মায়ের মা

সুনসান রোববার সকালে কাপড় ইস্ত্রি করছিলাম। আগামীকাল থেকে আবারও ব্যস্ত একটা সপ্তাহের শুরু। যদিও করোনার কাল। কিন্তু সপ্তাহে পাঁচ দিন বাইরে যাওয়ার কাজ। ফুল টাইম/পার্ট টাইম—দুই আলাদা ব্যাগে—অফিসের ইস্যু করা চিঠি নিয়ে পথে বের হই। সারা সপ্তাহের এই দুই কাজই এসেনশিয়াল বা জরুরি চাকরির আওতায় পড়ে। কিন্তু সেসব কথা আজকের প্রসঙ্গ নয়, ফিরতে চাই অতীতে, সুদূর অতীতে মাত্র ৪০ বছর আগে।

বয়স তখন ১০–১১ হব, থাকতাম নানা বাসায়। বাবা গিয়েছেন উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ভারতে। চার বোন, মাসহ নানা বাড়ির বিশাল তিন উঠোন জোড়া ছায়াঘেরা বাড়ি। গাছগাছালি দিয়ে ভরে থাকা নানা বাড়িতে শিশুকাল। কি মুশকিল, লেখা শুরু করতে পারি না, চোখ ঝপসা হয়ে আসে কেন? তাহলে কি লিখতেই পারব না আজকে আর?

সেই টক–ঝাল–মিষ্টি মেশানো দূর অতীতে মন চলে যায় ভোরবেলা থেকেই। কিছুতেই নিজেকে রুখতে পারি না। এই যে দুনিয়ার বুকে সেরা শহর টরেন্টো, এখানেই গত ১৬ বছরের বাস। যে শহরের প্রতিটা মিনিটে আছে ডলারের তীব্র আকর্ষণ আর টান টান হিসেব, সেই শহরেই মনজুড়ে থাকে রংপুরের এক ছায়াঘেরা বাড়ি। জীবনের সেরা সময় নানা–নানি সঙ্গে কাটানো পাঁচ বছর।

আজকের যারা পাঠক, তারা এই লেখার খেই খুঁজে পাবেন না। মূলত আমারও ইচ্ছে নেই খুব গোছালো ও ধারালো একটা লেখা লিখবার। মা দিবসের লেখা লিখব, কিন্তু কোন মা থেকে শুরু করি? আমার মায়ের ইতিহাস তো পোতা আছে আমার নানির জীবনের সঙ্গে। সে কথা বাদ দিয়ে নিজের মায়ের কথা কী করে আসে? আবার নানির যে মা, মানে যিনি আমাদের বড় নানি, তাঁকেও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে দীর্ঘ জীবন। তাঁকেও বা ঝেড়ে ফেলি কি করে? একজন বিখ্যাত মানুষ বলেছিলেন, জীবনে বেশি দেখার, বেশি গভীরে যাওয়ার, বা বেশি বেশি তল খোঁজার বিপদ অনেক। এই মুহূর্তে সেই লেখককে খুব সৎ মনে হচ্ছে।

বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আমি। ছোট বেলা থেকে শুনেছি, আমার জন্মের পরে পরেই মা নাকি নানাকে বলেছেন, এই পাগল মেয়ের দায় আমি নিতে পারব না। আপনি দেখবেন লুনাকে। নানা কি কথা রেখেছিলেন? নানি কি দেখতে পারছেন আমি যে আকুল হয়ে ইতিহাস খুঁড়ে চলছি, সেই নানাবাড়িতে এল প্যাটার্নের বড় বড় চারটে ঘর ছিল। ১৯৪৭-৪৮ সালে পুরোনো হিন্দুদের বাড়ি নানা কিনে নিয়েছিলেন, লাল শান বাঁধানো মেঝে, উঁচু উঁচু পোক্ত কাঠ দিয়ে টিনের ছাদ—চারপাশে ভীষণ পুরু দেয়াল, ওই পুরোনো আমলের বড় বড় থাম্বা আর উঁচু করা বারান্দাওয়ালা বাড়ি। চারপাশে তখনো শিরীষগাছ ছিল। আমি বলছি ১৯৭৫ সালের পরের সময়ের কথা। বাবা দেশের বাইরে চলে গেলেন ৫ বছরের জন্য। আমরা ঝিকঝিক ট্রেনে চেপে বড় মামার সঙ্গে কুষ্টিয়া থেকে রংপুরে এলাম। শুরু হলো রুপালি কৈশোর কাল।

ওই বাড়িতেই আমরা চার বোন যখন থাকতে শুরু করি, তখন আমাদের সঙ্গী আরও তিন মামা-খালা। বড় পরিবার বলেই নানা-নানি নিজেদের জন্য একটা টানা মাটির ঘর করেছিলেন। মনে পড়ে, উঠোনের শেষ দিকে যে দিকটায় লাগোয়া পুরোনো মিষ্টি পানির কুয়া আর রান্নাঘর, সেখান দিয়ে ছিল মাটির টানা ঘর । শণ, টিন, মাটি-ইটের পিলার দিয়ে বানানো সারি দেওয়া তিনটি ঘর। প্রথমে নানার ঘরে একটা চৌকি, পাশে রাখা নানার টেবিল, চৌকির নিচে নানার পিক ফেলার জন্য কাসার বড় পিকদানি। এর ৪-৫ হাত পরেই নানির জন্য বড় একটা শোয়ার চৌকি, শক্ত জাজিম দেওয়া বিছানা। সঙ্গে লাগোয়া বড় কাঠের জানালা, মাথার কাছে রাখা হাত পাখা, নানীর পাশেই আমার শোবার জায়গা। আরও দুই-তিন হাত দূরে একটা ভাঁড়ার ঘরের মতো, যদিও জায়গাটা খোলা, কিন্তু ওখানেই রাখা থাকত নানির আসল সম্পদ নানি লুকিয়ে রাখতেন নারকেলের নাড়ু, কালো গোল গোল নারু বানানো হতো গুড় দিয়ে, এ যেন অমৃত।

সাধারণ মোয়া বা মুড়ি থাকত খোলা জায়গায় কিন্তু কিছু বানানো হতো বাইরের মেহমানদের জন্য, যেমন কোন বছর বড় মামা আসবেন জার্মানি থেকে, বা আমার বাবা মানে নানির বড় জামাই ফিরবেন হায়দ্রাবাদ থেকে ঈদে বা পর্বে—সেসব দামি সময়ের জন্য। নানি লুকিয়ে রাখতেন ভাঁড়ার ঘরে খাবার—আর ওই যে বলে না, ‘চোরের নজর বোঁচকার দিকে—আমার নজর থাকত ভাঁড়ার ঘরে। নানির সঙ্গে থাকাও হচ্ছে আবার ভাঁড়ার ঘরের আতিপাতি হাতড়ানো হচ্ছে।

তাই ওই এল প্যাটার্নের দালানের ঘরে আমি না পারতে যেতাম, থাকতাম নানির গা ঘেঁষে ঘেঁষে— ছোটবেলায় অতিরিক্ত দুষ্টুমি আর শয়তানি করার জন্য আম্মার হতে মার খাওয়ার প্রস্তুতি রাখতে হতো আমাকে। নানি রক্ষা করতেন। হয়তো নানি নামাজ পড়ছেন, আমি নানির শরীর ধরে বসে আছি, আম্মা এসে বললেন, লুনা, মা নামাজ পড়ছে—এদিকে আয়? নানি নামাজ শেষে বলতেন, না, ও যাবি নে, তুই যা আমার সামনে থেকে। ব্যাস নির্ঘাত মার খাওয়া থেকে এক দুপুরে আমি বেঁচে গেলাম।

এমনি এক নীরব দুপুরে দৃশ্যটা আমার চোখে পড়ে যায়, নানির বয়স তখন কত হবে ৫১-৫২। আমার সমানই তো তাই না? নানা ভালোবেসে নানিকে স্পর্শ করছেন। আমি মাত্র এক ঝলক দেখি, বুঝতেও পারি না হয়তো ঠিকঠাক। কিন্তু ছবিটা জ্যান্ত হয়ে আছে আমার মনে। নানা আর নানি কথা বলছিলেন খুব নিভৃতে। যত বড় হতে থাকি, সেই পরম ভালোবাসার দৃশ্যটা আমাকে বুদ করে রাখে। সংসারে ভালোবাসা না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কি কাজ করে আমার ভেতরে?

নানা-নানি পাশাপাশি বসা, অসাধারণ একান্ত মুহূর্ত নয়, এটা ভালোবাসার দৃশ্য। আমি ভুলতে পারি না আজও। অনেক অনেক এই দৃশ্যটা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাকে। সংসারে নির্ভরতা আর ভালোবাসা খোঁজার এই এক প্রবণতা, যা আসলে এই যুগে আর নেই বা আমি যে পরিবেশে চলি, সেখানে একদম বিরল। এখন কেবলই হিসেব, পাল্টাপাল্টি হিসেব, আমি একটা করলে তুমি আরেকটা করবে, একে পেলে এটা এটা হবে, একে না পেলে এটা এটা হবে না। কোথাও আর কোনো নির্ভরতা নেই, ত্যাগ নেই, ছোট ছোট করে জীবনকে অর্জন করার ব্যাপার নেই, স্বামী মানুষ না পশু, তা দেখার দরকার কি? স্বামীর অন্য সম্পর্ক আছে বা স্বামী ঘুষ খায়, কি আছে তাতে, আজকের যুগে তো এসব যোগ্যতার আওতায় পড়ে, দেখবেন শুধু জমির দলিল, ফ্ল্যাট, ব্যাংক ডিপোজিট ঠিক আছে কি না, তাহলেই সব হয়ে যাবে ঠিকঠাক।

সেই ১৯৮০ সাল থেকে আমাদের চার বোনকে নিয়ে বাবা–মা ঢাকায় আসার পর থেকেই দেখছি, মা সংসারকে ম্যানেজ করছেন, ক্রমাগত ম্যানেজ করছেন। বাবা অফিসে চলে গেলেন, মা সব কাজ তিনটার আগে শেষ করার তাড়া করছেন—সপ্তাহ, মাস ঘুরছে কবে ওই মাস কাবারি বেতন কবে আসবে সেই প্রহর গোনা। কবে একটু বাড়তি উপার্জন আসবে ,এ যেন এক গ্লাস মাত্র পানি, সবার তৃষ্ণা মিটবে তো? নানাবাড়ি থেকে ঢাকায় আসার পরে এই এক চক্রেই জীবন এবং ভীষণ নোংরা সত্য হচ্ছে আমার জীবনও তাই কবে একটু নির্ভার হয়ে বসব, এই জীবনে যেমনটা নানা–নানি কে বসতে দেখতাম?

আবার আমার মাথায় আসে নানির চলাফেরা। সেই নানিবাড়িতে পেছনে খেত ছিল, মানে চাষাবাদ হতো। নানির সঙ্গে ঘুমাতাম বলেই নানির সঙ্গেই উঠে যেতাম। নানি ভোরে যেতেন খেতে, বলতেন এই লুন, ওই ভাঙা কুলোডা নিয়ে আয় তো বু। নানি পরম যত্নে লালশাক, পুঁইশাক আর আলু–পিঁয়াজ তুলে আনতেন পেছনের খেত থেকে। অত বড় সংসার খানেওয়ালা মানুষ ২০ জনের মতো, নানি ম্যানেজ করতেন কী করে? ১৯৭৬ সাল চারদিকে হাহাকার। স্বাধীন বাংলাদেশে নানা অনাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চারদিকে নেই নেই রব, ভাত নেই, চাল নেই, খাবার নেই, স্বাধীন দেশ আছে কিন্তু পেটে ভাত নেই। নানার ব্যবসা নেই। নানা বসে থাকতেন ইজি চেয়ারে। তবুও নানি চালাতেন সংসার—সারা মাসে বড় মামা সামান্য কিছু জার্মান ডলার পাঠাবেন। আমরা চার বোন, মাসহ বিশাল সংসার কি ভীষণ কঠিন সময়। নানি সেই সময় পার করেছেন কী দিয়ে, সৎ আর পরম ভালোবাসা দিয়ে? নিজেকে প্রশ্ন করি, একান্ত প্রশ্ন মনের গহিনে বয়ে বেড়ায়।
আমার মা পার করেছেন কঠিন সময়, আরও কঠিন সময়। খুব মনে করার চেষ্টা করি, বাবা-মায়ের একান্ত কোনো মুহূর্ত। মা সংসারের কঠিন সময় নিয়ে বাবার সঙ্গে আলাপ করছেন, পথ খুঁজছেন মনে কি পড়ে আমার?

আসলে জীবন এখন করোনার মতোই অনিরাপদ আর ফিকে হয়ে এসছে। হাজারো ডলার বা গাড়ি বাড়ি দিয়েও ভালোবাসা আর পরম নির্ভরতা পাওয়া যায় না। সব কেমন জানি বাজারি হিসেব। এই জীবনেই যদি কিছু ত্যাগ করেও থাকি, মানুষ মনে করিয়ে দেয় লুনা, কই করলা তো অনেক কিছুই কি পাইলা জীবনে? আমি হাতড়ে দেখি পরম ভালোবাসার বদলে পেলাম অপমান, উপেক্ষা, অপরাধী মানুষের নোংরা মুখ।

তাই মা দিবসে নানির সেই অপরূপ ভালোবাসার ছবি মাথায় রাখি। ভালোবাসা আর মমতার সেই অপরূপ মুহূর্ত মনে রেখে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলি মা, তোমাকেও ভালোবাসা, যা পেয়েছিলাম নানির শরীরের সুগন্ধি থেকে।