কোলের শিশু বিক্রি

১৯৪৮ সালের কাহিনি।

শিকাগোর এক বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড ঝুলছিল, চারটি শিশু বিক্রি হবে। বোর্ডের নিচে চারটি ফুটফুটে শিশু সেজেগুজে বিক্রির জন্য বসা। আলোকচিত্রীকে ছবি তুলতে দেখে মা মুখ লুকিয়ে ফেলেন। তাঁর গর্ভে তখন পঞ্চম সন্তান বেড়ে উঠছে।

ভদ্রমহিলার স্বামী একজন ট্রাকচালক, বেকার। অভাবের কারণে তাঁদের এই চরম সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। ভাইবোনের নামগুলো লানা (৬), রে (৫), মিল্টন (৪) এবং স্যু (২)। মাঝের দুই ভাইবোন, রে এবং মিল্টন একবাড়িতেই ‘বিক্রি’ হয়ে যায়।

মায়ের সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু নতুন বাড়িতে শান্তি মিলল না। নতুন অভিভাবক তাদের কখনোই দত্তক নেননি। দুই ভাইবোনকে শিকল দিয়ে বেঁধে খামারে কাজ করানো হতো। দীর্ঘ সময় ধরে। খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম ইত্যাদি ছিল নামমাত্র। ঠিক যেমনটা এই ঘটনার এক শ বছর আগে দাসদের দিয়ে করানো হতো। আমেরিকায় দাস প্রথা বিলুপ্তির শতবর্ষ (১৮৬৫) হয়ে গেলেও অনেকেই সেই নৃশংস চর্চা গোপনে চালিয়ে যেত। নতুন ‘মালিক’ তাঁদের ‘স্লেভ’ বলেই ডাকতেন। প্রথম দিকে মিল্টন কিছু বুঝতে পারত না, ‘স্লেভ’ শব্দটির সঙ্গে তার পরিচয় তখনো ঘটেনি।

তাদের ছোট ভাই ডেভিড (মায়ের গর্ভে যে ছিল) সে–ও দ্রুত বিক্রি হয় এক নতুন বাড়িতে। নতুন অভিভাবক কঠোর ছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে ভালোবাসতেন ও যত্নও নিতেন। ডেভিড প্রায়ই তাঁর ভাইবোন রে এবং মিল্টনের সঙ্গে দেখা করতে আসত।

টিনেজ বয়সের শুরুতেই রে অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হয়। যার ফলে সে গর্ভবতী হয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভবতী নারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে সে শিশুর জন্ম দিয়ে আসে। সেই শিশুটিকে অন্য এক পরিবার এডপ্টও করে নেয়।

সতেরো বছর বয়সে রে বাড়ি ছেড়ে পালায়।

তত দিনে মিল্টনও প্রতিবাদ করতে শিখে গেছে। মালিক শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করলে সে বেশ হিংসাত্মকভাবেই প্রতিহত করে। আদালত তাকে মেন্টাল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।

বহু বছর পর পাঁচ ভাইবোন একে অপরকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুঁজে পায়।

১৯৯৮ সালে লানা ক্যানসারে মারা যায়। স্যু তার মা সম্পর্কে বলে, ‘ওই মহিলার দোজখের গহিনে স্থান হওয়া উচিত। আগুনে পুড়ুক সে।’

বহু বছর পরে তারা নিজেদের মাকেও খুঁজে পায় এবং দেখা করে। মহিলা নিজের পাঁচ শিশুকে বিক্রির পর আবারও বিয়ে করেন এবং নতুন সংসারে তাঁর আরও চারটি শিশুর জন্ম হয়। মিল্টনের কথানুযায়ী, ‘এই মহিলা আমাদের কখনোই ভালোবাসেনি। এখনো সে নিজের কাজের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়।’

তাঁর জীবনের ওপর দিয়ে যা গেছে, তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

ছোট ছেলে ডেভিডের অবশ্য মা সম্পর্কে রায় ভিন্ন। সে বলে, ‘তখন টিকে থাকার প্রশ্ন ছিল। অস্তিত্বের সংকট। আমরা বিচার করার কে? আমরা সবাই মানুষ, সবাই ভুল করি। আমাদের নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ মায়ের ছিল না। তিনি চাননি আমরাও না খেয়ে মারা যাই।’

আমেরিকান একটি নিউজ আর্টিকেলে পড়েছিলাম এমন ঘটনার কথা।

কতটা অর্থ সংকটে পড়লে মানুষ নিজের শিশুকে বিক্রি করে, সেটা ভাবতেও গা কাটা দিয়ে ওঠে। যদিও জানি, আমাদের দেশেই এমন ঘটনা নিয়মিতই ঘটে। অর্থ সংকটের কারণে এই ভিখারি নিজের কোলের শিশুকে এক ভদ্রলোকের সংসারে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, এমনটা জানতে পারি হুমায়ূন আহমেদের শৈশবের স্মৃতিকথায়।

ঘটনা এখনো পুরোনো হয়নি। সেদিনই প্রথম আলোর সংবাদে এল হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে না পেরে নবজাতককে বিক্রি করেই মা–বাবা ছাড়পত্র পেয়েছেন।

করোনাভাইরাস শেষে আমরা বৈশ্বিকভাবেই একটি চরম অর্থনৈতিক মন্দার দিকে যেতে পারি। তখন এমন বেশ কিছু দুর্ঘটনা দেখা বিচিত্র হবে না।

যাঁরা বলেন টাকাপয়সায় সুখ কেনা যায় না, তাঁরা জেনে রাখুন টাকাপয়সা থাকলে অন্তত নিজের পেটের সন্তানকে বিক্রি করতে হয় না।