ফ্রান্সে লকডাউনের কারণে জন্মহার বাড়তে পারে

লকডাউনের পূর্বে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ফ্রান্সের কামার্গ সমুদ্রতীরে এক ফরাসি দম্পতি। ছবি: লেখক
লকডাউনের পূর্বে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে ফ্রান্সের কামার্গ সমুদ্রতীরে এক ফরাসি দম্পতি। ছবি: লেখক

লকডাউনের কারণে ফরাসি নারীদের মধ্যে গর্ভবস্থা অর্থাৎ অন্তঃসত্ত্বা পরীক্ষার কিট কেনার হিড়িক পড়েছে। গত ১৩ থেকে ১৯ এপ্রিল মাত্র এক সপ্তাহে এই কিট বিক্রি ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে মার্চ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ২৬ শতাংশ। বিএফএম টিভির বরাত দিয়ে জনপ্রিয় ফরাসি সাপ্তাহিক লু পোঁয়া ফলাও করে এ খবরটি ছেপেছে। লকডাউন চলাকালীন অন্তঃসত্ত্বা পরীক্ষার কিট প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান নিলসেন তাদের কিটের এমন অস্বাভাবিক বাড়তি চাহিদার কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে সরবরাহে অপ্রতুলতা এবং রেস্তোরাঁ, ক্যাফে বার, বিভিন্ন বিনোদন সমাবেশ ইত্যাদি বন্ধ থাকার কারণে নতুন পরিচয়ের সম্ভাবনা না থাকায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না উল্লিখিত সময়ে।

উল্লেখ্য, গত ১৭ মার্চ থেকে শুরু করে দীর্ঘ ৫৫ দিন ফ্রান্সজুড়ে লকডাউন থাকার পর ১১ মে থেকে তা তুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে হুট করে তুলে নেওয়ার মতো কিছু নয়। নির্দিষ্ট কিছু বিধিনিষেধের আওতায় অনেকটা ধাপে ধাপেই তুলে নেওয়ার সতর্ক পদক্ষেপ জারি করেছে ফরাসি সরকার।

সে যা–ই হোক, এই দুই মাসে ইতিমধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণে এ দেশটিতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ হাজারের মতো মানুষ। আরও প্রায় ২৫ হাজার মানুষ এ মুহূর্তে হাসপাতালে আছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজারের মতো রোগী নিবিড় পরিচর্যায় চিকিৎসাধীন আছেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তবে বর্তমানে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল পিছু হটতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি অনেকটাই এখন নিয়ন্ত্রণে। অবস্থা পাল্টাতে শুরু করেছে। মৃত নগরীতে একটু একটু করে ফিরছে প্রাণচাঞ্চল্য। দুঃস্বপ্নের দীর্ঘ রাতের শেষে নতুন ভোরে নতুন আলো আবারও নতুন আশার সঞ্চার করছে। নভেল করোনাভাইরাসের ঝটিকা আক্রমণের মুখে প্রথমে খানিকটা বিপর্যস্ত হলেও সরকার এবং জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে মস্তিষ্কহীন অদৃশ্য শত্রুকে অবশেষে মাথা নত করতে হচ্ছে। যুদ্ধাবসান না হলেও, শত্রু অনেকটাই পরাস্ত।

লকডাউনের পরে, শঁজেলিজে, প্যারিস। ছবি: লেখক
লকডাউনের পরে, শঁজেলিজে, প্যারিস। ছবি: লেখক

দীর্ঘ প্রায় দুই মাস লকডাউন থাকায় ফ্রান্সে জন্মহার বৃদ্ধির সম্ভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছে। ফরাসি সমাজজীবনে এটা ইতিবাচক দিক। এ দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান এবং অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (INSEE) দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ৬ কোটি ৭০ লাখ মানুষের এ দেশটিতে ২০১৯ সালে উর্বরতার হার ছিল নারীপ্রতি ১ দশমিক ৮৭ শিশু এবং জন্ম নিয়েছে মোট ৭ লাখ ৫৩ হাজার শিশু। এই সংখ্যা ২০১৮ সালের তুলনায় ৬ হাজার কম (-০.৭%)। এমন করে পাঁচ বছর ধরে এই হার নিম্নমুখী। তা ছাড়া নারীদের সন্তান ধারণের গড় বয়স বর্তমানে ৩১-এ এসে ঠেকেছে। ফরাসি পুরুষদের গড় আয়ু এখন ৭৯.৪ বছর এবং নারীদের তা হচ্ছে ৮৫.৩ বছর। মাত্র ৬০ বছর আগেও এই গড় আয়ু ছিল ১৩ বছর কম। এর ফলে ফ্রান্সে প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা বাড়ছে। সে হিসাবে জন্মহার তাল মেলাতে পারছে না। এসব কারণে ফরাসি নীতিনির্ধারকেরা বেশ উদ্বিগ্ন।

তবে এ বছর লকডাউনের কারণে সন্তান জন্মের হার বাড়বে এবং ডিসেম্বর মাসে হিসাবটি বদলে যাবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে এ বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে ইউরোপের মাল্টা, স্পেন, ইতালি, সাইপ্রাস ও গ্রিসে নারীপ্রতি উর্বরতার হার মাত্র ১.২৩ থেকে ১.৩৩ জনের মধ্যে ওঠানামা করছে। এদিক দিয়ে দেখলে ফ্রান্সের অবস্থা একদম খারাপ নয়। জনসংখ্যাবিষয়ক ফরাসি জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান (INED) থেকে গত ১১ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় ফ্রান্সের শিশু জন্মের হার খানিকটা সম্মানজনক এবং এর জন্য কৃতিত্বের অনেকটাই দাবি করতে পারে এ দেশে বসবাসকারী অভিবাসীরা।

একই প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যে জানা যায় যে ২০১৮ সালে এ দেশে মোট অভিবাসীর সংখ্যা ৬৫ লাখ, মোট জনসংখ্যার ৯.৭ শতাংশ। এর সঙ্গে প্রতিবছর যোগ হয় এ দেশে স্থায়ী বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত প্রায় দুই লাখ নতুন অভিবাসী। সরকার বিভিন্নভাবে এ দেশের নাগরিক এবং বসবাসকারীদের সন্তান জন্মদানের জন্য উৎসাহ দিয়ে থাকে। এর একটি হলো, মাতৃত্বকালীন ছুটির সর্বনিম্ন সময়কাল ১৬ সপ্তাহ; প্রসবের প্রত্যাশিত তারিখের আগে ৬ সপ্তাহ এবং প্রসবের পর ১০ সপ্তাহ (প্রসবোত্তর) ছুটি। তবে তৃতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে সন্তানের মা ছুটি পাবেন মোট ২৬ সপ্তাহ। প্রসবের আগে ৮ এবং পরে ১৮ সপ্তাহ। মায়ের সঙ্গে সন্তানের পিতা (অথবা যে ব্যক্তি মা এবং সন্তানের দায়িত্ব নিচ্ছেন) তিনিও পূর্ণ বেতনে মোট ১১ কার্যদিবস পিতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন। সেই সঙ্গে রয়েছে সন্তানের জন্য ভাতাসহ নিখরচায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার চমৎকার ব্যবস্থা এবং রাজস্ব হ্রাসের সুবিধা। উল্লেখ্য, ফ্রান্সে শিক্ষা অবৈতনিক এবং ১৬ বছর পর্যন্ত তা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। এসব সুবিধার কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীরা উৎসাহী হন এ দেশে স্থায়ী বসবাসের জন্য।

লকডাউনের পূর্বে, ক্যাফে বার, শঁজেলিজে, প্যারিস। ছবি: লেখক
লকডাউনের পূর্বে, ক্যাফে বার, শঁজেলিজে, প্যারিস। ছবি: লেখক

ফরাসিরা এসব সুযোগ–সুবিধার খুব একটা তোয়াক্কা করে না। কোভিড-১৯ সংক্রমণ এড়াতে বাধ্য হয়ে প্রায় দুই মাস দম্পতিরা একই সঙ্গে একই ঘরে থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে অনেকেই সন্তান ধারণে আগ্রহী হয়েছেন। তাই এ বছরের শেষ নাগাদ বাড়তি কিছু নবজাতকের মুখ দেখা যাবে। এটি নিঃসন্দেহে ফরাসিদের জন্য একটি সুখবর এবং এই আশায় প্রসূতি কেন্দ্রগুলো আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকছে আগামী দিনের নাগরিকদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানার জন্য। তাই নির্দ্বিধায় বলা চলে, করোনা শুধু প্রাণ কাড়েনি, প্রাণ উপহারও দিচ্ছে।

লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী এবং ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত