পরানজুড়ে ব্রহ্মপুত্র নদরে আমার

বিদেশে ব্রহ্মপুত্র আজও কাঁদায়। ছবি: সংগৃহীত
বিদেশে ব্রহ্মপুত্র আজও কাঁদায়। ছবি: সংগৃহীত

জীবন নদীর মতো, নদীও জীবনের মতো। জীবন ও নদী শুধুই বয়ে যায়, ধেয়ে যায়, ছুটে চলে আগামীর দিকে, অজানার পথে। নদী ও জীবনের এই চিরন্তন বয়ে চলা বিস্তৃত করে চেতনালোক, নাড়া দেয় চিন্তালোক। নদীর উথাল-পাথাল ঢেউ, নীরব স্রোত, অবুঝ দুকূল জানিয়ে দেয় জীবননদীর ট্র্যাজেডি, মহাপ্রস্থান আর ভাঙা-গড়ার অন্তহীন বেদনা। আমরা নদীকে বুকে লালন করি, চোখে ধারণ করি, বহন করি দেহ-মনে খুব নীরবে।

ভৌগোলিক গুরুত্বের পাশাপাশি নদীর নৈসর্গিক, আধ্যাত্মিক ও শৈল্পিক আবেদনও উল্লেখযোগ্য। নদীর নিসর্গ ও নদীর জল নির্মল করে, পবিত্র করে দেহ-মন। এই নদী আমাদের শিল্পী করে, কবি করে, বৈরাগী ও সন্ন্যাসী করে। ভাঙা–গড়ার এই নদীই দেখায় জীবনের সবচেয়ে বড় দর্শন আর মহাজাগতিক হাহাকার। নদীর নীরব দুকূল, অশান্ত ঢেউ, অবিরাম স্রোত কী এক কাব্যিক আবহ তৈরি করে পরানজুড়ে। নদী আর জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে পোড়ামন, ‘ও নদীরে আমার...’। নদী নিয়ে গাওয়া কোন মরমি গান অন্তরে ঢেউ তুলে উথাল-পাথাল।

জাগতিক চরম অর্থহীনতার মধ্যেও নদী হয়ে ওঠে ভালোবাসার অবাক ক্যানভাস। জীবনের পাথর সময়ে নদীর শীতল জলও হালকা করে প্রাণ-মন। নীরবে নদী হয়ে ওঠে পরানের বান্ধব। আমার শৈশব-কৈশরজুড়ে ছিল পদ্মার উত্তাল দুকূল। পাড় ভাঙার শব্দ এখনো বেজে ওঠে বুকের মাঝে। সর্বগ্রাসী পদ্মা এখনো এক দুঃস্বপ্নের নাম।

পদ্মাপারের এক ‘রাখাল বালক’ হয়তো প্রমত্তা পদ্মাকে বুকে ধারণ করতে সাহস না পেলেও কৈশরে এক স্নিগ্ধ নদীই হয়ে উঠল জীবনের নিত্য ভালোবাসা আর গান। নদের নাম ব্রহ্মপুত্র (পুরাতন)। প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্রের এই স্নিগ্ধ শান্ত শাখাটিই হয়ে গেল অন্তরের বান্ধব। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদ (পুরাতন) কৃষিবিদদের অস্তিত্বের সারথি, স্বপ্নের নিত্যসঙ্গী, অন্তরের বান্ধব। এই নদই ছিল আমাদের বেলা-অবেলার দুঃখ-সুখের নিত্যসঙ্গী। এই নদই প্রতিদিন শুষে নিত অন্তরের যত কষ্ট-কালিমা, দিত সতেজ হওয়ার মন্ত্র। ব্রহ্মপুত্রের জলের ব্যঞ্জনা, নিশিরাতে নদের কূলে বাঁশরির বাঁশির সুর, নৈশব্দ-হাহাকার দিয়ে যেত জীবনের এক অর্বাচীন উপাখ্যান, স্বাপ্নিল কাব্যগাথা আর সিনেমাটিক আবহ।

আমরা যারা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, বাকৃবির নৈসর্গিক ক্যাম্পাসে যাদের ছিল দীপ্ত পথচলা, তাদের চেতনায়, অস্তিত্বে ভালোবাসায় ও স্বপ্নে মিশে আছে ব্রহ্মপুত্রের অম্লান স্মৃতি। ভরা পূর্ণিমায় যখন চাঁদের আলোয় ভেসে যেত চরাচর, তখন নদীর নিবিড় ভালোবাসায় উদাস হতো পোড়ামন। বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তর থেকে আসা তরুণ প্রাণের প্রথম ভালোবাসা এই ব্রহ্মপুত্র। দুরন্ত তারুণ্য, অশান্ত যৌবন, উদ্ভ্রান্ত স্বপ্ন-আশার নীরব সাক্ষী এই নদ। বুকের ভেতর স্বপ্ন-আশার দ্রুত পল্লবিত হওয়ার দিনগুলোতে এই শান্ত নদের জলই অদৃশ্য সাহস জুগিয়েছিল নিশী–দিন। বর্ষায় যখন যৌবনবতী হতো স্নিগ্ধ ব্রহ্মপুত্র, যখন দুকূল ছাপিয়ে স্বপ্ন ও জীবনের জয়গান, পলিমাটির পাগল করা ঘ্রাণ অশান্ত করত, মাতাল কিশোরবেলা। কাশফুলের শুভ্রতা মেখে শান্ত হতো উদ্ভ্রান্ত মন। প্রাণের মেলা, গানের মেলা, স্বপ্ন-আশার সারা বেলা—সবই ছিল এই ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে।

ব্রহ্মপুত্রের দুকূল ছাপিয়ে আমাদের নিত্য পদচারণ ছিল, স্বপ্নের প্রক্ষেপণ ছিল, ছিল ধূসর ক্যানভাসে গোধুলির অবাক জলরং। নিত্য আশা–যাওয়া ছিল শুক্ল-কৃষ্ণপক্ষের আলো-আঁধারে, দিবসে-নিশীতে, জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে, কারণে-অকারণে। সন্ধ্যার মায়াবী ছায়া, গোধুলির হাহাকার, নিশীথের নিস্তব্ধতার নীরব সাক্ষী এই ব্রহ্মপুত্র। শরতের সব শুভ্রতা বুকে নিয়ে, সব নীল শুষে নিয়ে, সব রং মেখে নিয়ে, সব মৌনতা চোখে নিয়ে নদীর কোলে কি এক নিত্য অবগাহন, নিত্য আসা–যাওয়া। ব্রহ্মপুত্রের দুকূল ঘেঁষে জমে থাকা হাসি-গান, অভিমান, ভালোবাসা, আর বেহিসেবি স্বপ্ন এখনো ঢেউ তোলে অন্তরে। নিশীথের অন্ধকারে তারার আলোয় ডুব দিয়ে খুঁজেছি জীবনের সুর, আর কষ্টের উৎসমূল।

অঞ্জলি ভরে নদীর শুভ্রতা আর আর স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরে দেখি সব হাওয়া। ভোরের আকাশের জলরং আর রংধনুর সাত রং বুকে নিয়ে নদী সাজত কী এক অপরূপ সাজে। কালের স্রোতে কত কি যে বদলে গেছে, ব্রহ্মপুত্র যেমন ছিল মনের মাঝে, তেমনই তো আছে; কালের সাক্ষী, কূলের সাক্ষী ব্রহ্মপুত্র নদরে আমার।

করোনাকালের পাথর সময়ে কাঙালি মন শুধুই ছায়াময় কোন প্রান্তর, বিজন নদীর কূল খোঁজে যেখানে জলাঞ্জলি দেওয়া যাবে সব নৈরাশ্য-আতঙ্ক। নদীপাগল এক ‘রাখাল বালকের’ ত্রিসীমানায় কোনো নদী নেই। মুরে-ডালিং বহুদূর। জলাধার পেলেই নীরবে বসি জলের পাশে। জল হাতে নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ঘ্রাণ খুঁজি। একবার টেমস নদীর শীতল জলে ব্রহ্মপুত্রকে খুঁজেছিলাম, দেখি শুধুই কোলাহল আর গতির গন্ধ; কোনো নৌকা নেই, কাশবন নেই, নেই কোনো জীবনের গল্প-গান। হুইসেল বাজিয়ে চলে টাইটানিকের মতো জাহাজ। সাগরপাড়ে নোনা জলে ব্রহ্মপুত্রের স্মৃতি হাতড়াই, পাই না খুঁজে।

নিস্তব্ধ পরবাসে স্তব্ধ দুচোখ শুধুই খুঁজে ফিরে একচিলতে ব্রহ্মপুত্র, ডানামেলা স্বপ্ন, ভালোবাসার জলরং। যখন মেঘ করে আসে চারিধার, উদ্ভ্রান্ত মন শুধুই ছুটে যেতে চাই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। বিজনে-নগরে, দূর পরবাসে কত কী ছাপিয়ে নীরবে ডাক দিয়ে যায় ব্রহ্মপুত্রের সুর। স্বপ্ন দেখি আবার যাব ব্রহ্মপুত্রের ধারে, আবার ছুঁয়ে দেব নদীর আঁচল-ললাট। আবার খুঁজব নিহত সময় একূল-ওকূল ধরে। নীরবে শুধাব সরেস মাঝিকে ‘জীবনে এত কান্না ক্যানে রে?’ নীরবে এক ফোঁটা অশ্রুর দর্পণ দেব ব্রহ্মপুত্রের জলে। কালের উজান বেয়ে ফিরে যাব আমার নিজস্ব নদীতে—যেখানে ফেলে এসেছি জীবনের গান, চেতনার শুভ্রতা, স্বপ্নের ক্যালিগ্রাফি, ভালোবাসার ভাঙা তরি আর যৌবনের এক অমীমাংসিত অর্বাচীন সমীকরণ।