মা দিবস এবং একটি অসম্পূর্ণ সন্তান

মাদারস ডে ২০১৮। ওভার হেড স্পিকারে হাসপাতালে কোড রেড ট্রামা কল করে। একটি ২৩ বছরের পাকিস্তানি আমেরিকান যুবককে প্রায় মৃতাবস্থায় একটি মোটেলে পাওয়া যায়। ধারালো ছুরি দিয়ে তিনি শরীরের বিভিন্ন স্থানে কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, এলোপাতাড়ি ছুরির আঘাতে ফুসফুস, পাকস্থলী অকেজো হয়ে যায়, রক্তের পরিমাণ শূন্যের কোঠায়। মা দিবসে মায়ের উদ্দেশে সেই ছেলের চিঠি।

মাগো,

তোমার গর্ভে আমার জন্ম। তোমার পরপর তিন কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার লজ্জা ঘোচাতে তোমার পুত্রসন্তান জন্ম না দিতে পারার অক্ষমতা ঘোচাতে, তোমার কোল আলো করে আমি এসেছি।
আমি তোমার ছেলে, তোমার পুত্রসন্তান তোমার বংশের প্রদীপ। জন্মের পর আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আমার তিন বোনের চেয়ে তুমি কি আমাকে আরও একটু বেশি আদরে বুকে চেপে ধরে রেখেছ? তোমার দুচোখে কি বয়েছে শ্রাবণের ধারা!

মাগো, তুমি কি আমার কানে কানে বলেছ, ‘তুই আমায় রক্ষা করেছিস বাবা। তুই আমার সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিস। তুই যে আমার রাজপুত্র!’ তবু আমাকে নিয়ে আমার বোনের কত খেলা, কত আয়োজন। আমার দাদু, চাচু, যাঁরা এত দিন আমার অপরূপ বোনদের দূর দূর করে সরিয়ে রেখেছেন, তাঁরাও আমাকে কোলে তুলে নিয়েছেন। বাবা অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়ি, লাটিম, ফুটবল কত খেলনা নিয়ে এসেছেন। আমার বোনেরা যদি কোনোদিন সেই লাটিম হাতে তুলে নিত, কিংবা আমার গাড়ি, কিংবা বল! সবাই হা হা করে উঠতে, এটা মেয়েদের খেলনা নয়। যাও হাঁড়ি–পাতিল নিয়ে খেল। পুতুল খেল।

সংসারের দীনতাকে তুচ্ছ করে আমার মেজ বোন তবু গাড়ি হাতে দাঁড়িয়ে থাকত। ‘এ মেয়ে তো গেছো মেয়ে হবে’ বলে আমার দাদু ছিনিয়ে নিয়েছে খেলনা, গাড়ি। তাঁদের জন্য কোনোদিন হাঁড়ি–পাতিল কিংবা পুতুলও আসেনি বাসায়।


মাগো, তুমি আমার নিরুপায় অসহায় মা, কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে তুমি কন্যাদের প্রাণভরে আদর করতেও শেখনি। আশ্রয়–প্রশ্রয় কিংবা ছাতার মতো আগলে রাখতে শেখনি। তোমার প্রচ্ছন্ন উদাসীনতায় তারা বেড়ে উঠেছে সংসারের অবহেলায়।


রুইয়ের মুড়ো, ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর ইলিশ মাছের ডিম, বাবার পর আমার পাতেই তুলে দিতে তুমি। আমার বোনেরা কোনোদিন দাবি করেনি তোমার কাছে। তোমার সে লজ্জা তাড়া প্রকট করেনি মা! শুধু চেয়ে চেয়ে থেকেছে, জানি না সেই দৃষ্টিতে লোভ ছিল কি ঘৃণা। কার প্রতি!

বাইরে খেলতে যেতাম, ফুটবল, হাডুডু, ক্রিকেট। আর আমার বোনেরা বারান্দার শিক ধরে দাঁড়িয়ে দেখত। আমার সঙ্গে বাইরে এসে তারা কোনোদিন খেলতে পারেনি। মেজ, যে আমার সবচেয়ে কাছের সে দু–একবার নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু ‘পড়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে’ এই হুমকির কাছে সেও পরাজিত।

মাগো, আমি আর পারছি না মা, এই রাজপুত্র হয়ে থাকার, বংশের বাতি হয়ে থাকার অভিনয়ে আমি ক্লান্ত। আমি আজ বিদায় নিতে চাই মা। তুমি হাসি মুখে বিদায় দাও। আমি চলে যাচ্ছি মা। আমাকে তুমি ক্ষমা কর। যে পুরুষ হয়ে জন্ম নিয়ে আমি তোমার কলঙ্ক মোচন করেছি, সেই দেহের দাবি নিয়ে তোমার অসম্মান আমি করতে পারব না মা।

আমার এ দেহে অন্য মানুষের বাস, এই দেহ সমাজের গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তার ভেতরে যে আমি, তাকে ধর্ম গ্রহণ করে না, সমাজ গ্রহণ করে না, তোমার কি সাধ্য তুমি গ্রহণ করবে!
মা, তুমি তো আমার বোনদের জন্য কখনো মা হয়ে উঠতে পারনি। আমার জন্য কী করে তুমি হবে! ওদের চোখের দিকে চেয়ে দেখ মা, জন্মের অপরাধে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখেনি। ওদের একটু মাথা উঁচু করে বাঁচতে দাও।

মাগো,
আজ আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, আমি তোমার অসম্মানের কারণ হয়ে বাঁচতে পারব না মা, বাবাকে সমাজের কাছে নিচু হতে দিতে আমি পারব না মা। এই যে দেখ তোমার রাজপুত্রের শরীর বেয়ে ঝরে পড়ছে উষ্ণ রক্ত। মাগো আমার কষ্ট হচ্ছে না তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টের অপমানের এই মিথ্যা জীবন, এই মিথ্যা বেঁচে থাকা। মেজকে বল সে যেন তার এই বোকা ভাইটিকে ক্ষমা করে। ধীরে ধীরে সব রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে কী প্রশান্তির, এ যেন ভুলে থাকার মন্ত্র। ধারালো ছুরি দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কেটেছি যেখানেই বয়ে যাচ্ছে প্রাণের স্পন্দন। এ কেমন ভুলে ভরা শরীর মাগো, কী যন্ত্রণা।

আমাকে ক্ষমা করো মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার সন্তান, সংসারে আমি একটি জীবাণু, যার বাঁচার অধিকার নেই। আমি তোমার সমকামী সন্তান মা, আমাকে ক্ষমা করো। আমি সমকামী হতে চাইনি মা, কেউ সমকামী হতে চায় না। তুমি তোমার এই অসম্পূর্ণ সন্তানকে ক্ষমা করো।