টোকিওতে অন্য রকম চেরি ব্লোসম

গত বছরে হানামি (চেরি উৎসব) দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। গিওয়েন পার্ক, শিনজুকু। ছবি: লেখক
গত বছরে হানামি (চেরি উৎসব) দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। গিওয়েন পার্ক, শিনজুকু। ছবি: লেখক

সূর্যোদয়ের দেশ সম্পর্কে লাল–সবুজের দেশের মানুষের আগ্রহের কমতি ছিল না কোনো কালে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। এ জন্য প্রথম থেকেই দেশটি ছিল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। যে কারণে স্কলারশিপের আবেদনে এই দেশই ছিল আমার প্রথম পছন্দ।

বলছিলাম কাজ পাগল সুশৃঙ্খল একটি জাতি এবং একটি দেশ জাপানের কথা।

ক্যাম্পাসে শোভা বর্ধন করছে চেরি ফুল। ছবি: লেখক
ক্যাম্পাসে শোভা বর্ধন করছে চেরি ফুল। ছবি: লেখক

ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছি জাপানিজদের কঠিন অধ্যবসায়ের কথা, শুনেছি সেই বিখ্যাত গান, ‘ওগো বিদেশিনি তোমার চেরি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও, এসো দুজনে প্রেমে হই ঋণী’। জীবনে কখনো বিদেশিনীর হাতের চেরি ফুল নেওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল কি না, মনে করতে না পারলেও চেরি ফুল দেখার ইচ্ছা ছিল প্রবল। সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল ২০১৮ সালে আমার টোকিওতে আসার সুবাদে। একটি মৃত সাদৃশ্য অন্তসারশূন্য গাছের প্রতিটি পরতে পরতে যে মোহনীয় প্রাণের আবির্ভাব ঘটতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই চেরিগাছ এবং তার ফুল। এই দৃশ্য মানুষকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগায় এবং সঙ্গে এটাও শিক্ষা দেয় যে জীবনে সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী। কারণ, এই প্রাণজুড়ানো সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি সপ্তাহখানেক। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই এই চেরি ফুলের পাপড়িগুলো ঝরে যেতে শুরু করে। শীতের প্রকোপে জবুথবু হয়ে থাকা ফুলের কুঁড়ি একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পেলেই চোখ মেলে তাকায়। ধরণিকে জানান দেয় তার অপরূপ সৌন্দর্য এবং অবশেষে মুগ্ধতা ছড়িয়ে বিদায় নেয়।

চিত্রশিল্পীর রংতুলিতে সাকুরা (চেরি ফুল)। গিওয়েন পার্ক, শিনজুকু। ছবি: লেখক
চিত্রশিল্পীর রংতুলিতে সাকুরা (চেরি ফুল)। গিওয়েন পার্ক, শিনজুকু। ছবি: লেখক

চেরি ফুলকে জাপানিজরা বলে সাকুরা। বিশ্বের কয়েকটি দেশে পাওয়া গেলেও এটি জাপানের জাতীয় ফুল। সাধারণত গোলাপি, সাদা ও লাল রঙের ফুলের প্রাধান্য বেশি দৃষ্টিগোচর হয়। এক বিচিত্র গড়নের পাপড়ি দেখা যায় ফুলগুলোতে। সেই সঙ্গে গাছে গাছে আনন্দে মেতে ওঠে পাখপাখালি ও হরেক প্রজাতির রঙিন প্রজাপতি। সর্ব দক্ষিণের ওকিনাওইয়া থেকে সর্ব উত্তরের হোক্কাইডো সর্বত্র হয়ে ওঠে চেরি ফুলের স্বর্গরাজ্য। হাজার বছর ধরে এই ফুলকে নিয়ে জাপানিজরা রচনা করে চলেছে চিত্রকর্ম, সাহিত্যকর্ম, গানসহ অনেক কিছুই। সাকুরা যেমন বসন্তের আগমনী গান শোনায়, তেমনি চেরি ফুলের মাধুর্য জাপানিজদের চিন্তাচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের জোগান দেয়।

গত বছরে দর্শনার্থীরা উয়েনো পার্কে চেরি ফুলের ছবি তুলছেন। ছবি: লেখক
গত বছরে দর্শনার্থীরা উয়েনো পার্কে চেরি ফুলের ছবি তুলছেন। ছবি: লেখক

সাকুরা নিয়ে জাপানিজদের এই উন্মাদনা হাজার বছরের। এ জন্যই এর আগমনের সংবাদ জানাতে আবহাওয়া অধিদপ্তর বসে যায় নানা ধরনের হিসাব করতে এবং সে অনুযায়ী তারা জাপানের বিভিন্ন প্রিফেকচারে ফুল ফোটার আগাম ঘোষণা জারি করে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায়। মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জাপানের সর্বত্র তাপমাত্রা অনুযায়ী দেখা যায় চেরির সমারোহ। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে লাখো দেশি-বিদেশি পর্যটক বেরিয়ে পড়েন সৌন্দর্য দেখতে।

জাপানিরা চেরি ফুল ফোটার সময়ে একটি উৎসব উদ্‌যাপন করে। এর নাম হানামি। এটি জাপানিজ শব্দ, যার অর্থ ফুল দেখা বা ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করা। এ উপলক্ষে তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনসহ পার্ক এবং বাগানগুলোকে সাজায় মনোরম সাজে। রাতের বেলাতেও উৎসবের কমতি থাকে না। রাতের হানামিকে বলে ইওজাকুরা বা জোজাকুড়া বা নাইট সাকুরা।

নদীর তীর ঘেঁষে লাগানো চেরিগাছে কাগজের বল এবং কারুকার্য করা কাঠামোর ভেতর বাতি লাগিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। লাখো লোকের সমাগম হয় নদীর ধার এবং পার্কগুলোতে। নানা রকমের খাবারের পসরা বসে সেখানে। মাদুর বিছিয়ে পরিবারের সদস্যের সঙ্গে খাবার এবং পানীয় নিয়ে দলে দলে বসে যায় পরিবারগুলো। এটি এই সময়ে জাপানের একটি চিরাচরিত রূপ।

গত বছরে চেরিগাছের তলায় প্রিয়তমাকে প্রেম নিবেদন। ইয়োইয়োগি পার্ক, শিনজুকু। ছবি: লেখক
গত বছরে চেরিগাছের তলায় প্রিয়তমাকে প্রেম নিবেদন। ইয়োইয়োগি পার্ক, শিনজুকু। ছবি: লেখক

গত বছর আমি প্রথমবারের মতো হানামি উপভোগ করি এবং সঙ্গে ছিল ছোট ভাই বাপ্পা। যে জায়গাগুলোতে চেরি ব্লোসম উপভোগ করেছিলাম, তার মধ্যে অন্যতম ছিল উয়েনো পার্ক। সারি সারি প্রায় ৮০০ চেরিগাছ। ছিল শিনজুকুর গিওয়েন পার্ক। যেখানে রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ চেরিগাছের সারি, যার নিচে আছে বসার এবং চলাচলের অসংখ্য রাস্তা। শিনজুকুর গিওয়েন পার্কে দেখছিলাম জাপানিজ নবদম্পতির বিবাহোৎসবের ফটোশুটিং এবং প্রেম নিবেদনের অসাধারণ কিছু মুহূর্ত। সবকিছু যেন প্রকৃতির আপন হাতে গড়া। এ ছাড়া ছিল ইম্প্যারিয়াল প্যালেস ইস্ট গার্ডেন, সুমিদা পার্ক, মেগুরো রিভার, কাসাই রিংকাই পার্ক, ইয়োইয়োগি পার্ক, হিবিয়া পার্ক, কিনুতা পার্ক, হারাজুকু উদ্যানসহ বেশ কয়েকটি মন্দির প্রাঙ্গণ। এগুলোর মধ্যে অনেক জায়গায় গিয়েছিলাম জেআর লাইনের ভোর থেকে মধ্যরাতের বিশেষ ছাড়ের এক দিনের টিকিট কেটে। এ ছাড়া নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকেও প্রকৃত সাজিয়েছিল আপন মহিমায়।

গত বছরে ইয়োইয়োগি পার্কে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
গত বছরে ইয়োইয়োগি পার্কে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

এ বছরও বসন্ত এসেছে এবং সাকুরার আবির্ভাব ঘটেছে স্বর্গীয় সৌন্দর্য নিয়ে। কিন্তু কে জানত, পৃথিবীর মানুষকে প্রকৃতি বঞ্চিত করবে তার এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে! এ বছর করোনাভাইরাস মহামারিতে নিষিদ্ধ হয়েছে জনসমাগম। নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনী পার হবে এতটা অবাধ্যও জাপানের জনগণ নয়। বিনয়ী এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে যে তারা বিশ্বসেরা! নেই লাখো দেশি–বিদেশি পর্যটকের ভিড়। চারদিকে সুনসান নীরবতা। বসন্তের ঐশ্বরিক পরশের পরিবর্তে আতঙ্কের বেড়াজালে আবদ্ধ পৃথিবী। জীবন ইটকাঠের দেয়ালে বন্দী। চীনের উহান থেকে এ বছরের শুরুতে যে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি তার ধাক্কা লেগেছে বিশ্বের অন্য প্রান্তের মতো টোকিওর বসন্তে। এমনিতেই এরা অনেক সচেতন জাতি। প্রথম থেকেই দেখেছি একটু ঠান্ডা বা সর্দি লাগলেই তারা মাস্ক ব্যবহার করে। কিন্তু সেটা নিজের জন্য নয়, যেন অন্যরা আক্রান্ত না হয় সে জন্য! পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতায় বা স্যানিটেশনে তারা বরাবরই অনুকরণীয়। তাই এই মহামারি তাদের জীবনে স্বাভাবিকের থেকে যে ছন্দপতন ঘটিয়েছে, সেটা বলাই যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হানামি উৎসব এ বছর বাতিল করা হয়।

তবু জীবনের তাগিদে থেমে থাকে না কিছুই। জাপানিজরা এবার হানামি উদ্‌যাপন করেছেন অনলাইনে। সোশ্যাল মিডিয়াতে জাপানিরা #virtualhanami হ্যাশট্যাগ দিয়ে সাকুরার ছবি এবং ভিডিও শেয়ার করছেন। সঙ্গে অনেকে যুক্ত করছেন নানা রকমের মন্তব্য। যেমন: ‘সামনের বছর আবার সাকুরা উদ্‌যাপন করব, বাইরে যেতে পারছি না তাই বলে কি আনন্দ থেমে থাকবে! ঘরে বসে সাকুরা উদ্‌যাপন করব’ ইত্যাদি। কেউ কেউ লিখছেন, ‘আমরা এখন বাইরে যেতে পারছি না, তবে এর অর্থ এই নয় যে আমরা সাকুরা উদ্‌যাপন করতে পারব না’।

দর্শনার্থীশূন্য টোকিওর অন্যতম পর্যটন স্পট ওদাইবা। এপ্রিল, ২০২০। ছবি: লেখক
দর্শনার্থীশূন্য টোকিওর অন্যতম পর্যটন স্পট ওদাইবা। এপ্রিল, ২০২০। ছবি: লেখক

জাপানিজরা তাদের ঐতিহ্য এই চেরিগাছ যাদের বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ উপহার দিয়েছিল, সেই ইউরোপ–আমেরিকাতেও ফুটেছিল চেরি ফুল। কিন্তু হয়নি কোনো উৎসব। পৃথিবী যে আজ থমকে গেছে এই একটি জায়গায় এসে। তারপরও ঘুরে দাঁড়াবে মানুষ, যেমন করে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে আছে ফুকুশিমার মিহারু এলাকায় সহস্র বছর বয়সী চেরিগাছটি, নাম তাকিজাকুরা বা ওয়াটারফল চেরি ট্রি। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা এই মহামারি করোনাভাইরাসও এক চুল টলাতে পারেনি তাকে।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, জাপান এবং সহকারী অধ্যাপক, ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়