চোখ যা দেখে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গত কয়েক দিন থেকে সমুনাদের অফিসে সবাই  স্টেস্ডআউট। টেকস্ট মেসেজ আসছে ছাঁটাই করা কর্মচারীর নামে, সেই কর্মচারীর কাছ থেকে, তাদের কাছে, যারা ওর সঙ্গে কাজ করত। থ্রেটেনিং মেসেজ, ছবি, হিউমিলিয়েশন কোনোটাই বাদ নেই। এমনকি অফিস উড়িয়ে দেবে, সিক্রেট দরজা দিয়ে এসে ধর্ষণ করে যাবে এসব হুমকি তাদের, যার যার সঙ্গে তার মোটামুটি কথা হয়েছিল যে কদিন কাজে ছিল, নতুনদেরও বাদ নেই। এমনকি তাদের সবাইকে গণহারে হেটফুল মেসেজ। স্বভাবতই পুলিশ ইনভলভ করা হলো।

অফিসে পুলিশ গাড়ি দেখে উপদ্রব আরও বেড়ে গেল। একটু পরপর মেসেজ আসে, ‘আমি পুলিশের গাড়ি দেখছি! কী করতে পারবে আমার? সবাইকে মেরে রেখে যাব।’ কাজের ফ্লোতে চরম বিশৃঙ্খলা! সবাই আতঙ্কিত—এত পুলিশের মাঝেও লোকটার সাহস কত! কাজের আশপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের চোখে চোখে রাখছে।


এরপর নতুন থ্রেট আসছে, ‘তোমাদের বাসায় গিয়ে আমি তোমাদের ক্ষতি করে আসব।’ এ অবস্থায় তার নামে ওয়ারেন্ট, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং দূরে থাকার পরোয়ানা মানে রেসট্রিকশন অর্ডার জারি হলো। পুলিশ ধস্তাধস্তি করে তারে ধরে জেলেও পুরল। কিন্তু কারও শান্তি এল না। মেসেজ আসতেই থাকল!

এবার মেসেজ আরও ন্যাস্টি, ওর গার্লফ্রেন্ডের নাম দিয়ে আসতে লাগল। অশ্লীল মেসেজ। আরও হুমকি। গার্লফ্রেন্ডের নামেও ওয়ারেন্ট বের হলো। পুলিশ দৌড়ে বেড়াতে লাগল। ইনভেস্টিগেশন করতে লাগল।

আমরা ভাবছি, আমাদের ভেতরেই কেউ ইনফরমার নয়তো, ক্ষণে ক্ষণে কীভাবে তথ্য আদান–প্রদান হচ্ছে। কীভাবে সবার নম্বর তার কাছে? ছাঁটাই হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। পুলিশের আনাগোনা বেড়েই চলেছে! প্রতিদিন অফিস আওয়ারে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি অফিসের নিরাপত্তায় লাগানো। মেইন সাসপেক্ট ধরা পড়ার পরও এসব টেকস্ট চালু থাকায় এবার তার সঙ্গে কাজ করা লোকগুলো ইনভেস্টিগেশনের মুখে।

সুমনা কাজের মাঝে এসব শুনতে পায়, একজন বলে, ‘পুলিশ আসছিল ওদের কুকুর নিয়ে, কী খুঁজছে জানো? মনে হয় ড্রাগ!’
সুমনার ড্রামা পছন্দ নয়, জানতেও চায় না, ইনভলভও হতে চায় না। পরদিন দেখে কয়েকজন কর্মচারী অনুপস্থিত। সুমনার তাতেও মাথাব্যথা নেই। কারণ, যা করার পুলিশ করছে এবং তাদের ইনভেস্টিগেশন চলছে। ও ড্রামা বন্ধ হলেই খুশি। কাজ ছাড়া ও আর কিছুতে ইন্টারেস্টেড নয়।
আর ওর এতে কোনো ইনভলভমেন্টও নেই।
এর মাঝে কয়েক দিন পার হয়েছে। আজ যেতেই সবাই বলে, ‘তুমি জানো কালপ্রিট ধরা পড়েছে?’
আমি জানি, ছেলেটি অলরেডি জেলে বলে সুমনা।

ওরা বলে, ‘তুমি কিছু জানো না। এখানে আরেকটি ছোট করে, প্রেগনেন্ট মেয়ে কাজ করত, সবকিছুর হোতা ওই মেয়ে।’ এর এক বছর বয়সী একটা মেয়ে আছে, দুদিন আগে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি আবারও প্রেগন্যান্ট কি না। তখন বলেছিল, ‘জিজ্ঞেস করো না, ওর মাত্র এবরশন হয়েছে।’
বলে, ‘ও আবারো প্রেগন্যান্ট হয়েছে! ওই ছেলের নামে যত মেসেজ পাঠাইছে, সবই ওই মেয়ে পাঠাইছে। ছেলের গার্লফ্রেন্ডের নামের মেসেজ ও ওই পাঠাইছে।’
আমি মুখের হাঁ বন্ধ করতে পারি না।
জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
বলে, জানি না। কিন্তু ওই ছেলে যখন কাজ করত, ওরে বলছিল, মেয়েটি নাকি ওর পরিচিত। ওরা এক জায়গা থেকে এসেছে।
মেয়েটি কাজ করে বছরের ওপরে। ছেলের কাজ কিন্তু মাসখানেকও ছিল না।
চমকের পর চমক!
বলে, ‘এই বর্তমানের বাচ্চা পসিবলি ওই ছেলের।’
আমার হাঁ আরও বড় হয়! মেয়ের বয়ফ্রেন্ড/ হাজব্যান্ড আছে। ছেলেরও লিভিং গার্লফ্রেন্ড আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, এই মেয়ের ইনভলভমেন্ট কীভাবে জানল পুলিশ?

বলে, এপারেন্টলি ছেলেটার সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল। ফরেনসিক টেস্ট করেছে ছেলের ফোন। কোথা থেকে মেসেজ আসছে। সেখানে মেয়ের সঙ্গে ওই ছেলের যোগাযোগ থেকে মেয়ের ফোন ফরেনসিক টেস্ট করে জেনেছে, সবকিছু এই মেয়ের করা। ছেলেটার কোনো ইনভলভমেন্টই নেই এতসব কর্মচারীকে থ্রেট দেওয়ার, বোমা মেরে অফিস ওড়ানো কি মেয়েগুলারে রেপ থ্রেট—সব, সব এই প্রেগন্যান্ট মেয়েটির কাজ। ছেলেটাকে ফ্রেম করেছে মেয়েটি। কারণ অজ্ঞাত। মেয়েটিই মাস্টারমাইন্ড। এখন ছেলের নামে যত কেস ছিল সব এই মেয়ের নামে ট্রান্সফার হয়েছে এবং পসিবল জেলে লং টাইম রট করবে। সবাই খুশি। বলে, ‘পাইলে ওর পাছায় চাবুক মারতাম।’

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এই মেয়ে যাদের এসব টেকস্ট পাঠিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে, বাজে ছবি, বাজে নামে ডেকেছে, রেপ, খুনের ভয় দেখিয়েছে, তারা তাকে রাইড দিয়েছে, একসঙ্গে খেতে গিয়েছে, খুব ভালো বন্ধুত্ব এদের! অথচ রাইডে গিয়ে, এক গাড়িতে বসেই সে নাকি এসব টেকস্ট এদের পাঠিয়েছে, তাদেরই পাশে বসে, তাদেরই সামনে তারা একটিবারের জন্যও সন্দেহ করেনি একে। বুঝতেই পারেনি।
বরং সুমনা দেখেছে মেয়েটার ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার নাটক করা যখন এসব টেকস্ট এসেছে, এদের কাছে। মানে এদের টেকস্ট পাঠিয়ে এদের রিঅ্যাকশন ক্লোজলি অবজারভ করে, এদেরই সঙ্গে গলা মিলিয়ে নাটক করেছে। এদেরই সঙ্গে থানায় গিয়ে এজাহার জমা দিয়ে এসেছে ওই লোকের বিরুদ্ধে যার নাম নিয়ে সে এত নাটক করে বেড়িয়েছে! সেই লোকের বিরুদ্ধে রেসট্রিকশন অর্ডারও নিয়ে এসেছে! অস্কার পাওয়ার মতো স্ক্রিপ্টিং এবং অ্যাকটিং! হিউজ পারফরম্যান্স!

সুমনার হাঁ–টা আর বন্ধ হচ্ছে না! আরও শুনছে, যাকে ওর মনে হয়েছে তেমন ভয় পায়নি; তাদের আলাদা করে আরও ভীতিকর টেকস্ট পাঠিয়েছে। এমন কে করে, সাইকোপ্যাথ না হলে? একটিবার ও ধরা পড়ার ভয় নেই, জেলের ভয় নেই, ছোট বাচ্চা এবং বর্তমানের প্রেগনেন্সির ভয় নেই!
এবার না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, মোটিভ কী? এই লোকই যদি ওর পেটের বাচ্চার বাপ, তার সঙ্গে ওর এমন মাখামাখি সম্পর্ক, তার নাম দিয়ে কেন এসব করল? তাও করল তাদের সঙ্গে যার সঙ্গে ওর চর্মচক্ষে গলায় গলায় পিরিতি?

কারও সে উত্তর জানা নেই! এরা ওর শুধু দরকারি রাইডই না, গতবার বেবি শাওয়ার দিছে, দরকারে খাবার কিনে দেয়, খাবার ভাগ করে খায়, এদের সঙ্গে এমন নিমকহারামি?
সুমনা বিস্ময় থেকে বাস্তবে ফিরে, হঠাৎ করে হাসতে শুরু করে! এবার ওর মনে পড়ে এ রকম নিমকহারাম একজনকে সে খুব ভালো করে চেনে!

ওপরে গলায় গলা মেলানো সেই প্রিয় বান্ধবীর মিছরির ছুরির কথা হুট করেই মনে পড়ে তার! তার সে মিষ্টি কথায় শুধু সুমনা নয়, এখনো অনেকে আবেশিত! কাছের বন্ধুরা সমব্যথী হয়ে জানতেও চেয়েছে, এসব করে তার কী লাভ হয়েছে? কি উদ্দেশ্য ছিল? কারণ তার আকারে–প্রকারে সুমনার ক্ষতি করায় তার দৃশ্যমান কোনো লাভ হয়নি। সুমনা আসলেই জানে না। উদ্দেশ্য, মোটিভ? জাতে ওঠা? কাউকে টেনে নামানোর আনন্দ, কারণ তার সমকক্ষ হতে সে কোনো দিনই পারবে না। নিজের প্লট বিশ্বাসযোগ্য করা? কারণ সে সুমনার কাছে ঘেঁষতে পেরেছিল? সুযোগ নেওয়া। যা সে পাবে না, তা সুমনা পাবে? হিংসা? হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই। প্যাথলজিক্যাল, প্যাথেটিক মানুষের অন্যের ক্ষতি করার কি মোটিভ লাগে? হয়তো আজকের সূর্যোদয়টা চোখে লাগছে, বাতাসটা মোহনীয়, আকাশের রং কামনীয় কিন্তু সেটা আমার জন্য নয়! যেহেতু সেটা আমার জন্য নয়, চাইলেও পাব না; যে পাবে তার জীবনটাও বিবর্ণ করে দিই! নিজে পাব না, অন্যকেও পেতে দেব না! নিজের মিজারেবল লাইফে ফ্রাসটেটেড হয়ে, সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়, কারণ ছাড়াই অন্যের ক্ষতি করা! সাইকোপ্যাথের সাইকোলজি কীভাবে সুমনা এক্সপ্লেইন করবে? কেন সিরিয়াল কিলার মানুষ খুন করে, সেটা সুমনা জানে না। আজ এই ঘটনা প্রত্যক্ষ না করলে, সুমনা নিজের প্রতি তার প্রীয় বান্ধবীর করা অন্যায়ের ব্যাখ্যা আজও পরিষ্কার করে দিতে পারত না। কারণ টুইস্টটাই এমন যে অবিশ্বাস্য।

সুমনা এত দিন বিশ্বাস করেছে; হয়তো ওরই ভুল ছিল কোথাও, যেটা সে বোঝেনি। আজ সুমনা নিজের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারে, সুমনা ভুল করেনি। সুমনা এক সাইকোপ্যাথের জঘন্য মানসিক বিকারের শিকার ছিল। যাদের কোনো কারণ লাগে না অন্যায় করতে। অন্যায়ভাবে অন্যের জীবন বিষিয়ে তুলতে। আর যাদের জীবন বিষিয়ে দেয়, তাদেরই দোষী সাজায়। নিজের বিকৃত মানসিকতা ঢাকতে নিজেদের ভিকটিম সাজিয়ে, আসল ভিকটিমদের সবার চোখে অপরাধী সাজাতে এরা বড়ই পটু। মিষ্টি কথার অন্তরালে আসল অপরাধী! সুমনার মনে একটু দুঃখ হলো, সেদিন যদি সে সভ্য দেশে বাস করত। সমাজ, বন্ধুরা যদি আসলেই সত্যিটা জানত, বিশ্বাস করত! যদি ন্যায় বলে আসলেই সেদিন কিছু থাকত! কিন্তু ছিল না তো! বরং সুমনা বুঝতে না পেরে সবাইকে বলেছিল, তার সে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করতে কী হয়েছিল? সুমনা জেনেছিল অনেক পরে, কী কী মিথ্যে অপবাদ সে ছড়িয়েছিল সুমনার নামে! সুমনা বোকার রাজ্যে বসবাস করছিল তার সামনের এসব ভিকটিমদের মতোই—টোটালি ক্লুলেস!

নাহ। সুমনা এবার ভাবা বন্ধ করে আবারও কাজে মন দেয়। যা গেছে, গেছে! জীবনের ভোর সবার জন্য আলাদা। তবে সুমনা কখনোই ক্ষমা করবে না। হাসে যখন সঙ্গের সহকর্মীকে বলে যায়, ‘এই মেয়ে এ অবস্থাতেই এত ম্যানিপুলেটিভ, না জানি সে সত্যিই কত ভয়ংকর! আমরা এর সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। সঙ্গে ওর বিরুদ্ধে রেসট্রিকশন অর্ডার!’ সুমনা হাসতেই থাকে, ও যদি সেদিন একটা রেসট্রিকশন অর্ডার পেত সে বান্ধবীর বিরুদ্ধে! কষ্টটা মেনে নিতে সুবিধা হতো—এট লিস্ট শান্তি পেত মনে। একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ হতো! কেউ ওর হয়ে লড়েনি সেদিন। অন্যায়কে জয়ী হতে দেখেছে সেদিন। বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে সে দিন সবার ওপরে। অন্যায় না করেও শাস্তি পাবার কষ্ট ওর চেয়ে বেশি কে জানে? প্রিয় বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার এই করম টুইস্ট—ওর চেয়ে বেশি কে জানে! এদের সঙ্গে সমব্যথী হয়ে কাজে মনোযোগ দেয় ও। শুধু অবাক এমনিই এক অবিশ্বাস্য প্লট আরও একবার চাক্ষুষ করে। ঘটে এমন? ঘটতে পারে এমন? চাক্ষুষ না করলে কেউ বিশ্বাস করতে পরবে না! সুমনা অবাক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ওরই সামনে অন্যদের জীবনে ও ঘটতে দেখে। জীবনে দেখার মতো কত কিছু যে আছে!