এলেম আমি কোথা থেকে

মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

আমার মাকে ছেড়ে আজ প্রায় এক যুগেরও বেশি আমি দূরে। দূরে মানে প্রিয় মাতৃভূমি থেকেও যোজন মাইল দূরে। স্বামী ও সংসারের কারণে কখনো আমেরিকা তো কখনো অস্ট্রেলিয়া। এই ভৌগোলিক দূরত্ব ও জীবনের অতিবাহিত সময়ের পরিব্যাপ্তি যতই দীর্ঘতর হয়েছে, মাকে যেন ততই নিবিড় করে অনুভব করেছি। মাকে অনুধাবন করতে শিখেছি একজন মা হিসেবে, কিংবা তার চেয়েও বেশি একটি মেয়ে হিসেবে। আজ পাঠকদের জন্য সেই গল্পটাই আমি লিখছি, যেখানে এক সাধারণ মেয়ে কীভাবে এক অসাধারণ মা হয়ে উঠেছে।

প্রায় সব বাচ্চারই একটা সাধারণ প্রশ্ন থাকে মায়ের কাছে। মা, আমাকে তুমি কোথায় পেলে? আমি তোমার কাছে কীভাবে এলাম? একেকজন মা উত্তর দেন একেকভাবে, খুব সুন্দর একটা গল্প বানিয়ে। কেউ বলেন, তোমাকে হাসপাতাল থেকে কিনে এনেছি। সব বেবির মধ্যে তুমি ছিলে সবচেয়ে সুন্দর বেবি। তাই তো আমি তোমাকে নিয়ে এলাম। কেউ বলেন, আমি আর তোমার বাবা আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করেছি, তারপর খোদা খুশি হয়ে স্বর্গের সবচেয়ে সেরা বেবিটা আমাদের কাছে পাঠালেন। আমরা তোমাকে পেলাম। আবার কেউ কেউ বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে বলেন, একদিন হঠাৎ আমার ভীষণ পেটে ব্যথা হচ্ছিল, তাই ডক্টর আংকেলের কাছে গেলাম। ডক্টর আংকেল টামি চেক করে বললেন, আরে এখানে তো একটা ডলি বেবি আছে, ওকে টামি কাট করে এখনই বের করতে হবে। তারপর আম্মুর পেট কেটে ডক্টর আংকেল তোমাকে বাবার কোলে দিলেন।

ভয়ংকর কষ্ট ও আনন্দের আসল গল্পটাকে এভাবেই শিশুতোষ রূপ দেন মায়েরা। বাচ্চারাও মিটিমিটি হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে সেই গল্প শুনিয়ে বেড়ায় তাদের বন্ধুদের। এভাবেই শিশু মনে সঞ্চারিত হয় সৃষ্টির প্রথম জ্ঞান। আধো আলো আধো ছায়ায় তাদের জন্মবৃত্তান্ত।

মুক্তিযুদ্ধের মাত্র কয়েক বছর পরের কথা। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই কানিজের বিয়ে হয়ে গেল। মাস্টার্স আর করা হলো না। খুবই সাদামাটা একটা বিয়ে। যেন এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে থেকে একই ধরনের আরেকটি পরিবারের বউ হওয়া। তবু বিয়ের পর দিনগুলো ভালোই কাটছিল তার। সুদর্শন স্বামী আর সহজ–সরল মানুষবেষ্টিত শ্বশুরবাড়ি। মন্দ কি? উপরন্তু স্বামী যে স্কুলের হেডমাস্টার, সেই স্কুলে একটা চাকরিও হয়ে গেল তার। একেবারেই সাধারণ, নির্ঝঞ্ঝাট একটা জীবন।

দেখতে দেখতে বিবাহিত জীবনের তিনটি বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু এই তিন বছরেই নিঃশব্দে পাল্টে গেল কানিজের চারপাশ। কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন না করেও তার কোনো সন্তান হলো না। তাকে ঘিরে চলতে লাগল কানাঘুষা। আড়ালে সবাই তাকে ‘বাঁজা মেয়েমানুষ’ ডাকতে শুরু করল। এমনকি ভালো মানুষ স্বামীটিও করুণার দৃষ্টিতে দেখতে লাগল মেয়েটির অক্ষমতা। হ্যাঁ, সংসারে বাচ্চা জন্ম না দিতে পারা মেয়েটির অপারগতা। যে সমাজে আজও মেয়েটিকেই দায়ভার বহন করতে হয় সবার আগে, সেখানে কানিজের সমাজ তো আরও চার দশক পুরোনো। তাই মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়ল সে। শুরু হলো ডাক্তারের দরজায় দরজায় ধরনা দেওয়ার পালা। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, তাবিজ-কবচ সব চলতে লাগল একে একে। কে জানে কোন অছিলায় ওপরওয়ালা সদয় হন। শিক্ষা, বিশ্বাস, আধুনিকতা সব মিলেমিশে একাকার হতে লাগল। ‘মা’ যে তাকে হতেই হবে, সারা দিন কাঁদে কাটে আর বিবাগী হয়ে ঘুরে বেড়ায় কানিজ। কখনো কখনো আনমনে গুনগুন করে।...

‘যে মায়ে রে মা বলে কেউ ডাকে না,
সে মায়ের বুকের কি আগুন,
কেউ তো জানে না রে মানিক,
কেউ তো জানে না’

এমন সময় এক আত্মীয়া খবর দিল যে নওগাঁ জেলায় এক কবিরাজ আছে, যার নাকি বেশ হাতযশ। অনেকেই সফল হয়েছে তার কাছে গিয়ে। মেয়েটির মা বলল, যা না একবার। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? ক্ষতি তো আর নেই কোনো। হায় রে ক্ষতি! এক একবার বিফল হওয়ার পরের ক্ষতিটা যদি সত্যিই কেউ অনুভব করতে পারত!

তবু কলেজে পড়া ছোট বোনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কানিজ, কবিরাজি চিকিৎসা নিতে। নাটোর থেকে লোকাল বাসে করে দীর্ঘ সময় পর পৌঁছাল সেখানে। ক্লান্ত দেহে অবশেষে কবিরাজের বাড়ি। দেখা মিলল কবিরাজের। কবিরাজ আর কেউ নয়, একজন ৭০ বছরের বৃদ্ধা। তিনি প্রথমে তার নাড়ি চেপে ধরলেন, চোখ দুটো বুজে খুব মনোযোগসহকারে। কিছুক্ষণ পর ধীরে চোখ মেলে তাকালেন, আর বললেন, আহা রে! কত ছাওয়াল নষ্ট হয়া গেসে মা, আরও আগে আসিস নাই ক্যান?

কানিজের বরাবরই লেট পিরিয়ডের সমস্যা ছিল, তবে তার মধ্যে কোনো মিসক্যারেজ ছিল কি না, সে বলতে পারে না। যাহোক, মহিলা ওষুধ হিসেবে তাকে একটা গাছ দিল। আর কীভাবে তা খেতে হবে বুঝিয়ে বলল। কানিজ গাছটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বসে আছে। এই গাছটার জন্যই সে এতটা আগ্রহ করে এসেছে? এই গাছ তো বাড়ির উঠানের আশপাশে সে বহুবার দেখেছে। এই ছোট্ট গাছটার এত গুণ! এত ক্ষমতা!

গাছটা খুব সাধারণ হলেও তা খাওয়ার নিয়মগুলো বেশ অদ্ভুত। অনেকটাই রূপকথার গল্পের মতো। যেন ‘সাত ভাই চম্পা’র সেই ছোট রানি, অথবা ‘বারো হাত কাকুরের তেরো হাত বিচি’র সেই শসার বোঁটা খাওয়ার গল্পের মতোই রোমাঞ্চকর। মাসের বিশেষ এক অধ্যায়ে অর্থাৎ পিরিয়ডের পরপর এক মঙ্গলবার, সূর্য যখন মধ্যাকাশে কানিজ গোসল করে পবিত্র হয়ে নেয়। এরপর ভেজা কাপড় দোরগোড়ায় ফেলে একা একটি ঘরে প্রবেশ করে। সেখানে আগে থেকেই শিলপাটায় রাখা আছে ২২ জোড়া গোলমরিচ, কাণ্ড থেকে গাছটির শিকড় অবধি আর দরজার চৌকাঠ থেকে চেঁছে নেওয়া এক টুকরো কাঠ। কানিজ সবকিছু নিজ হাতে পাটায় পিষল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার। মাঝেমধ্যেই ভাবছে তার শিক্ষিত মা–বাবা কি এই বিশ্বাসেই বড় করেছিল তাকে? তারা কি কখনো ভেবেছিল যে তাদের মেয়ে একদিন শুধু সন্তানের আশায় এসব কিছু করতেও রাজি হবে?

চোখ মুছে ঘরে রাখা কেরোসিনের চুলা জ্বালাল কানিজ। তাতে একটি হাঁড়ি চাপিয়ে বসিয়ে দিল আলো চালের ভাত। রান্না হয়ে গেলে শিকড়বাটা দিয়ে আলো চালের নরম ভাত খেয়ে নিল। নিয়ম অনুযায়ী উচ্ছিষ্ট ভাত ও ওষধটুকু একটি মাটির হাঁড়িতে রেখে হাঁড়িটা বাড়ির পাশের পুকুরে ভাসিয়ে দিল। অর্থাৎ পাত্রটির চারপাশে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘিরে সেটাকে ভাসিয়ে রাখল। ওই দিন সারা দিন তার মৌন ব্রত। এরপর সাত দিন অপেক্ষা করার কথা। সাত দিন পর এই পাত্রে যদি পোকামাকড় এসে জমা হয়, তার মানে সুলক্ষণ, নতুন প্রাণের সম্ভাবনা রয়েছে।
দেখতে দেখতে সাত দিন পর হয়ে গেল। দুরুদুরু বক্ষে গিয়ে মাটির পাত্রটি নিয়ে এল কানিজ। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। আচ্ছা, সত্যিই যদি কোনো কীটপতঙ্গ না এসে থাকে? কিংবা যদি তারা ভাত খেয়ে ফিরে গিয়ে থাকে? যদি...কিছুই আর ভাবতে পারছে না সে। বুকের ভেতর শুধু গুনগুনিয়ে ওঠে,

‘ফুলে ফলে ফলত যদি এ দেহ মাটি
মানিক রে তোর মা ডাক শুনে জনম যেত কাটি’

চোখ বন্ধ করে কাঁপা হাতে ধরে আছে ভাঁড়টি। সাহস করে উল্টে দিতেই পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। আর সেই পচা ভাত গলিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল একে একে অনেকগুলো কাঁকড়া, সঙ্গে ছোট ছোট পোকামাকড় তো আছেই।

মনে হলো যেন পাথর নেমে গেল বুক থেকে। মনে হলো, ওগুলো যেন পোকামাকড় বা কাঁকড়া নয়। ওরা হলো সৌভাগ্যের রাজদূত, সোনার কাঠি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে কানিজের দিকে। নোনতা জলে ভিজতে লাগল কানিজের হাসিমাখা ঠোঁট। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কানিজের মা হেসে বলে উঠলেন, কাঁকড়ী হবে, কাঁকড়ী। অর্থাৎ কন্যাসন্তান।

মজার ব্যাপার হলো, এরপর কানিজের আর পিরিয়ড হলো না। কয়েক মাস পর ঠিক এক মঙ্গলবারে একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের মা হলো। আরও মজার ব্যাপার হলো, বাচ্চাটি কর্কট মানে কাঁকড়া রাশির জাতিকা।

ফুটফুটে পরির মতো মেয়েটি আধো আধো স্বরে, প্রায়ই কানিজের গলা জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে, ‘মা, আমাকে তুমি কোথা থেকে পেলে?’ কানিজ মিটিমিটি হাসে, আর বলে, ‘তুই লুকিয়ে ছিলি এক গাছের আড়ালে। আমাকে দেখেই ঝাঁপ দিয়ে এলি আমার বুকে। আর আমি তোকে শক্ত করে ধরে ফেললাম। তাই তো তোর নাম রেখেছি তমাল।’ মায়ের কথা শুনে, মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে তমাল। সেই হাসির শব্দ ভাসিয়ে নিয়ে যায় কানিজকে রূপকথার মতো সেই দিনটিতে।