মায়ের কাছে প্রবাসী ছেলের খোলা চিঠি

প্রতিকী ছবি
প্রতিকী ছবি

মাগো মা,

আমার ভালো লাগে না। আমি দেশে যাব। মা, আমি তোমার কাছে যাব। তোমাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছা করছে। খুব দেখতে ইচ্ছা করছে তোমাকে। কী ভীষণ একাকিত্ব মা আমার। কী ভীষণ একা আমি মা। জন্ম শৈশব পেরিয়ে আসা কোলাহলের শহরটাই খুব ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে।
মা,

আমার চারপাশে ভয়ংকর এক নীরবতা। তেমন শীত না থাকা শহরটায় যেন আরও গড়িয়ে পড়ছে হিম বরফ। মৃত্যুর হাতছানি আমার আশপাশে বেশ জোরালো। ওত পেতে অপেক্ষা করছে মৃত্যু তার নিয়মের ব্যস্ততায়। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরে সুনসান নিস্তব্ধতা প্রায় সর্বকালের, যেটুকুও মানুষের চলাচল ছিল এ শহরে।

পৃথিবীতে মৃত্যু পরোয়ানা জারি হওয়ার পর থেকে গা শিউরে ওঠা নির্জনতা এখন সর্বত্র। শুধু গ্রোসারি শপের সামনে কেবল মানুষের কিছুটা গন্ধ পাওয়া যায়। তা–ও কারও সঙ্গে কারও কথা নেই। শব্দ নেই, কোলাহল নেই। অবশ্য চেনা মানুষগুলোও চেনার উপায় নেই, কারণ যেভাবে মাস্ক পরে সবাই সতর্ক। খুব খেয়াল করলে বোঝা যায় এই নিরাপদ শহরের মানুষগুলোর চোখ আজ মৃত্যুভয়ে কেমন বিবর্ণ হয়ে আছে। সব সময়ের চেয়ে আজকাল তোমাকে বেশি বেশি মনে পড়ছে মা। তোমাদের নিয়েও আমার ভয় করে। কী অদ্ভুত, তাই না মা। পৃথিবীতে এখন কোথাও কোনো নিরাপদ শহর–গ্রাম–লোকালয় নেই। অথচ তুমি সব সময় চাইতে আমার ভবিষ্যৎটা নিরাপদ হোক। নিরাপদ শহরে হোক আমার বসবাস। আমিও তাই চাইতাম। অথচ আজ! কতটা অনিরাপদ আমাদের পৃথিবী। আমাদের পৃথিবীর বিশ্বস্ত নিশ্বাসগুলো। কী ভয়ংকর, তাই না মা। আমি যদি আর বেঁচে না ফিরি। তোমাদের জন্য কিছুই তো করে যেতে পারলাম না মা। কেমন অদ্ভুত এক ব্যর্থতা নিয়েই চলে যেতে হবে আমায়। চলে যেতে হবে তোমাদের আদরের স্পর্শ ছাড়াই। মাঝে মাঝে একেবারেই ঘুমাতে পারি না মা। আমি যদি সত্যি অসুস্থ হয়ে পড়ি। কে দেখবে আমাকে? কে আমার মাথায় হাত বোলাবে? কে আমাকে চুমু খাবে মা? কে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলবে, সব ঠিক হয়ে যাবে, ইনশা আল্লাহ আব্বু। কে বলবে, এই তো আম্মু আছে তোমার কাছে।

মাগো, আমি কী হেরে যাচ্ছি। আমি কী হেরে যাব মা। তুমি সব সময় বলো সাবধানে থেকো। আমি তো এই শহরে একা। আমাকেই দেখতে হয় নিজেকে। আমার খাওয়ার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয়। আমাকে তো কম হলেও বাইরে বেরোতে হয়। বাসা থেকে একটা স্টেশন দূরত্বে আমাদের গ্রোসারি শপ। বাসে করে গিয়ে বিশাল বড় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি। আমরা এখন মানুষ ভয় পাই। মানুষ থেকে পালাই। কাউকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না।

ক্যাম্পাস বন্ধ, চাকরি নেই। হায়রে জীবন! বাঁচো আর মরো নিয়মের সূচিপত্র চলমানই থাকবে তার কেমিস্ট্রিতে। আমিও চেষ্টা করছি সেই নিয়ত সূচিপত্রের সঙ্গে তাল রেখে চলতে। আসলে কখনো কখনো মৃত্যুভয়কে হার মানিয়ে দেয় জীবনের পরাবাস্তবতা। যেমন আমাদের দেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ক্ষুধার্ত পেটে রিকশা চালাতে বের হয়ে কান ধরে ওঠবস করতে হয় শাস্তি হিসেবে একজন বৃদ্ধকে। জীবন বুঝি আমাদের বেশির ভাগ মানুষের একই সমান্তরালে চলে! পোশাকটা যা একটু ভিন্ন। সময়গুলোও যেন আগের চেয়ে বেশ ভারী হয়ে গেছে আজকাল। কারণে–অকারণে তোমাকেই খুব দেখতে ইচ্ছা করে। অর্থহীন ইচ্ছাতে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছা করে তোমাকেই। এখানে এখন কোনো বন্ধুকেও ছোঁয়া যায় না। আচ্ছা মা, কাছে থাকলে তুমিও কি আমাকে ছুঁতে দিতে না তোমাকে?

আমার মাঝে মাঝে খুব দম বন্ধ হয়ে আসে মা। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান–বিজ্ঞান গবেষণা সব আজ থমকে গেল মা। ওই টুকুন করোনা নামক অণুজীবের কাছে!

কী ভয়ার্ত বিস্ময় ! এলোমেলো ভাবনা পোড়ায় আমায়। বর্তমান অসহায়ত্বের কারণেই পোড়ায় জানি। মনে হয় কেন এত কষ্ট করে ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, গণিত পড়লাম ,শিখলাম? কী শিখলাম মা? সব তো ফেইল এখন। বড় বড় সায়েন্টিস্ট বধির হয়ে আছে প্রকৃতির একমাত্র করোনা বিস্ফোরণে!

কেন যেন ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ছে মা। কত কষ্ট করেছ তুমি আমাকে নিয়ে। সব মায়েরাই করেছে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠিয়ে তৈরি করে স্কুলে নিয়ে গেছ। সাতটার মধ্যে স্কুলে ঢুকতাম জ্যামের ভয়ে। তোমার কাছে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে যে মাত্র তিন বছর তিন মাস বয়সে ক্লাস শুরু করেছিলাম আমি। ক্লাসের সব থেকে বয়সে ছোট ছিলাম আমি। আমায় স্কুলে নামিয়ে তুমি কত দিন স্কুলের সামনে ফুটপাতে বসে থেকেছ। তুমি কত কষ্ট করেছ, আমাকে কষ্ট করিয়েছ মা। শুধু আমাকে লেখাপড়া শিখতে হবে বলে। আমাকে অনেক বড় মানুষ হতে হবে বলে। আমি আজ তাই এই দূর দেশে বড় হতে এসে, বড় বেশি একা হয়ে গেলাম মা। আমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ আমার মাকে ছাড়া হলাম পৃথিবীর এই ভয়ংকর বিপর্যয়ের দিনে।

কেন মা? কীভাবে এই আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসব, বলো মা?

এখন এই একটা অণুজীবের কাছে আমি যদি হেরে যাই মা। আর যদি কোনো দিন আমাদের দেখা না হয়। আমি ভাবতে পারি না। আমিও খুব বিষণ্ন হই, আতঙ্কিত হই মা। এই ভেবে আতঙ্কিত হই, আমি চলে গেলে তোমার যেমন কষ্ট হবে। তুমি চলে গেলে আমার যেমন কষ্ট হবে। তেমন কষ্ট তো ওই মায়েরও হচ্ছে বলো, যার ছেলেটা, মেয়েটা আজ এই মুহূর্তে মারা গেল। যার মা আজই মারা গেল। অসময়ে কেন আমরা পরাজিত হচ্ছি। কেন আমরা পরাজিত হলাম মা। জানো মা, অনেকেই বলে পাপ। বলে শাস্তি।
আচ্ছা মা, যে শিশুটির পাপের বয়স হয়নি, তার শাস্তিটা কি জন্মপাপ মা? কে দেবে এর জবাব আজ?
গত রাতে চারটার সময় আমার ফ্ল্যাটমেটের হাউমাউ কান্নায় আমি দৌড়ে তার রুমে গেলাম। কেমন উদভ্রান্তের মতো সে কাঁদছে। আমার চেয়ে না হলেও বছর পাঁচেকের বড় সেই ভাইয়াটা। তবুও সে আমাকে পাগলের মতো আঁকড়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদছিল। সে ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখেছে। সারা শরীর অদ্ভুত পোশাকে আবৃত কতগুলো লোক নাকি তাঁকে মোটা পলিথিনে পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কবরের কাছে। সে মরতে চায় না বলে সেই কি আর্তনাদ! বাকি রাতটুকু আমরা আর ঘুমাইনি।
জানো মা, আমি তখন তোমার মতো সাহসী হয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের আলোগুলো জ্বেলে তাকে খুব শক্ত করে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে রাখলাম। সাহস দিলাম।
তখনো খুব তোমার কথাই মনে পড়ছিল।
তুমি যে খুব করে চাও মা। তোমার ছেলে ইনশা আল্লাহ অনেক বড় হবে। সত্যি মা, তখন মনে হলো আমি বুঝি একটুখানি বড় হয়েছি।
মাগো, তবুও আমার তোমাকে ছাড়া একা একা খুব কান্না পায়। তোমাকে বিশেষ ধন্যবাদ মা, তুমি আমাকে কখনো কাঁদলে বাধা দিয়ে বলোনি, ছেলেদের কাঁদতে নেই। ছেলেদেরও কাঁদতে হয় মা। কাঁদলে বুকটা হালকা লাগে মাঝে মাঝে। আমাকে শুধু ছেলে না, তুমি মানুষ হতে শিখিয়েছ। তাই তো নিজের জন্য, সবার জন্যও কাঁদতে যেমন পারি, তেমনি সাপোর্ট দিতেও পারি। তবুও একাকিত্ব, গুমোট পরিস্থিতি, পৃথিবীর মৃত্যুযজ্ঞ আমাকে মাঝে মাঝে অসহায় করে তোলে।
খুব তোমার কাছে যেতে ইচ্ছা করে। কী অদ্ভুত।