মাদার্স ডের ভাবনা

মাদার্স ডে। আমি যতটা এমনিতে ভোকাল, ইমোশনের দিক দিয়ে ততটাই অন্তর্মুখী! মা দিবস নিয়ে ভাবছি কী লিখব! আমার মনে তেমন আহামরি গদ গদ মাতৃভক্তির গল্প আসছে না! 

ছোটবেলায় মায়ের গায়ের গন্ধ ভীষণ প্রিয় ছিল। বড় হওয়ার চক্রে পড়ে ভীষণ দম বন্ধ লাগত হাজারো নিয়ম–কানুনের বেড়াজালে! মনে হলো সময়টা দুম করে আমার স্বাধীন জীবনের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিল! আমি জেলে বন্দী আর মাকে কঠিন জেলার ছাড়া অনেক বছর আর কিছু মনে হয়নি। আমার প্রতিটি স্টেপ তার নখদর্পণে। শ্যেন দৃষ্টিতে সারাক্ষণ বন্দী। কাঁহাতক আর সহ্য হয়। স্কুল, কলেজ নজরদারিতে রেখে কাছ ছাড়া কলেজে। সেই স্বাধীনতায় ডুবে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার সেই সারাক্ষণ নজরদারিই ভীষণ ভালোবাসা ছিল। বুঝতে পারিনি।


কলেজ শেষ হওয়ার আগেই তার প্রথমে মানতে না চাইলেও তারই পছন্দে বিবাহ! তখন শুনতাম তার কান্না! আমিই তখন বিরক্ত হয়ে বলতাম, ‘তুমি নিজেই তো দূরে বিয়ে দিয়েছ!’


আমার কোলজুড়ে মেয়ে আসার পরে, দেশি নিয়মে মা এসে ছয় মাস থেকে গেল আমার সঙ্গে, বাচ্চাকে শক্ত করে দিয়ে গেল। মেয়ে আমার চোখের মণি! তার প্রতিটি অভিব্যক্তি আমি মনোযোগ দিয়ে দেখি! প্রথম উল্টে যাওয়া, প্রথম বসতে পারা, প্রথম দাঁড়াতে পারা, প্রথম হাঁটতে পারা, প্রথম দৌড়তে পারা! তার ভালো লাগা, ভালোবাসা চিনতে চিনতে নিজেকে চিনতে শিখি।


প্রথম হাসি, প্রথম সফট খাবার, ফিঙ্গার ফুড খাওয়া, প্রথম ভাত মুখে দেওয়া—কতটা অধীর আগ্রহ, দেখতে যে ও ওর ডেভেলপমেন্টের মাইলস্টোন রিচ করছে। তখন মনে হলো কেউ একজন এমনি করেই আমায় ভালোবাসত।


মা আমার সপ্তাহে দুই দিন রোজা থাকত, আমি যখন পেটে ছিলাম। অল্প বয়সের সন্তান আমি! বাবার পরিবারের সবার খোঁজ নিতে গিয়ে নাকি, কখনোসখনো আমার জন্য দুধ কেনার টাকায় টান পড়ত!


সেই তখন থেকে আঁচলে আগলে বড় করে যাচ্ছে! সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা না করতে পেরে, আর অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় নিজে কলেজে যেতে পারেনি, কিন্তু আমাদের পড়াশোনার হাতেখড়ি মেয়ের কাছে, তারই তত্ত্বাবধানে। হাজারো অবসটিকল এলেও শক্ত হাতে সব মোকাবিলা করে গেছেন, যাতে আমাদের পড়াশোনা বন্ধ না হয়, আমি যেন পড়াশোনার বাইরে কিছুতে আটকে না যাই!


আমার মেয়ে হওয়ার পরও সাপোর্ট দিয়ে বলেছেন, আমি দেখছি, তুমি পড়া শুরু করো! পরপর দু–দুটো বাচ্চা হওয়ার কারণে আমার পিছিয়ে পড়া দেখতে ভালো লাগত না তার। তার হতাশার কারণে আমাকে শক্ত হতে হতো। নিজের সংসার ছেড়ে আমার জন্য সব ছেড়ে চলেও এল একদিন।


আমার সংসার নিজের হাতে তুলে নিল! বছরের পর বছর। আমার পড়া শেষ হলো, কাজ হলো! আমি সেই ব্যস্ততাতেই ডুবে ভুলে গেলাম, মায়ের ত্যাগ! আমার সন্তানদের ত্যাগও। সবকিছু যেন এমনই হওয়ার কথা! সবকিছু গ্রান্টেড ভেবেই নিয়েছি! হয়তো এতে আমার নিজেকে ফেস করতে হয় না! বাস্তবতা ফেস করতে হয় না! বলাও হয় না, কতটা সৌভাগ্যবতী আমি! বলা হয় না, এই আমি মায়ের কঠোর শ্রম ছাড়া আমি নই। বলা হয় না কতটা কৃতজ্ঞ আমি। আমরা কখনো কেউ কাউকে বলি না ভালোবাসি, সেটা ভাববাচ্যে থাকে! সেটা ভালোবাসায় থাকে। প্রকাশ থাকে কাজে, ভাষায় নয়।


আমার মেয়ে ছোটবেলায় বিরক্ত করলে বলতাম, ‘আমি তোমার মা হব না!’ মেয়ে বলত, ‘মা, ইউ হ্যাভ টু বি মাই মাম! তোমার আমার মা না হয়ে উপায় নাই, যতই দুষ্টু হই।’ আমারও মাকে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘আমি তোমাকে হাজারো কষ্ট দিলেও তোমার উপায় নাই! তোমাকে আমারই মা হতে হবে!’ কারণ, তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, যাকে আমি কষ্ট দিতে পারি! যে আমার জন্য কষ্ট পায়, যার আমার জন্য উৎকণ্ঠা হয়। এভাবেই আমি ভালোবাসি। এর বেশি আমি পারি না।