বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করোনার জিনরহস্য উন্মোচন, সরকারিগুলো কী করছে

বাবা অধ্যাপক সমীর সাহা ও মেয়ে সেঁজুতি সাহা। ছবি: সংগৃহীত
বাবা অধ্যাপক সমীর সাহা ও মেয়ে সেঁজুতি সাহা। ছবি: সংগৃহীত

বাবা-মেয়ে দুজনেই অণুজীববিজ্ঞানী। বাবা অধ্যাপক সমীর সাহা ও মেয়ে সেঁজুতি সাহা। দুজনেই স্বাস্থ্য খাতে নীরবে–নিভৃতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। তাঁদের নেতৃতে একঝাঁক উদ্যমী গবেষক শিশুদের নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, মেনিনজাইটিস, ডেঙ্গুসহ নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে অবিরত কাজ করে চলছেন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) প্রতিষ্ঠান নামক একটি ছাতার নিচে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্র তৈরি করে দিলেন। সবার শুভকামনা তাঁদের প্রাপ্য।

এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের জিনরহস্য উদ্‌ঘাটন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? তথ্যপ্রযুক্তিতে যেমন বিভিন্ন সফটওয়্যার বানানো হয়, বিভিন্ন কোডিং ব্যবহার করে। কোড যেমন হবে সফটওয়্যারটিও সেভাবে কাজ করবে। তেমনি প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেও জিন এই সফটওয়্যারের মতো কাজ করে। জিন যেমন হবে, প্রাণীটিও তেমন আচরণ করবে। এই করোনাভাইরাসটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই এর আচরণ, দুর্বলতা ও শক্তির দিকগুলো জানতে হলে পুরো জেনেটিক কোড জানা অবশ্যম্ভাবী। জেনেটিক কোড জানা থাকলে তার উৎপত্তি, বিস্তারের তীব্রতা, প্রতিষেধক, চিকিৎসাসহ নানা দিক খতিয়ে দেখা সহজ হয়।

মুশকিল হচ্ছে, এই ভাইরাসটি দ্রুতই নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। যেহেতু এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে, তাই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে বা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে গেলে কিছুটা রূপ বদল করছে। আর এই রূপ বদল বেশি মাত্রায় হলে টিকা বা প্রতিষেধক, বা যেকোনো ধরনের ওষুধ অন্য অঞ্চল কাজ না–ও করতে পারে। এবং এটি হলে তা সত্যিই পৃথিবীতে বড় বিপর্যয় বয়ে আনবে। আমেরিকা, ইউরোপে যেভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে, সেভাবে এশিয়াতে এখনো দেখা যায়নি। ধারণা করা যায়, মানুষের জেনেটিক কোডের সঙ্গেও এর কোনো প্রভাব থাকতে পারে।

কানাডা সরকার 'কানাডিয়ান কোভিড জিনোমিকস নেটওয়ার্ক' (ক্যানকোজেন) নামক ফান্ডে ৪০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। এটি প্রায় ১০ হাজার কানাডিয়ান কোভিড রোগী ও প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ভাইরাল জিনোম পর্যবেক্ষণ করে দেখবে ভাইরাসটি কীভাবে কাজ করে, কীভাবে বিস্তার ঘটাচ্ছে, কোন মানুষের কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, রূপান্তর কেমন হচ্ছে ইত্যাদি।

উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই শত শত জিন উন্মোচন করেও এখনো অন্ধকারে আছে। অনেক তথ্য এখনো অজানা। তারপরও প্রাণপণ চেষ্টা চলছে প্রতিষেধক বা ওষুধ তৈরি করার জন্য। সেখানে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সর্বাগ্রে জীবনের নিরাপত্তাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

জেনেটিক কোড বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের মতো দেশ কতটুকু কী করতে পারবে, তা নিয়ে খুব আশাবাদী না হলেও এটার গুরুত্ব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবশ্যই আছে। তারা অন্তত আরও একটু তথ্যসমৃদ্ধ হবে ভাইরাসটি নিয়ে, যা পরবর্তী সময়ে প্রতিষেধক বা ওষুধ তৈরিতে সহায়তা করবে। আর তার সুফল আজ হোক, কাল হোক পাওয়া যাবে। আর এ জন্যই যত বেশি সম্ভব জেনেটিক কোড উন্মোচন করা দরকার।

আমরা যদি আমাদের চারপাশের দেশগুলো ও উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, তারা কীভাবে এই জিন উন্মোচনের কাজ শুরু করে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। তারা মে মাসের শুরুর দিকে পুনেতে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির সহায়তায় এর জেনেটিক কোড বের করে।

পাকিস্তানে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ২৬ ফেব্রুয়ারিতে, তারাও এপ্রিলের প্রথমে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় জেনেটিক কোড বের করে ফেলে। শ্রীলঙ্কাও করেছে শ্রী জয়ার্ধেনপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায়। এ রকম নেপাল, থাইল্যান্ডসহ উন্নত বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রায় সবই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় জেনেটিক কোড বের করে ফেলেছে এবং প্রায়ই করে যাচ্ছে।

এদিক থেকে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনকে একটু ব্যতিক্রম বলতেই হবে। সরকারের মুখাপেক্ষী না হয়ে তাদের সীমিত সক্ষমতার মধ্যে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও অন্যদের সহায়তায় সফল হয়েছে।

অন্যদিকে আমাদের দেশের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠনগুলো কী করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট টেস্টিং নিয়েই ব্যস্ত। গবেষণা–সম্পর্কিত কিছু জানা যায় না। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও কমবেশি একই অবস্থা। অথচ সরকারি কর্মকর্তারা এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছেন। পেশাদারত্ব না থাকলে কোনো কিছুতেই কাজ হয় না।

দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও জিন নিয়ে গবেষণা করার গুরুত্বপুর্ণ বিভাগ অণুজীববিজ্ঞান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন গবেষণাগার সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেস থাকায় তাদেরই নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। অথচ একটু বিব্রত হয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়েছে গবেষণা করবে বলে।

* লেখক: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা। [email protected]