নীতিকে পাশ কাটিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনার বিস্তার রোধে প্রধান অস্ত্র লকডাউন। এই লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা সবাই যেমন স্বীকার করেছি, লকডাউন ভেঙেছিও তেমন। আমাদের দোষ হচ্ছে, গুরুত্বটা বুঝি, কিন্তু পালন করি না। আবার অপরকে বুদ্ধি যেমন যত্ন করে দিতে পারি, তেমনিভাবে নিজের বুদ্ধি নিজে গিলতে পারি না।

লকডাউন শুরুর দিকে ফেসবুকে প্রায় ডজনখানেক সম্মানিত অ্যাডমিনের স্ট্যাটাস দেখেছিলাম। সেখানে ব্যবসায়ীদের প্রতি জোড় হাত তুলে একটি অনুরোধ ছিল। স্ট্যাটাসগুলো শেয়ারও কম ছিল না। 

আমার ওই সব স্ট্যাটাস দেওয়া অ্যাডমিনের কর্মজীবন জানা নেই। তবে দুই–একজনকে যে চিনি না, তা কিন্তু নয়। যাঁদের জানি তাঁদের মধ্যে কেউ চাকরিজীবী, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউবা আবার আমার মতো ব্যর্থ প্রবাসী।
তাঁদের স্ট্যাটাসের বিষয় ছিল ব্যবসাসংক্রান্ত এবং দৃষ্টি আকর্ষণ ছিল ব্যবসায়ীদের প্রতি। বিষয়বস্তু ছিল এ রকম—জীবনে অনেক ব্যবসা করেছেন, ভবিষ্যতে আরও করতে পারবেন। লকডাউনের আইন মেনে চলুন। যাঁদের দোকান খোলা থাকবে, তাঁরা দয়া করে এই বিপর্যয়ের সময় অতিরিক্ত দামে মালামাল বিক্রি করবেন না। প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য করবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু লকডাউন শুরু হলে বাস্তবে কী দেখা গেল? তাঁদের যে আশা ছিল সে আশা গেল উল্টে। ব্যবসায়ীরা আইন ভঙ্গ করে চলেছেন আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। প্রবাসজীবন কষ্টের। দুটি পয়সা আয় করার জন্যই পরিবার–পরিজন ফেলে এত দূর। দোকানে মালামাল মজুত আছে, অথবা বাইরে থেকে সংগ্রহ করা যাচ্ছে, যেকোনো পন্থায় বিক্রি করতে হবে। গেট খুলে, গেটের ছিদ্র দিয়ে, বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে, বেড়া একটু কেটে নিয়ে সুযোগ সৃষ্টি করা, জানালার পর্দা সরিয়ে, পুলিশ এলে সটকে পড়া, ইত্যাদি ইত্যাদি পন্থায় বেচাকেনা হচ্ছে।
চাল চুরি হচ্ছে, তেল ডাল লবণ সবই তো চুরি হচ্ছে। আবার বড় বড় নেতা কর্তৃক যখন ওইগুলো চুরি হয়, তখন তো আরও বৈধ বিপজ্জনক। তাহলে নিজের দোকানের মালামাল বিক্রি করা তো কোনো অন্যায়ই দেখছি না।
শোনা যাচ্ছে, এক‌ প্যাকেট Stuyvesant বা Marlboro red beyond বিক্রি হচ্ছে R150 দরে। ঠিকই আছে। বিড়ি খাবি খা, মরে যাবি যা। বিড়ি কেনাও তো লকডাউন–বিরোধী। কে বলেছে পানিই জীবন? এদের দেখলে তো মনে হয় পানির আগে সিগারেট। কথা হলো, বিড়ি কিনতে আসে কেন?
এমনকি নির্ধারিত প্রাইস সম্মিলিত সিগারেটের মূল্যও নির্ধারিত স্থানে নেই। কিছু কিছু সিগারেট তো অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। তারপরও সতর্কতা অবলম্বন করে যথাসাধ্য চেষ্টা চলছে সবকিছু বিক্রি। বিক্রি করলেই তো দুটি পয়সা হাতে এল।
লকডাউন ভঙ্গ করা রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করা। সেই জন্য পুলিশের সরাস‌রি সিগারেট কিনতে বড়ই লজ্জা। সিগারেটের প্যাকেটটি কাগজে মোড়ানো অবস্থায় তাদের হাতে হস্তান্তর করতে হচ্ছে। তবে কপাল ভালো যে অন্য দেশের মতো এ দেশের পুলিশ ফ্রি নিতে আসে না। পুলিশের কাছে বিক্রি করলেও লাভ ঘরে আসে।
এই পুলিশই অনেকের জরিমানাসহ হ্যান্ডক্যাপ পরিয়েছে আইন ভঙ্গ করার দায়ে, নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।
মোট কথা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা পয়সা ইনকাম করতে ব্যস্ত। ঘরভাড়া, শ্রমিকদের বেতনসহ অন্যান্য খরচের চিন্তায় তাঁদের মাথা হেঁট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নীতিবাক্য কেন জলাঞ্জলি হবে না?
এর মধ্যে এক‌টি সর্বোচ্চ দুঃখের সংবাদ পাওয়া গেছে। কেপটাউনে মুন্না নামের এক বাঙালি ভাই মারা গেছেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। এটাই সাউথ আফ্রিকায় কোনো বাংলাদেশির এই ভাইরাসে প্রথম আক্রমণ ও মৃত্যু।
তবু যারা বেঁচে আছি, থেমে নেই। বৈধভাবে অত্যন্ত পরিশ্রম করে এঁরা পয়সা আয় করে থাকেন এখানে। তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের পরিশ্রম বলাই বাহুল্য।
সময়টা অত্যন্ত বিপর্যয়ের। যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি সর্বাধিক। এর মধ্যে নিজে চলতে হবে, সংসার চালাতে হবে, কর্মচারী বেতন, বাসা ও দোকান ভাড়া দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে মৃত্যুকে উপেক্ষা করতে হচ্ছে, উপেক্ষা করতে হচ্ছে ওই সব নীতিবাক্যকে। অথচ এইগুলোই ঊর্ধ্বে থাকা উচিত ছিল। যেটা প্রয়োজনের কাছে সবকিছু হার মানিয়েছে।
আবার সবারই যে প্রয়োজন ছিল, তা কিন্তু নয়। দু–এক মাস কিচ্ছু না করে দিব্বি চলতে পারেন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা নেহাতই কম নয়। তাঁরা যে শিক্ষা দিচ্ছেন, যেখান থেকেও কী শিক্ষা পাচ্ছি, সেটাও ভাবতে হবে।
এ দেশের ক্ষুধার্তদের মধ্যে খাদ্য বিতরণের জন্য বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটি অংশ বড় অঙ্কের খাদ্যসামগ্রী হস্তান্তর করেছেন এখানকার এমপি ও মেয়রের হাতে। এমন উদ্যোগে তাঁদের কারণে আজ সব বাংলাদেশি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন সবার পক্ষ থেকে।
যাঁরা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ যদি ভালো ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন, তাঁরা এখন কী করছেন জানি না। আর যাঁরা চাকরি করছেন বা অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা আমার মতো ব্যর্থ প্রবাসী, তাঁদের যদি কিছু থাকত, তাহলে এমন সুযোগে তাঁরা কী করতেন, তা–ও জানি না।
তবে এতটুকু জানি, নীতিবাক্য যতটুকু নিক্ষেপ করা যায়, নীতিবাক্য ততটুকু গ্রহণ করা কঠিন। কারণ, এটি গ্রহণ করার জন্য সময়, পরিবেশ, সুযোগ, ইচ্ছা, সামর্থ্য—এর কোনো একটির অভাব থাকে।
কোনো কোনো নীতিবাক্য অনেকের বুকে নিক্ষেপিত হলেও পুষ্পিত হয় না, হয় রক্তক্ষরণ। আবার অনেকে সাজাতে পারেন মনোরম উদ্যান।