার মিচেল বলেছেন, আমার খুব বাজে ফ্লু হয়েছে। তারপরও যখন ইন্টারনেট, পত্রিকা ঘাঁটি আমার মনে হয় করোনার লক্ষণের সঙ্গে অনেক মিলে যায়। ডাক্তারের কাছে যাইনি, ফোনে কথা বলেছি। ডাক্তার বলেছেন আমার করোনা না। যদিও বলেছিলেন ওয়াকিং ক্লিনিকে যেতে, কিন্তু লম্বা লাইনে বসে থাকার ভয়ে আর যাইনি।


এ এক কঠিন সময়। মৃত্যুর ভয়, চাকরির অনিশ্চয়তা, শরীরের অসুস্থতা, ভয়ংকর এক মহা প্রলয়ের সময় পার করছে পৃথিবীর মানুষ। শারীরিক সমস্যার সঙ্গে যখন মানসিক সমস্যাও যোগ হয়, জীবন তখন হতাশার অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। করোনা বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক মহামারির চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছে না।


আমার স্বামী এজাজ বাসায় থাকে না সারা দিন। বাসায় এলেও থাকে অন্য রুমে। কারণ, ডাক্তার বলেছেন আমাদের সোশ্যাল ডিসটেন্স বজায় রাখতে। বাসায় দুজন মানুষ, এখন একজন যদি থাকে অন্য রুমে দূরে দূরে, কেমন লাগে? কিন্তু ওকেই বা কী দোষ দেব। সে বৃদ্ধ মানুষদের সঙ্গে কাজ করে। আর তারা হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের মৃত্যুর জন্য কি আমার পরিবার দায়ী হবে? এসব ভেবে একাকী হতাশারা কুঁকরে কুঁকরে মারে।


করোনা নামের ছোঁয়াচে রোগ একজন থেকে আরেকজনকে সংক্রমিত করে তছনছ করে দিচ্ছে পরিবার, সমাজ আর পৃথিবী। প্রতিনিয়তই ভীষণ রকম বিষণ্নতা গ্রাস করছে আমাকে, আমার আশপাশের সবাইকে। করোনা শুধু ফুসফুসকেই কুরে কুরে খাচ্ছে না, মানুষের মস্তিষ্কও দখল করে নিচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ কিছুতেই বের হতে পারছে না, এই করোনাময় জীবনযাপন থেকে।


নিউইয়র্কে মৃত্যুর মিছিল। তাই কানাডাও রিস্কের মধ্যেই। প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছে ঘরের দুয়ারে করোনার কাল সাপের ফণারা বিষদাঁত মেলে হিসহিস করছে। করোনার বিষাক্ত ছোবলের ভয়ে জড়োসড়ো কানাডিয়ানদের তখন নির্ঘুম রাত কাটে। সবাই ভীষণ আতঙ্কিত, ভীষণ বিষণ্ন, এক বিশাল অনিশ্চয়তা।

সাসকাচুয়ান রিভার। ছবি: লেখক
সাসকাচুয়ান রিভার। ছবি: লেখক

এরই মধ্যে হঠাৎ করে ভোরের আলোর মতো এক টুকরা আলোর দিশারি হিসেবে এল একজন। অসাধারণ এক মানবিক মানুষ। কী অসাধারণ দেখতে। পৃথিবীর ইতিহাসে অত সুদর্শন রাষ্ট্রনায়ক আরও কেউ ছিল কি না, আমার জানা নেই। কালো কোট পরা, এক মুখ সাদা, কালো দাড়ি, উজ্জ্বল দীপ্তময় দুটি চোখে অসম্ভব মায়া। সেলফ আইসোলেশনে থাকা জাস্টিন ট্রুডো রিডো হল কটেজের পোডিয়ামের সামনে যখন বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়ালেন তখনো মনে হচ্ছিল, কী আর তিনি করবেন এই অল্প বয়সী নেতা? মহামারির সময়? ট্রাম্পের মতো বিশ্বের সবচেয়ে মহা ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি যখন আবোলতাবোল বকছেন, তখন এই যুবকটির আর কী করার আছে।


কিন্তু যখন তিনি শুরু করলেন তাঁর বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে থাকলাম। কী ভীষণ আবেগ, ভীষণ দৃঢ়তা নিয়ে ৪৬ বছরের যুবকটি যেন আমার বাবা হয়ে উঠলেন, আমার বড় ভাই হয়ে উঠলেন, আমার সবচেয়ে বেশি নির্ভরতার মানুষ হয়ে উঠলেন।


ট্রুডো বললেন, ‘কোনো চিন্তা করো না, তোমাদের দায়িত্ব আমার। এমন দুর্যোগে আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, আমার পুরো সরকার আছে কানাডার মানুষের সঙ্গে। আমাদের একদল দক্ষ স্বাস্থ্যবাহিনী আছে সেবা করার জন্য।’ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে হিমশিম খাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতি আতঙ্কিত নাগরিকদের সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি নির্ভরতার প্রতীক হয়ে। বলেছেন, ‘সংকটের গোড়া থেকেই দেশের সেরা চিকিৎসক, বিজ্ঞানীদের পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছি। তোমাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের আশ্বস্ত করতে চাই, পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রতিটি পদক্ষেপই আমরা নেব।’


জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রীর করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে, ঘরে ছোট তিনটা বাচ্চা, তিনি নিজেও আইসোলেশনে আছেন। তাঁর ঘরেও মৃত্যুর বিভীষিকা, কিন্তু তারপরও তাঁর কাছে দায়িত্বই বড়। কারণ তিনি তো দেশের নেতা। দেশের মানুষ তাঁকে ভোট দিয়েছেন, তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদের দেখভালের।


তাঁর ভাষণটি শুনতে শুনতে কখন যে চোখের কোনায় পানি চলে এসেছিল, বুঝতে পারিনি। এই করোনাকালে এমন মায়াময়ী বক্তৃতা শুধু তো আমার মনকে চাঙা করেই তুলল, তা নয়। আমার মনেও ভীষণ রকম আবেগ এসে ভিড় করল। এ রকম আস্থা, আশ্বাস তো শুধু প্রিয়জনেরাই দিতে পারেন। জাস্টিন ট্রুডো আমাদের, সব কানাডাবাসীর অতি ভীষণ প্রিয়জন হয়ে উঠলেন।


একজন নেতা তো এমনই হবে আমরা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম পৃথিবীর মানুষেরা। সুদর্শন যুবকটির সৌন্দর্য শরীর ছাপিয়ে ম্লান হয়ে গেল তাঁর মানবিকতার সৌন্দর্যের কাছে। সত্যিকারের নেতাদের সৌন্দর্য তো এমন মানবিক গুণেই মহিমান্বিত হয়, সূর্যের আলোর মতো জ্বল জ্বল করে।


তারপরও আমরা অভিবাসী। এসেছি মিথ্যার ঝুলিভরা গালগল্প নিয়ে। আমাদের তো বিশ্বাসে চিড় ধরেছে।


রোদেলাকে ফোন দিলাম। জাস্টিন ট্রুডো তাঁর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন না। তার পছন্দ ইন্ডিয়ান শিখ জগজিৎ শিং। জগৎ সিং বৈশ্বিক জলবায়ুকে গুরুত্ব দিয়েছেন, পরিবেশ নিয়ে তাঁর বিশেষ পরিকল্পনা। রোদেলা পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। সে তার জন্য একটু-আধটু ক্যাম্পেইনও করেছে। আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে তাকে বললাম, মামণি শুনেছো জাস্টিন ট্রুডোর বক্তৃতা?
সে ভীষণ নির্বিকার সুরে বলল, হ্যাঁ, শুনলাম।


কী দারুণ বক্তৃতা দিলেন বাবা, আমার মনটা ভীষণ ভীষণ ভালো লাগছে।


এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই মা, জাস্টিনের জায়গায় অন্য কেউও এ রকমই বলতেন, এসবই বলতেন।
আমি এসেছি এমন দেশ থেকে, যেখানে শুধু আশ্বাস পাওয়া যায়, ফলাফল শূন্য। কিন্তু ওঁর কথা তো পুরোটাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। তাই বেশ জোর দিয়েই বললাম, ওঁর মতো এমন চমৎকার করে অন্য কেউ বলতে পারতেন না।


কত ভালোভাবে বলেছেন সেটা বড় কথা নয়, কতটুকু তিনি করতে পারবেন, কীভাবে সামাল দেবেন, সেটাই বড় কথা। এ দেশে বড় হওয়া মেয়ে আবেগ দিয়ে চলে না, যুক্তি দিয়ে চলে।
আমি বাংলাদেশি আবেগ দিয়ে চলি, যুক্তির দরকার নেই। এ মুহূর্তে আমার ভীষণ সাহস লাগছে, মনে হচ্ছে কেউ আছে পাশে, যার কাছে আমার মতো সাধারণ অভিবাসী মানুষও বিশেষ কোনো মানুষ। আসলেও তাই, শুধু কথার ফুলঝুরি নয়, সব ধরনের মানুষ, সাদা-কালো, বাদামি প্রত্যেক নাগরিককে তিনি ভীষণ মমতায় আগলে রাখার আশ্বাস দিলেন।
জীবনে এই প্রথম আমার নিজেকে একজন কানাডিয়ান নাগরিক মনে হলো। আমিও যে এ দেশেরই অংশ, তা জাস্টিন ট্রুডোই মনে করিয়ে দিলেন। এই অচেনা পৃথিবীর দুর্গম খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখলাম বদলে যাওয়া পৃথিবীর।


বদলে যাওয়া মানবিক পৃথিবীই তো চাই আমরা, নতুন স্বপ্ন দেখার জন্য। ট্রাম্প, বরিস জনসন, কিম উংরা বদলে যেতে পারেন না? এই সুদর্শন যুবকটির তারুণ্য, মানবিকতা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কি বিশ্বের বাকি নেতাদের মধ্যে সংক্রমিত করার কোনো ভাইরাস মিলবে পৃথিবীতে? চলবে...