করোনাকালে দেশের টানে

পার্থ শহর।
পার্থ শহর।

যাঁরা দেশ ছেড়ে বিদেশে পড়াশোনা অথবা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে যান, কিছুদিন যাওয়ার পর বেশির ভাগ মানুষই দেশের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করেন। অনেকে ক্ষোভ, হতাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি থেকে হয়তো বিদেশে পাড়ি জমান কিন্তু তাঁদের ভেতরে–ভেতরে দেশের প্রতি অন্য রকম এক ভালোবাসা তৈরি হয়, যেটা হয়তো প্রকাশ পায় না।

আমিও উচ্চ শিক্ষার্থে (পিএইচডি) অস্ট্রেলিয়া যাই ২০১৬ সালে এবং প্রতি ছয় মাস অন্তর দেশে আশার সুযোগ ছিল গবেষণা কাজের জন্য। প্রতিবারই দেশে আসার সময় একটা উৎসাহ নিয়ে আসতাম এবং যাওয়ার সময় মনটা ভার করে যেতাম।

পিএইচডির শেষ দিকে অনেকটা কঠিন সময় পার করতে হয়, কারণ নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে থিসিস জমা দিতে হবে। এর জন্য দিন-রাত লিখতে হয় এবং মানসিক একটা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় পার করতে হয়। আমার গ্রুপের অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ে থিসিস জমা দিতে পারেনি। আমার থিসিস লেখালেখি ঠিকঠাকমতোই এগোচ্ছিল, কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ভাগ্য প্রসন্ন ছিল বলে নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রি-সেমিনার দিয়ে দিলাম।

সেমিনার দেওয়ার ঠিক কয়েক দিন পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং নির্দেশনা আসে বাসা থেকে কাজ করার। এই সময় অস্ট্রেলিয়ায়ও কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি হতে থাকে। রেস্টুরেন্ট, বার, জিম, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছোটখাটো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অনেক স্টুডেন্টদের আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন যেসব ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এই অবস্থায় নিজের ব্যয়বার বহন করতে পারবে না, তারা যেন নিজ দেশে চলে যায়। যদিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব উদ্যোগে কিছু আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা চালু করেছে।

সময় যাচ্ছে আর আমার লেখালেখি একটু একটু করে এগোচ্ছে। একটানা বাসায় বসে কাজ করতে করতে একগুয়েমি চলে আসছিল। সুপারভাইজারও প্রতি সপ্তাহে মিটিং করছে কাজের অগ্রগতি জানার জন্য। আর সুপারভাইজার বলল, দেশে তো যেতে পারছ না, তাই সময় নিয়ে লেখো। একটা ডেডলাইন ঠিক করা হলো থিসিস জমা দেওয়ার জন্য। যদি নির্দিষ্ট সময়ের আগে শেষ করা যায়, তাহলে রিসার্চ পেপার লেখা যাবে। লেখালেখির পাশাপাশি চিন্তা করছি কীভাবে দেশে যাওয়া যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে সকল ফ্লাইট বন্ধ আছে এবং কবে নাগাদ চালু হবে, তা–ও জানা যাচ্ছে না। স্কলারশিপ অথরিটিকে বললাম, আমার জন্য ফ্লাইট শিডিউল দেখো, কবে দেশে যাওয়া যায়। তারা খোঁজখবর নিয়ে দেখল জুলাই-আগস্টের আগে ফ্লাইট চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই তারা আমার স্কলারশিপের মেয়াদ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িয়ে দিল। মনে মনে একটু খুশি হলাম যে থিসিস জমা দিয়ে একটু ফ্রি সময় কাটানো যাবে, আর থাকা-খাওয়ারও চিন্তা করতে হবে না।

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে একটা ই-মেইলের মাধ্যমে জানতে পারলাম, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন একটা বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করবে আটকে পড়া বাংলাদেশির দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমিও ভাবলাম ফ্লাইটা যদি মে মাসের শেষের দিকে হ,য় তাহলে থিসিস সাবমিট করে চলে যেতে পারব। কিন্তু দুই দিন পরে অর্থাৎ মে মাসের ২ তারিখ আবার ই-মেইল পেলাম, বিশেষ ফ্লাইটি ৭ মে সিডনি থেকে মালয়েশিয়া হয়ে ঢাকা যাবে এবং যাঁরা যেতে আগ্রহী, তাঁরা যেন টিকিট কনফার্ম করেন। এটা দেখে আমি যাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম, কারণ আমার থিসিস লেখা শেষ হয়নি, তা ছাড়া যাওয়ার জন্য কোনো প্রস্তুতিও নেই। মনে মনে একটু আফসোস করতে লাগলাম ফ্লাইটটা যদি একটু পরে হতো, তাহলে আমিও এই ফ্লাইটে দেশে ফিরতে পারতাম। ৪ মে আবার ই-মেইল পেলাম, পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী না হওয়ায় মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস বাদ দিয়ে শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইনস ঠিক করা হয়েছে, যেটা এখন ৮ মে মেলবোর্ন থেকে ছেড়ে কলম্বো হয়ে ৯ তারিখ ঢাকা পৌঁছাবে। এটা দেখে অনেক চিন্তা করলাম, কী করা যায় এবং কয়েকজন কলিগের সঙ্গে কথা বললাম, সবাই সাজেস্ট করল এত তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার দরকার নেই এবং পরে হয়তো আরও ফ্লাইট পাওয়া যাবে। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় চলে আসছে, তাই এখানে থাকাটা বেশি নিরাপদ বাংলাদেশের তুলনায়। সুপারভাইজারকেও ই–মেইল দিলাম, সে লিখল, ‘It would be very hectic for me.’

লেখক
লেখক

দেশে আমার স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বললাম, সেও বলল, এত প্রেশার নিয়ে আসার দরকার নেই। যদিও তাদেরও খুব মিস করছিলাম। সবার কথা শুনে একবারেই যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম। কিন্তু আমি যেন স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রাতে ঘুমানোর আগে ভিক্টোরিয়া বাংলাদেশ কমিউনিটির মাকসুদ ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম, একটা টিকিট বুক দিয়ে রাখতে এবং সকালে ফাইনাল সিদ্ধান্ত জানাব। যাব কি যাব না, এই চিন্তা করে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে সিদ্ধান্ত নিলাম যাব না। তাই সকালে বাজার করতে চলে গেলাম এবং ইচ্ছেমতো মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফল কিনে এনে ফ্রিজ ভর্তি করলাম। বাজার থেকে আসার পর আবার দেশে যাওয়ার চিন্তাটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল, মনে হয় চলে যাই কিন্তু কোনো প্রস্তুতি নেই। চার বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ায় অফিস ও বাসায় অনেক কিছু জমা হয়েছে। সেগুলো কখন গোছাব, ওদিকে বাড়িওয়ালাকে ৩ সপ্তাহ আগে জানাতে হবে, না হলে সেই পরিমাণ টাকা বন্ড থেকে কেটে নেবে। গাড়িটা ও বিক্রি করতে হবে। সময় চলে যাচ্ছে আর আমার অস্থিরতা আরও বাড়ছে। সন্ধ্যায় আর একজনের সঙ্গে কথা বললাম, সেও পজিটিভ–নেগেটিভ অনেক কথাই বলল। কোনোভাবেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না, মনে হয় চলেই যাই কিন্তু আমার থিসিসের কী হবে। তারপর ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ভাবলাম একটা টস করি। আমি আবার ভাগ্যে খুব বিশ্বাসী। কোনো কিছু অনেক চেষ্টা করেও না পেলে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিই। যে–ই কথা সেই কাজ, টস করলাম। খুব ভয়ে ভয়ে কাঁপা হাতে একটা কাগজ তুললাম, দেখলাম দেশে যাওয়ার পক্ষে এল। দ্বিতীয়বার আর চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম মাকসুদ ভাইকে কোনো সিট খালি আছে কি না। উনি বলল, এখনো কয়েকটা সিট খালি আছে। পেমেন্ট করলে এখনই করতে হবে, কারণ তারা পরের দিন সকালে টোটাল লিস্ট এবং বিল পরিশোধ করবে। আমিও দেরি না করে টিকিটের টাকাটা ট্রান্সফার করে দিলাম। আর তখনই আমার অস্থিরতা কেটে গেল।

হাতে সময় আছে এক দিন অর্থাৎ ৬ তারিখ। ৭ তারিখ বেলা ১১টায় বাসা থেকে বের হয়ে বিমান ধরতে হবে পার্থ থেকে মেলেবোর্নের উদ্দেশে। এই অবস্থায় একটা লিস্ট করলাম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। রাতেই বিমানের টিকিট কাটলাম পার্থ থেকে মেলবোর্ন এবং সঙ্গে হোটেল বুকিং, কারণ ৮ তারিখ বেলা ১টায় পরবর্তী ফ্লাইট। এগুলো শেষ করে রাত ৪টা পর্যন্ত থিসিস রিভিশন দিয়ে সুপারভাইজারের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে প্রথমে ফোন দিলাম হেলথ সেন্টারে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য। এয়ারপোর্টের শর্ত অনুসারে প্রত্যেক যাত্রীকে কোভিড-১৯ টেস্ট অথবা এই রকম কোনো লক্ষণ নেই প্রমাণ করার জন্য ডাক্তারের কাছ থেকে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট নিতে হবে। অনেক অনুরোধ করেও ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম না, কারণ ডাক্তার ফুললি বুকড। এখানে এঁরা একবার না বললে অনেক অনুনয়-বিনয় করলেও আর হ্যাঁ করা সম্ভব না। কোনো উপায় না দেখে আমার একজন পরিচিত ডাক্তারকে দেখাতে সক্ষম হলাম এবং তিনি আমাকে পরীক্ষা করে করোনাভাইরাসের লক্ষণ নেই মর্মে একটা সার্টিফিকেট দিলেন। কাছের কিছু মানুষ দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করল, একসঙ্গে খেলাম এবং রাতের খাবারও বক্স ভরে নিয়ে এলাম। খাবারদাবারের আর ঝামেলা রইল না। বিকেলে দোকানপাট বন্ধ হওয়ার আগে কিছু জরুরি কেনাকাটা করলাম। রাত থেকে শুরু হলো অফিস ও বাসা গোছানো। মাঝখানে আর কিছু কাছের মানুষ এসে বিদায় জানিয়ে গেল। অফিস আর বাসা মিলে কাজ আর শেষ হয় না। লাগেজের ওয়েট মাত্র ২৩ কেজি হওয়ায় বেশির ভাগ জিনিস বড় ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার মনে করে লাগেজে রাখলাম। রাতে মাত্র ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে সকালে আবার কাজ শুরু করলাম এবং বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কোনো রকম কাজের পরিসমাপ্তি টানলাম। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, ভাই আমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দিল এবং সেখানে আর কিছু বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হলো। এদের মধ্যে দুজন বয়স্ক ছিলেন, যাঁরা আবার যাবেন আমার শেষ গন্তব্য পর্যন্ত।

মেলবোর্ন পৌঁছে রাত্রিযাপন করে পরের দিন সকাল ৯টায় আবার বিমানবন্দরে এলাম। এখানে মোট ১৬০ জন বাংলাদেশির মতো অপেক্ষা করছে পরবর্তী ফ্লাইট ধরার জন্য। অনেকে এখানে এসেছেন ছেলেমেয়ে অথবা আত্মীয়স্বজনের কাছে বেড়াতে, আবার অনেক শিক্ষার্থীও চলে যাচ্ছেন। আমরা সবাই যখন দেশে যাচ্ছি তখন অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এবং সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মানুষ এখন অনেকটা স্বস্তির মধ্যে চলাফেরা করতে পারছে। তারপরও কেন সবাই দেশে যাওয়ার জন্য এত অস্থির হয়ে আছে! অনেকের সঙ্গে কথা হলো। যাঁরা এখানে বেড়াতে এসেছিলেন তাঁদের সবকিছুই ভালো লেগেছিল যেমন ধুলাবালুমুক্ত রাস্তাঘাট, নির্মল বাতাস, সুসজ্জিত ঘরবাড়ি, কোলাহলমুক্ত পার্ক, মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ। তারপরও তাঁরা একটা জিনিসের টান অনুভব করছেন আর সেটা হচ্ছে মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা। আর দেশের প্রতি এই ভালোবাসার কারণেই আমরা সবাই করোনাকালে ঝুঁকি নিয়ে উন্নত দেশ থেকে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছি। অবশেষে রবীন্দ্রনাথের সুরে বলতে চাই

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি

শত রূপে শতবার

জনমে জনমে, যুগে যুগে অর্নিবার।


লেখক: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট মারডক ইউনিভার্সিটি, পার্থ অস্ট্রেলিয়া এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।