লকডাউনে জ্যোৎস্নাবিলাস

পূর্ণিমার চাঁদ। ছবি: আফরিন সুলতানা সেতু
পূর্ণিমার চাঁদ। ছবি: আফরিন সুলতানা সেতু

এবারের পূর্ণিমাটা অনেক কারণে অর্থবহ। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই এখন গৃহবন্দী, তাই তারা পরিবার ও প্রকৃতির অনেক খুঁটিনাটি জিনিসের মূল্য বুঝতে শুরু করেছে। প্রকৃতির নিয়মে সময়ের পরিক্রমায় পূর্ণিমা এসেছে, এসেছে অমাবস্যা, আবার তারা চলেও গেছে। কিন্তু মানুষ ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সেদিকে নজর দেওয়ার সময় পায়নি।

এই প্রথম তারা অখণ্ড অবসর পেয়েছে, তাই অনেক অর্থহীন কাজের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে। সত্যি কথা বলতে খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, তা না হলে গতিময় জীবনের গতি হারিয়ে বিপথগামী হওয়ার সুযোগ ছিল। অনেক মানুষ যারা আগে রুটিন জীবন যাপন করত, এই অবসরে উপলব্ধি করতে পেরেছে, শুধু ছুটে চলার নামই জীবন নয়। থেমে দুই দণ্ড বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার নামও জীবন। প্রতিনিয়ত নিজের এবং নিজের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত মানুষটাও বুঝতে পেরেছে, শুধু বেঁচে থাকার নামই জীবন। প্রতিযোগিতা সেখানে মুখ্য নয়।

যাইহোক, অস্ট্রেলিয়ার এবারের পূর্ণিমাটা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এখানকার আকাশ থেকে উল্কাপাত দেখা যাচ্ছে। প্রতিবছর মে মাসেই এই উল্কাপাত দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব আকাশে তাকালে এক সারি উজ্জ্বল আলো দেখা যায়। খালি চোখে দেখলে সেটাকে একটা ছোটখাটো সৌরজগৎ মনে হয়। অনেক মানুষ রাত জেগে এই উল্কাপাত দেখেন এবং দারুণ সব ছবি তোলেন। ৬ মে বুধবার রাতে এই উল্কাপাত শুরু হয়েছে, কিন্তু সেদিন ছিল পূর্ণিমার আগের দিন। তাই জ্যোৎস্নার ঔজ্জ্বল্য ছিল অনেক বেশি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানানো হলো ভোররাতে উল্কাপাত ভালো দেখা যাবে। কারণ, ততক্ষণে চাঁদ ডুবে যাবে। সময়ের হিসেবে ভোররাত সাড়ে তিনটা থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে চাঁদমামার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ইঙ্গেলবার্ন স্টেশন পার হওয়ার পর যাত্রীরা ট্রেনের দরজায় ভিড় করেন যাঁরা মিন্টো স্টেশনে নামবেন। আমিও যথারীতি উনাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। দরজার বাইরে চোখ পড়তেই দেখি আকাশে চাঁদমামা মুচকি হাসি দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।

ট্রেন থেকে নেমে সরাসরি বাসায় চলে এলাম। এরপর দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সব কাজ গুছিয়ে যখন অবসর পেলাম, তখন রাত প্রায় ১০টা বেজে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার ঋতু পরিক্রমায় শীত শুরু হওয়ার কথা জুন মাস থেকে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে একটু আগেভাগেই শীতের বুড়ি জাঁকিয়ে বসেছে। প্রতিদিনই তাপমাত্রা ৬–৭ ডিগ্রিতে নেমে যাচ্ছে। রাত যত বাড়তে থাকে, তাপমাত্রা তত কমতে থাকে। এরপর ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। আমি আর তাহিয়া যখন রাতে বাসার পেছনের বারান্দায় এলাম জ্যোৎস্না দেখতে, তখন আমরা রীতিমতো কাঁপছি। বাইরে জ্যোৎস্নার আলোয় সবকিছু মায়াবী দেখাচ্ছে।

আগেই বলেছি, সূর্যের আলো এবং জ্যোৎস্নার মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো সূর্যের আলো তীব্র আর জ্যোৎস্নার আলো কোমল। তাই আপনি সারা রাত জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মেখেও ক্লান্ত হবেন না। জ্যোৎস্নার আলো পেছনের বারান্দায় তির্যকভাবে পড়ে অনেক সুন্দর আলপনা তৈরি করেছে। আমরা বারান্দা পেরিয়ে বাসার পেছনের মাঠে নামতেই অবাক হয়ে গেলাম।

চাঁদকে কেন্দ্র করে অনেক বড় ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত তৈরি হয়েছে। এটাকে ছোটবেলায় নানি–দাদিদের বলতে শুনেছি যে চাঁদের সভা বসেছে। চাঁদ বক্তা আর ওই বৃত্তের মধ্যে আছে শ্রোতা। ছোটবেলায় নানিবাড়িতে যখন আমাদের সব খালা বছরের একটা সময় নায়রে আসত, তখন সেখানে ছোটখাটো মেলা বসে যেত। আমাদের মায়েরা মোট ১১ বোন ছিলেন আর তাদের একগাদা ছেলেমেয়ে। রাতে খাওয়ার পর ঘুমাতে যাওয়ার আগে উঠানে খেজুরের পাতার পাটিতে বারোয়ারি বিছানা পাতা হতো। তারপর শুরু হতো গল্প বলার আসর। পাশাপাশি চলত চাঁদ–তারা চেনা। আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন রকমের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। ঠিক মাথার ওপর সাতটি তারা মিলে যে বড়শির আকার নিয়েছে, সেটাকে বলা হতো সপ্তর্ষিমণ্ডল। আর ওই যে পশ্চিম আকাশের কোণে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা, সেটার নাম শুকতারা। এর মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ দু–একটা উল্কাপিণ্ড ছুটে যেত। তখন নানি বলতেন, ওই যে রাম তির ছুড়ল। এমন আরও কত গল্প জমা আছে স্মৃতির ভান্ডারে।

তাহিয়া চাঁদটাকে দেখেই বলল, ওয়াও বাবা, অনেক উজ্জ্বল। আমি বললাম, কালকে আরও উজ্জ্বল হবে। কারণ, কাল পূর্ণিমা। এরপর আমরা পেছনের জায়গাটায় ঘুরে ঘুরে জ্যোৎস্নার আলোয় কোন জিনিস কেমন দেখাচ্ছে সেটা দেখলাম। জ্যোৎস্নার আলোয় সবকিছুকেই কেমন যেন অচেনা লাগছে। এর মধ্যে আমরা আমাদের ছায়ার ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। এটা আমাদের অনেক পুরোনো খেলা। আমরা জ্যোৎস্না রাতে বাইরে এসে আমাদের ছায়ার ছবি তুলি। এরপর আমরা ঘরে ফিরে এলাম। কারণ, শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। ঘরে ঢুকেই ইউটিউবে আমরা ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকের ২০তম পর্ব চালিয়ে দিলাম। এই পর্বে বাড়ির কর্তা মারা যান। তখন হাসান সাহেব বলেন, একটা নক্ষত্রের পতন হলো। এরপর মনটা খারাপ হয়ে গেল, তাই শুয়ে পড়লাম। ভোররাতে উঠতে হলো সেহরি খাওয়ার জন্য। উঠেই সবকিছুর আগে বাসার পেছনে গিয়ে সারা আকাশ খুঁজেও উল্কাপাতের দেখা পেলাম না। এগুলো হয়তোবা খালি চোখে দেখা যায় না। এরপর বাসার সামনে এসে দেখি, চাঁদমামা ডুবে যাওয়ার প্রহর গুনছে। চাঁদমামাকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকে সেহরি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ, একটু পরই আবার ঘুম থেকে উঠে অফিসে দৌড়াতে হবে।

পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে একইভাবে চাঁদমামার সঙ্গে আবার দেখা। আজ চাঁদমামা একেবারে পূর্ণ যৌবনা, তাই হাসির ঔজ্জ্বল্যও বেশি। আর আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে। চাঁদমামা সেই ভেলায় চড়ে সারা আকাশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমি বাসায় ফিরে আগের দিনের মতোই কাজকর্ম শেষ করে আবার বাইরে গেলাম। আর আজ আমাকে সঙ্গ দিল রায়ান। রায়ান বাইরে গিয়ে এমনভাবে ঘোরাঘুরি শুরু করল, যেন দিন হয়ে গেছে। আমি দোলনায় বসলাম। আমার দেখাদেখি রায়ানও এসে বসল। আমি ওর দিকে হাত বাড়াতেই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। আমি বসে বসে আশপাশের পরিবেশ উপভোগ করা শুরু করলাম। আজ শীতের তীব্রতা একটু কম আর হালকা একটা বাতাস দিচ্ছে, তাই পরিবেশটা খুবই মনোরম। দূরে কাদের বাসায় যেন কুকুর ডাকছে।

গ্রামে শীতের দিনে কুকুর ডাকলে বলা হতো শীতের কারণে কুকুর ডাকছে। শীতের সময় কুকুরগুলোকে দেখা যেত বাড়ির যেখানে মাটির চুলার ছাই ফেলা, সেখানে গুটলি পাকিয়ে ঘুমাতে। আশপাশেই নাম না জানা কিছু পোকা অবিশ্রান্তভাবে ডেকে চলেছে। দূরের রাস্তা দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দে গাড়ি চলে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরপর ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু পরই রায়ানের নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল। ছেলেটার ইচ্ছা ঘুম। ঘুমাতে বললেই ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে ঘরে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমি আবারও বাইরে গেলাম। আসলে এমন বিবাগি জ্যোৎস্নায় মনকে ঘরে আটকে রাখা দায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে দেখতে পাচ্ছিলাম অনেকেই জ্যোৎস্নাস্নান করছে। বন্ধু তমাল বাসার বাইরে চলে গেছে। ও আবার বাউলগানের পাঁড় ভক্ত, তাই প্রকৃতি সব সময়ই ওকে টানে। আমাকে প্রায়ই বলে, তোরা কুষ্টিয়াবাসী অনেক সৌভাগ্যবান যে লালন তোদের দেশে জন্মেছিল। বন্ধু মুকুল চাঁদের দারুণ সব ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। অবশ্য মুকুলের লেখার হাতও দারুণ। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর লেখা পড়ি আর ছবি দেখি। অন্যদিকে সেতু ভাবিও দারুণ ছবি তোলেন। পেশায় চিকিৎসক হওয়ার পরও এত দুর্দান্ত ছবি তোলেন যে দেখলে বিশ্বাসই হয় না বিষয়বস্তুটা কি আসলেই এতটা সুন্দর ছিল! উনিও এর পাশাপাশি লেখালেখি করেন। উনার দেওয়া চাঁদের ক্লোজ ভিউয়ের ছবিগুলো খুব বেশি সুন্দর। এভাবেই একটা পূর্ণিমা রাত বয়ে চলেছে। করোনায় আক্রান্ত পৃথিবীতে আবারও পূর্ণিমা এসেছে জীবনের জয়গান গেয়ে। বেশির ভাগ দেশেই করোনার সংক্রমণের লেখচিত্র ফ্ল্যাট হতে শুরু করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় ১ মে থেকে লকডাউন একটু শিথিল করা হয়েছে, তাই জনমনে কিছুটা স্বস্তি নেমে এসেছে। উপরন্তু মার্কেটগুলো আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। টয়লেট টিস্যু এবং স্যানিটাইজার দেখা যাচ্ছে সুপার শপগুলোর তাকে। আসলে একটা সিস্টেম ঠিকভাবে চললে সামান্য অনিয়ম সেটার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। ট্রেন, বাসে আবার ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। বেশ কিছু অফিস সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হয়েছে। আপাতত সপ্তাহে এক বা দুই দিন অফিস করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মদিবস বাড়ানো হবে।

পঞ্জিকা অনুযায়ী যেমন চাঁদ অমাবস্যা থেকে এসে একেবারে ছোট আকারে উদিত হয়ে পূর্ণিমায় যৌবন ফিরে পায়, ঠিক তেমন করোনার অন্ধকার সময় একদিন শেষ হয়ে যাবে। আসবে সুদিন, আসবে সুবাতাস। মানুষ আবার লকডাউন শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেবে আর মনে মনে বলবে, বেঁচে থাকাটা আসলে খুব একটা খারাপ বিষয় নয়।