সম্মুখসমরে যারা দিয়ে গেল প্রাণ

করোনার এই দুঃসময়ে চারদিকে এত এত খারাপ খবরের মাঝেও সায়েদুজ্জামান সাহেবের বাড়িতে আজ এক অন্য রকম আনন্দের দিন। অনেক দিন পর এই বাড়ির সবাই আজ একসঙ্গে মিলিত হবে। ঠিক কত দিন আগে সবাই এমন একসঙ্গে হয়েছিল মনে করতে পারেন না সায়েদুজ্জামান সাহেব। 

সায়েদুজ্জামান সাহেবের তিন ছেলে দুই মেয়ে। মেজ ছেলে হাসানুজ্জামান বাড়িতেই থাকেন মা–বাবার সঙ্গে। হাসানুজ্জামানের দুই ছেলে এক মেয়ে। হাসান সাহেবের ছেলেমেয়েরা সবাই হাইস্কুলে পড়ে। মফস্বলে বাবার ছোটখাটো কয়েকটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আর গ্রামের জমিজমা দেখাশোনা করেন হাসান। বড় ছেলে শাহেদুজ্জামান প্রকৌশলী, চট্রগ্রামে শিপইয়ার্ডে চাকরি করেন। পরিবার–পরিজন ওখানেই। শাহেদুজ্জামানের এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনই কলেজ শেষ করে একজন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) আরেকজন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছে গতবার।


সায়েদ সাহেবের দুই মেয়ের একজন মরিয়ম, ছেলেমেয়েদের মধ্যে তৃতীয়, গৃহিণী, সপরিবারে ঢাকাতেই ছিলেন। মাইমুনার স্বামী সরকারি চাকরি করেন। মাইমুনা দুই সন্তানের জননী। সায়েদ পরিবারের চতুর্থ সন্তান, মরিয়ম দুই মেয়েসহ সপরিবারে প্রবাসী। মরিয়মের স্বামী প্রকৌশলী। আর এই বাড়িরই সর্বকনিষ্ঠ ছেলে আরিফুজ্জামান, পুলিশ বাহিনীতে। সম্প্রতি জেলা শহর থেকে পদন্নোতি পেয়ে বদলি হয়ে ঢাকায় এসেছেন। সপরিবারে ঢাকাতেই বসবাস করছেন আরিফ। আরিফের এক ছেলে, বয়স চার।


প্রায় দুই মাস আগে সায়েদ সাহেব তাঁর ছেলেমেয়েদের জানিয়েছেন, তিনি সবাইকে মার্চ মাসের মাঝামাঝির দিকে একসঙ্গে দেখতে চান। জরুরি কিছু পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছেলেমেয়েরা সবাই প্রস্তুতি নিতে থাকেন মার্চ মাসের মাঝামাঝি বাড়িতে একসঙ্গে হবেন। মরিয়মের জন্য ব্যাপারটি সহজ ছিল না। দুজনের ছুটি ম্যানেজ করে, ফিরতি টিকিট কেটে সপরিবারে দেশে আসা। অবশেষে মেয়েদের স্কুলের বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য তাঁরা দেশে আসার প্রস্তুতি নেন। বাবা ডেকেছেন, পারিবারিক জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করবেন, হাজার হোক ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দিন দেশে আসা হয়নি। মা–বাবার বয়স হয়েছে। অনেকটা বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী থাকেন দুজন প্রায়ই। মরিয়মের অনুমান করতে বাকি থাকে না কেন বাবা তাঁদের ডাকছেন। যদিও সাহস হয়নি মুখ ফুটে বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করার। ঠিক ফ্লাইটে ওঠার দুই সপ্তাহ আগেই বিপত্তিটা বাধে। বিশ্বব্যাপী করোনার ডামাডোল শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি বিষয়টি এতটা ভয়াবহ হতে পারে। ভেবেছিলেন তিন সপ্তাহে হয়তো ব্যাপারটা এতটা সিরিয়াস হবে না। বাবার সঙ্গে দেখা করে ঠিক মার্চের শেষ নাগাদ কানাডায় ফিরে আসতে পারবেন। সেটা আর মরিয়মের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঢাকা বিমানবন্দর থেকেই মরিয়মকে সপরিবারে হোম কোয়ারেন্টিনের পরামর্শ দেওয়া হয় দুই সপ্তাহের। দুটি অপশনের কথা বললেও বিমানবন্দর থেকে জানানো হয় তাঁরা যেন সম্ভব হলে ঢাকাতেই হোম কোয়ারেন্টিন করেন।


আরিফুজ্জামান সপরিবারে বিমানবন্দর থেকে মরিয়মকে নিতে এসেছিলেন। কথা ছিল তাঁর বাসায় দুদিন থেকে আরিফ এবং তাঁর পরিবারের সাঙ্গে মরিয়ম গ্রামের বাড়ির দিক রওনা হবেন। আরিফের বাসাতেই তাঁদের থাকতে হলো ১৪ দিন। ইতিমধ্যেই সবকিছু কেমন অতি দ্রুত ওলটপালট হতে শুরু করে। এক এক করে সব দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল একরূপ বন্ধই হয়ে যায়। অবস্থার ভয়াবহতা বিবেচনা করে মরিয়মের স্বামী একবার সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে না গিয়েই আবার কানাডা ফিরে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকিটের জটিলতার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। এদিকে বাংলাদেশে সব ধরনের অফিস–আদালত মার্চের ২৬ তারিখ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সাহেদুজ্জামান দুই সপ্তাহ আগেই ছুটি নিয়ে গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন সপরিবারে। মাইমুনা যোগ দিয়েছিলেন তাঁর দু–এক দিন পরেই। সবাই অপেক্ষা করছিলেন মরিয়ম আর আরিফের জন্য। এরই মধ্যে করোনার তাণ্ডব এসে সবকিছু কেমন এলোমেলো করে দিয়ে গেল।


অবশেষে মরিয়মের পরিবার এবং আরিফের স্ত্রী এবং ছেলে মার্চের ২৬ তারিখ গাড়ি ভাড়া করে গ্রামের বাড়িতে রওনা হন। অনেক চেষ্টা করেও আরিফ আর ছুটি ম্যানেজ করতে পারেননি। কথা ছিল সবাই বাড়িতে পৌঁছালে আরিফ দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবেন। সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাওয়ায় আরিফ ঠিকমতো সবকিছু ম্যানেজ করতে পারেননি। এর মধ্যে মরিয়ম তাঁর সঙ্গে দুই সপ্তাহ থাকার কারণে বাবার সঙ্গে দেখা করার বিষয়টিও যেহেতু পিছিয়ে গেল, তাই তিনি তাঁর বসকে বলে পূর্বনির্ধারিত ছুটি বাতিল করে মার্চের শেষ সপ্তাহে নেবেন বলে জানিয়ে রেখেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেটা আর সম্ভব হয়নি। সদ্য এসআইয়ের পদে দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসা আরিফ কোনোভাবেই এক দিনের জন্যও ছুটি মঞ্জুর করতে পারেননি। করোনা মোকাবিলায় নিত্যনৈমিত্তিক নতুন নতুন দায়িত্ব নিতে হয়েছে আরিফকে। তাই আরিফকে রেখেই বাকি সবাই বাড়ির দিকে রওনা হন।


সায়েদ সাহেবের কাছে মনে হচ্ছে আজ তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। ছেলেমেয়েদের তিনি এভাবে একসঙ্গে পাবেন ভাবতেই পারেননি। এতগুলো নাতি-নাতনি তাঁর। সারা বাড়ি যেন গমগম করছে। চারদিকে করোনার আতঙ্ক, কখন কী হয়। মেয়ে মরিয়মকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, ওরা কখন কানাডা ফিরতে পারবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। সবকিছুকে ছাপিয়ে একধরনের আনন্দে তিনি বিভোর। খুব সুন্দর সময় পার করছেন নাতি–নাতনিদের সঙ্গে। কখনো কখনো সায়েদ সাহেবের মনে হয় ইশ এই সময়টাকে কি কোনোভাবে বেঁধে রাখা যায় না? তিনি খুব ভালো করেই জানেন এটা কোনো দিনও সম্ভব নয়। এই আনন্দ মাত্র কদিনের। এই তো সব ঠিকঠাক হলেই আবার সবাই চলে যাবে যার যার গন্তব্যে। ইচ্ছা করলেই সময়ে–অসময়ে বাকি ছেলেমেয়েদের কাছে পেলেও মরিয়মকে তিনি তো আর চাইলেই পাবেন না। তাই সবার অলখ্যে কেন জানি তাদের দুজনের নজর একটু মরিয়ম আর তার মেয়েদের দিকেই বেশি। নাতনি দুটো কি সুন্দর হয়েছে। ফরসা পরির মতো। কারণে–অকারণেই তাদের কাছে ডাকেন। আদর করেন। জিজ্ঞেস করেন তারা কী খেতে চায়। কানাডা কেমন? কানাডাতে নানা-নানির কথা মনে পড়ে কি না? কী এক গভীর আনন্দের মধ্যে অনেক দ্রুত সময়গুলো পার হতে থাকে সায়েদ দম্পতির। এবারে তিনি যেন একদম সুস্থ অনুভব করেন। একা একাই বিছানা থেকে ওঠানামা করেন। একটু পরপর নাতি–নাতনিদের নাম ধরে ধরে কাছে ডাকেন। পঞ্চান্ন বছরের সুখ–দুঃখের সাথি তাঁর জীবন সঙ্গিনী স্ত্রী রাহেলা বেগমকে সারাক্ষণই ব্যস্ত রাখেন। মঝেমাঝে তিনি ভুলেই যান রাহেলা বেগমও তাঁর মতোই বয়স্ক। অতিশয় আনন্দের আতিশয্যে কখন যে দুচোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ে, সবার অলক্ষ্যে তাঁরা দুজনেই সেই অশ্রু খুব সাবধানে সংবরণ করেন। মেয়েরাও বাবা–মায়ের সর্বক্ষণই পাশেই থাকছেন। সায়েদ সাহেব বুঝতে পারেন এরপর আর কোনো দিন তিনি সবাইকে এমন করে একসঙ্গে কাছে পাবেন না। এমনকি কারও কারও সঙ্গে আর দেখা না–ও হতে পারে। তাঁর কেন জানি খুব স্বার্থপর হতে ইচ্ছা করে। করোনার কারণে কী যেন সব লকডাউন আর বিমান চলাচল বন্ধ থাকছে, থাক না আরও কিছুদিন। থাক না অনন্তকাল। অথবা এই সময়টাই স্থির হয়ে থাক। একটু পরপরই দুই মেয়েকে কাছে ডেকে আদর করেন। এভাবেই কাটতে থাকে সায়েদ পরিবারের সময়।


এত আনন্দের মাঝেও কোথায় যেন একটা শূন্যতা অনুভব করেন সায়েদ সাহেব এবং রাহেলা বেগম। কেন যে আরিফ আসতে পারল না। আসলে কত ভালো হতো। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে কি না ঠিক জানেন না তবে সায়েদ সাহেব তাঁর ছোট ছেলেকেই মনে হয় সবচেয়ে বেশি আদর করেন। মাঝে মাঝেই আক্ষেপ করেন, আরিফের চাকরিটাই ভালো হলো না। পুলিশের চাকরি কোনো চাকরি? নিজে সারা জীবন সরকারি চাকরি করেছেন ঠিকই কিন্তু পুলিশের চাকরিটাকে তিনি কোনোভাবেই ভালো বলে মেনে নিতে পারেননি। নিজের ছেলেমেয়েরা কেউ পুলিশের চাকরি করবেন, সেটা তিনি কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু পরিশেষে আরিফের কাছে তাঁকে হার মানতে হয়েছে। আরিফের একটাই কথা ছিল। যদি করতে হয় পুলিশের চাকরিই করবে। সায়েদ সাহেব অনেক বুঝিয়েছেন, দেখ বাবা, আমি জানি তুই খুব ভালো ছেলে। যেকোনো চাকরিতেই তুই ভালো করবি। কিন্তু আমাদের দেশে এই প্রফেশনটাকে একদম অন্য চোখে দেখা হয়। আমার জানামতে, আমার বন্ধুবান্ধব যারা পুলিশ অফিসার ছিল তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ভালো কিছু করতে পারেনি। অনেকের ছেলেমেয়েই মানুষ হয়নি। আরিফ একদিন একরকম ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত এবং বিরক্ত হয়েই বাবাকে বলেছিলেন, ছিঃ বাবা, তুমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এভাবে বলতে পারো না। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে সায়েদ সাহেব একদম চুপ হয়ে যান। ছেলেকে আর কোনো দিনও পুলিশ সম্পর্কে বিয়োগাত্মক কোনো কথা বলেননি। আরিফ এটাও বলেছিলেন, বাবা, আমি পুলিশ হয়ে ব্যতিক্রমী কিছু দেখাতে চাই। তোমার মতো অনেকের ভুল ধারণাকে ভাঙাতে চাই। সায়েদ সাহেব সেদিন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমি জানি বাবা তুই পারবি।


গত দুই দিনে আরিফকে তিনি অন্তত ২০ বার ফোন করে একটা প্রশ্নই করেছেন, বাবা, তুই কখন আসবি? আমরা সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছি। শেষ পর্যন্ত আরিফ বলেছেন, বাবা, আমি হয়তো শিগগরিই আসতে পারব না। এই মুহূর্তে পুলিশ বাহিনীর ওপরে অনেক দায়িত্ব। তোমরা তোমাদের সব জরুরি আলাপ সেরে নাও। আমার উপস্থিতি জরুরি বিষয় নয়। ভাইয়ারা–আপারা আছেন, তোমরা যা সিদ্ধান্ত নেবে আমার কোনো কিছুতেই কোনো আপত্তি নেই। সায়েদ সাহেব ভালো করেই জানেন, আরিফের কোনো বিষয়েই কোনো আপত্তি থাকবে না। আর তিনি সেটা নিয়েও বিচলিত নন। তিনি আসলে চেয়েছিলেন সবাইকে একসঙ্গে দেখতে। শুধু আরিফটাই বাকি রইল। আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।


গ্রামের দিকে করোনা এখনো সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। যা পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই ঢাকায়। সেই সঙ্গে নতুন করে নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরেও সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে আবার পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া নিয়ে কী সব হচ্ছে। সারাক্ষণই টিভিটা খোলাই থাকে। এই মুহূর্তে টিভি দেখার মানুষ একমাত্র সায়েদ সাহেব আর তাঁর বড় ছেলে শাহেদ। দুজনে বসে খবর দেখতে থাকেন আর নিচের স্ক্রলগুলো পড়তে থাকেন। শাহেদ খবরগুলো বিশ্লেষণ করে করে বাবাকে শোনান। মরিয়মের স্বামী মাঝেমধ্যে এসে বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দু–একটা গুরুগম্ভীর গভীর তত্ত্ব দিয়ে যান। তাঁর চোখে–মুখে দুচিন্তার ছাপ। মেজ ছেলে হাসানের এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই। ভাইবোন, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগনিদের আপ্যায়নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়, সেটা নিয়েই তাঁর চিন্তা বেশি। সায়েদ সাহেব মাঝেমাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ইশ আরিফ এলে কত ভালো হতো।


বড় ছেলে সান্ত্বনা দেন যে বাবা, ওর দায়িত্ব তো অন্য রকম। এখন তো আসতে পারবে না। দেখছ না ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশরাই তো অনেক বড় দায়িত্ব পালন করছে। দেখো কোথায় নেই পুলিশ। লকডাউন হলে পুলিশ লাগবে। যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ। মানুষ হোম কোয়ারেন্টিন মানছে কি না, সেটা দেখবে পুলিশ। বাজারঘাট নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ। আবার করোনায় যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের শেষকৃত্যের তদারকিতেও পুলিশ। পুলিশ কোথায় নেই?


সায়েদ সাহেব এবার অনেকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ওখানেই তো আমার সবচেয়ে বড় চিন্তা। আরিফের যদি কিছু একটা হয়ে যায়? এ রোগ তো শুনেছি অনেক ভয়াবহ রকমের ছোঁয়াচে।
শাহেদ বলেন, চিন্তা কোরো না বাবা। আমরা একটা অনেক বড় দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।


হুম বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি তো দেখছি সেই দুঃসময় উত্তরণের সব দায়িত্ব পড়েছে আমার ছেলের ঘাড়ে। কত করে বললাম কদিনের ছুটি নিয়ে চলে আয়। এল না। তার তো আবার বেশি দায়িত্ববোধ।
সায়েদ সাহেব এখনো ছেলেমেয়েদের যে বিষয়টি জানানোর জন্য সবাইকে একসঙ্গে ডেকেছেন, তা নিয়ে কথা বলেননি। কেন জানি তাঁর মন বলছিল একসময় হঠাৎ করে আরিফ এসে হাজির হবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরিফ বলবে এই যে আমি এসে গেছি। কিন্তু তা আর হলো কই। একসময় আরিফের ফোন আসে। ওপাশ থেকে আরিফের কণ্ঠস্বর খুব ক্লান্ত মনে হয়। একটু একটু করে কাশতে থাকে আরিফ। সায়েদ সাহেব বিচলিত হয়ে পড়েন।
বাবা তোর কি জ্বর আছে? একটু জ্বর আছে বাবা। কিন্তু তুমি আবার ভেবো না আমার করোনা হয়েছে।
কদিন হলো জ্বর?
এই তো কাল থেকে, কিন্তু বেশি জ্বর না বাবা। ঠিক হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে ফ্লু, বাবা ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা আরিফ, আমার কিন্তু ভালো মনে হচ্ছে না। ওষুধ খাচ্ছিস তো বাবা?
হ্যাঁ বাবা, খাচ্ছি।


পাশেই ছিল মরিয়ম। বাবার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, এই, তোর কি গা ব্যথা আছে, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট? করোনা পরীক্ষা কর তাড়াতাড়ি। দেরি করিস না কিন্তু।
ওপাশ থেকে আরিফ সম্মতিসূচক উত্তর দেয়। সায়েদ সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। কেন জানি তাঁর আজকে খুব দুশ্চিন্তা হতে থাকে।


এর পরের দৃশ্যপটগুলো খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। আরিফের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। তাঁর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে তাঁকে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের বিশেষ করোনা বিভাগে ভর্তি করা হয়। ভর্তির আগে পর্যন্ত বাড়ির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। হাসপাতালে ভর্তির পরে আর কোনোভাবেই আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয় না পরিবারের। দুঃসহ এক উদ্বিগ্নের মধ্য দিয়ে সময় কাটতে থাকে সায়েদ পরিবারের। বহুকাল পরের শ্রাবণের বারিধারার মতো ঝরতে থাকা আনন্দের অশ্রুধারা নিমেষেই ম্রিয়মাণ হতে থাকে। আস্তে আস্তে কমতে থাকে পুরো বাড়ির লোকজনের হইচই, আনন্দ–উল্লাস। সায়েদ সাহেব আর রাহেলা বেগম তাঁর বাকি দুই ছেলেকে বলতে থাকেন, তোরা কী করছিস? খোঁজখবর নে। ছেলেটার কী হলো? আহারে আমার ছেলেটা না জানি কত কষ্টে আছে। শুনেছি করোনা হলে নাকি ডাক্তাররাও ঠিকমতো দেখে না। এই তোরা আমাদের ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দে। আমরা ওর হাসপাতালে যাব। ওর সেবা করব। তাড়াতাড়ি কর। আমাদের পাঠানোর ব্যবস্থা কর। না না, তোর মা পারবে না, শুধু আমাকে পাঠা। ওরে আমার ছেলে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে আর আমি বসে বসে আরাম করব। এই হাসান, শাহেদ তোরা কই? আরিফকে ফোন কর। ওর হাসপাতালে ফোন কর। আমি আরিফকে দেখতে চাই। এখনই দেখতে চাই। এভাবেই আরিফের মা–বাবা দুজনে বিলাপ করতে থাকেন।

হাসান এবং সাহেদ কোনোভাবেই কোনো যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ফোন করেও কোনো রকম ইনফরমেশন পেতে ব্যর্থ হন। নিজেদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন যাও আছে তাদের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অনেকেই ফোন ধরলেও কেউই বাইরে যেতে পারবে না। যানবাহন থেকে শুরু করে সবকিছুই বন্ধ। সবার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরে শুধু একজন নার্স একবার ফোন করেছিলেন, তা–ও কথা বলেছেন আরিফের বউয়ের সঙ্গে। বলেছেন সব ঠিক আছে, আপনারা দোয়া করতে থাকেন।


মরিয়ম বাবাকে বোঝাতে থাকেন, বাবা, এই অসুখ হলে কাউকেই কাছে যেতে দেবে না। কোনো আত্মীয়স্বজন কাছে যেতে পারবে না, যা কিছু করার ওরাই করবে। তুমি চিন্তা কোরো না বাবা, আমরা সবাই দোয়া করছি, আরিফের কিচ্ছু হবে না। ও অনেক শক্ত ছেলে। বয়স্ক মানুষদের রিস্ক বেশি। সায়েদ সাহেবের মন কিছুতেই মানছে না। তিনি চিৎকার করে করে বিলাপ করতে থাকেন, ইয়া আল্লাহ, তুমি আমাকে এ কোন বিপদ দিলা? আমার নিষ্পাপ ছেলেটাকে তুমি রক্ষা করো। একটু পরেই আবার বলতে থাকেন, আরিফ রে তোকে কতবার বলছিলাম পুলিশের চাকরি নিস না, তুই আমার কথা শুনলি না। তুই বললি পুলিশ হয়ে তুই ব্যতিক্রমী কিছু করে দেখাবি। এই তোর ব্যতিক্রমী কিছু করা?


ছোট মেয়ে মাইমুনা বাবাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেন, বাবা, কেন এসব বলছ? আরিফের কিছু হয়নি তো বাবা। দেখো ঠিক হয়ে যাবে।
সায়েদ সাহেব আবারও বলতে থাকেন কেন তুই পুলিশের চাকরি নিতে গেলি? কেন? কেন? এবার বড় ছেলে কাছে এসে বাবাকে বলেন, আচ্ছা বাবা, পুলিশ না হলেই কি সব ঝামেলা মিটে যেত? অন্যদের করোনা হচ্ছে না? আর তুমি যে বলছ আরিফ ব্যতিক্রমী কিছু করে দেখাবে। দেখিয়েছে তো বাবা। ও কি ওর সততার পরিচয় দিয়ে যোগ্যতা দিয়ে মাত্র সবচেয়ে কম সময়ে এএসআই থেকে এসআই হয়নি? এই অল্প সময়ে দু–দুবার গোল্ড মেডেল পায়নি? এর চেয়ে আর কী দেখাবে বাবা? তুমি শান্ত হও।


আমি কি করে শান্ত হব? আমার ছেলে কোথায় আছে, কীভাবে আছে, বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে, কিছুই জানি না। তোরা কেউ কোনো খবর দিতে পারছিস না। আমি কী করে শান্ত হব।
এরই মধ্যে আরিফের বউ চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। ওর মোবাইলে হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। সেই নার্সটি ফোন করেছেন। ভিডিও কলে আরিফকে দেখাচ্ছেন। এবার সবাই ফোনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শাহেদ চেষ্টা করেন সবাইকে থামাতে। ওই তো আরিফ। মুখে ওসব কী লাগানো? আরিফ কথা বলছে না কেন? বাবা আরিফ, এই যে আমি তোর বাবা। এই যে তোর মা। সায়েদ সাহেব সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলছিলেন। ওই পাশ থেকে নার্স একজন ডাক্তারের হাতে ফোন দিয়ে বলেন এই নিন, আপনারা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন। সবাইকে শান্ত হতে বলেন ডাক্তার। শাহেদ আস্তে করে জিজ্ঞেস করেন, আরিফের অবস্থা এখন কেমন?
ডাক্তার শান্ত গলায় উত্তর দেন, এখনো কিছুই বলতে পারছি না। ওনাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। এই মুহূর্তে কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমরা আমাদের মতো আপ্রাণ চেষ্টা করছি, আপনারা দোয়া করুন।
ডাক্তার সাহেব ফোনটা কি একটু রোগীর কাছে নেওয়া যাবে? আমরা একটু কথা বলতাম।


না, আমরা রোগীর কাছাকাছি ফোন নিতে পারব না। আপনারা দোয়া করতে থাকুন। এই বলেই ফোন কেটে দেন ডাক্তার।
সারা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। একটু পরে আরিফের ঘর থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসতে থাকে। সেই কান্নার শব্দ একসময় রাতের সব নিস্তব্ধতাকে চাপিয়ে যায়। একটু আগেই আবার ফোন এসেছিল, ওরা জানিয়েছে আরিফ আর নেই। সায়েদ পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আস্তে ভলিউমে টিভিটা চলতেই থাকে। নিচে স্ক্রলে লেখা ভেসে ওঠে, এই মুহূর্তে একজন পুলিশের এসআই আরিফুজ্জামান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
সায়েদ সাহেব তাঁর চার বছর বয়সী নাতিকে কোলে নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন আর বলতে থাকেন, বাবা আরিফ, তুই না বলেছিলি দেখো বাবা, আমি পুলিশ হয়ে ব্যতিক্রমী কিছু দেখাব। এই ব্যতিক্রমী কিছু তোর আমাকে দেখানোর ইচ্ছে ছিল? তোর মনে এই ছিল? অন্যদিকে রাহেলা বেগম বারবার মূর্ছা যেতে থাকেন।


আরিফের মুখ শেষবারের মতো দেখার সুযোগ সায়েদ পরিবারের কারোরই হয়নি। আরিফকে দাফন করার সুযোগও পরিবারের কেউ পায়নি। সব আনন্দ, কোলাহল থেমে গিয়ে সায়েদ পরিবারে নেমে আসে শোকের মাতম। আরিফের বিয়োগ বেদনায় সায়েদ পরিবার হতবিহবল। এমনি করেই আরও কত আরিফকে প্রাণ দিতে হবে কে জানে।


আরিফের মতো হাজারো পুলিশ তাদের জীবনকে এই মুহূর্তে হাতের মুঠোয় নিয়ে দেশের সেবা করে যাচ্ছে। খেয়ে না খেয়ে রোদে জ্বলে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দেশের মানুষদের করোনামুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।
এসব সম্মুখসমরের যোদ্ধাদের আমাদের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে জানাই অকৃত্রিম অভিনন্দন এবং ভালোবাসা। আমরা প্রত্যাশা করি সরকার এসব বীর যোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র দিয়েই তাঁদের যুদ্ধে পাঠাবেন। আরিফুজ্জামানের মতো আরও যারা প্রাণ দিচ্ছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য সুগভীর সমবেদনা।

আরও পড়ুন: