করোনা: পায়েল আর মধ্যবয়সী সুন্দরী

সুন্দরী, মধ্যবয়সী এক নারী প্রায়ই পায়েলের মেসেঞ্জারে সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরা ছবি পাঠান। মেসেঞ্জারে অনেক কিছুই তো আসে! সব কি আর দেখা হয়! যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট শহরের গ্যালাগার স্ট্রিটের এক কলোনিয়াল হাউসের ওপরতলায় লিভিং রুমে বসে করোনাকালে সদ্য বেকার পায়েল সেই ছবিগুলোই দেখছিল। তার মনে হলো কোনো আমলার বউ হবে হয়তো। পায়েল সাধারণত কাউকে ফোন কল দেওয়ার আগে টেক্সট বা মেসেঞ্জারে বলে অবসর থাকলে একটা কল দেবে। এ ক্ষেত্রে সে নিয়মটা না মেনেই মেসেঞ্জারে মহিলাকে কল দিল পায়েল। 

অপর প্রান্ত থেকে মহিলা বলছেন, ক্যাডা?
পায়েল বলল আমি।
মহিলা বলছেন, আমি ত হালায় বুঝবার পারছি, মাগার আমিডা ক্যাডা?
পায়েল তার নাম বলল।
মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, মোবাইল দিছ কেলা।
পায়েল বলল, আপনি যে প্রতিদিন শাড়ির ছবি পাঠান, মনে একটা প্রশ্ন জাগল, তাই ফোন দিলাম।
মহিলা বললেন, কন কী জানবার চান।
পায়েল জিজ্ঞাসা করল, আপনার স্বামী কি চাকরিজীবী?
মহিলা বললেন, চাকরি–বাকরি করবো কিল্লাই। আমাগো ১৪ পুরুষে কেউ চাকরি নকরি করে নাইক্কা। আমার পোলার বাপে চকবাজারের দোহানে বহে। আর ছোট পোলায় বহে বাবুবাজার আড়তে।
পায়েল জিজ্ঞাসা করে, আপনারা কি পুরান ঢাকায় থাকেন?
মহিলা বললেন হ, ছুতরাপুর লোহার পুল আছে না, ওইডা পার হইয়া জাকির হোসেন রোড ধইরা সোজা যাইবার লাগবেন, কয় কদম হাঁটলেই বাঁয়ে একটা ছোট্ট গলি, ওইটা ধইরা আগাইতে থাহেন, যেহানে গিয়া দেখবেন গলির মুখে শমসু সরদারের বেকারি, ওইহানে ডাইনে একটা মোচড় দিয়া হামার পোলার বাপের নাম কইলে মাইনসে দেহাইয়া দিব। মহল্লার হক্কলতে ওরে চিনে, সম্মান ভি করে।
মহিলা পায়েলকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি অহন আইবার লাগছেন?
পায়েল বলে না।
আর আইবেন কেমতে। ছবেই তো লকডাউন। বুঝবার পারছেন করনা হালায় সবারে ঘরের মইদ্দে বন্দী কইরা ফালাইছে। দেহেন কয় দিন থাহে।
পায়েল বলে, পরে একদিন আসা যাবে।
তা আইয়েন।
আমার না গল্প করতে ভালো লাগে।
আমারও
দেখেন আমরা দুইজনে কেমন মিল।
মিল হইবো না কিল্লাই, আমি তো মিল হইবো দেইখ্খাই আপনারে ফেরেনড বানাইবার লাগছি।
ওই হলুদ শাড়িটায় না আপনাকে দারুণ মানিয়েছে, একেবারে যেন মাধুরী দীক্ষিত।
আরে দূর কি কইবার লাগছেন, ওহনতো আমি হালায় মোটা হইয়া গেছি। আগে কেমুন ছিলিম আছিলাম।
এই মোটার মধ্যেও কিন্তু একটা আশ্চর্য রকমের সুন্দর আছে।
হাচা কইতাচেন। আরে আবুল তাবুল কি কইবার লাগচেন।
সত্যি বলছি। সুন্দরকে সুন্দর। ভালোকে তো ভালোই বলতে হয়, তাই না।
আমার চেহারাডা না একসুময় এক্কেরে চান্দের লাহান আছিল।
সেটা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়।
আপনে বুইঝলেন কেমতে?
আমি না অনেক কিছুই বুঝি।
আরে কয় কী, কইনচেন দেহি অহন আমি কি ভাববার লাকচি।
আমি যেটা ভাবছি আরকি।
আবে হালায় কয় কী। আপনে গণক নাহি, আপনে তো দেহি ভীষণ দুষ্টুভি আছেন।
আরে কথায় আছে না মিললে মেলা আর নইলে একলা একলা।
আপনে কেমুন কথা কইবার লাগচেন বদনজর লাগব কিন্তু
(পায়েল প্রসঙ্গ পাল্টাবার চেষ্টা করে)
এই করোনায় আপনি সময় কাটান কীভাবে।
এই তো হারা দিন খাই, দাই ফিলিম দেহি, কোনো কাম কাইজ নাইক্কা।
আচ্ছা আমরা দুজন ছোট্ট একটা কাজ করতে পারি না।
কী কাজ কইবার লাগচেন।
না মানে দুইজনে মিলে করোনাকালে যারা খুবই গরিব, অসহায় তাদের জন্য একটা কিছু করি।
ভালোই তো কইবার লাগছেন, কন আমারে কেমতে কী করবার লাগব।
না তেমন কিছু না, যদি আপনি ১০ হাজার আর আমি ১০ হাজার টাকা দিয়ে কিছু চাল, ডাল, লবণ, মসলা কিনে ২০টি পরিবারকে সাহায্য করতে পারি।
আরে আগে কইবেন তো, আমাগো বাবুবাজারের আড়ত থন চাল নিয়া আমুনে, কত মণ লাগব কন।
না, এত বেশি না, ২০টা পরিবারকে দিতে যেটুকু লাগে আরকি।
আমার ছাহেব না খুব দিল দরিয়া মানুষ, দান–খয়রাত করতে খুব ভালো পায়।
আমি তো অনেক দূরে থাকি, তাই আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরটা দেবেন, আমি সামান্য টাকা পাঠিয়ে দেব।
আবে দূর আপনারে টাহা দিতে হইবো ক্যান, দরকার নাইক্কা, আমি আছি না।
না মানে আমিও এতে শামিল হতে চাই আরকি।
তয় ঠিক আছে, বেবাকতে রেডি কইরা আপনেরে মোবাইল দিমু, ভালা থাইকেন। অহন রাহি।
ঠিক তার এক সপ্তাহ পর টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙঙে পায়েলের।

ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স
ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স

অপর প্রান্ত থেকে সুন্দরী মহিলা বলছেন, এই হুনছেন, আমরা বেবাকতে রেডি কইরা ফালাইছি, আপনার টেকা বি পাইছি, আমার বড় পোলা, ছাহেব সবাই টেকা দিয়া আমাগো ছাতে শরিক হইছে। কাইলকে বিকালে আমার ছোট পোলাডারে লইয়া কমলাপুর রেলস্টেশনের আশপাশে এইগুলান বিলি করুম।
আমাগো একটা ছোট টেরাক আছে না, ওই টা লইয়া যামু গা। আপনারে না সব ভিডুউ কইরা পাঠামু।
মহিলার কণ্ঠে আবেগ, উত্তেজনা আর আনন্দের সংমিশ্রণে কী যেন একটা অদ্ভুত শব্দের শব্দ শুনতে পায় পায়েল।
পায়েল বলল সাবধানে যাবেন, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরবেন সবাই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন।
আরে মর জ্বালা আমাগো লাইগা চিন্তা কইরেন না, আপনি ভি ছাবধান থাইকেন, বলে মহিলা ফোনটা রেখে দিলেন।
পরদিন বিকেলে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বেরোনোর আগে মহিলা পায়েলকে ফোন করে জানান। ডেট্রয়েটের ভোর আকাশে তখন আবিরের খেলা। পায়েল অলস বিছানায় গড়াগড়ি করছিল। কখন যেন একটা তন্দ্রাভাব চলে এসেছে। পায়েল দেখছে, ছোট্ট একটা ট্রাক সূত্রাপুরের লোহার পুল পেরিয়ে জয়কালী মন্দির বাঁয়ে রেখে ফজলে রাব্বী রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, রাস্তায় মাঝেমধ্যে রিকশা তাদের গতি কমালেও ড্রাইভার পাশ কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। টয়েনবি রোড ধরে গাড়ি চলছে, শাপলা চত্বর পেছনে ফেলে আরামবাগ পুলিশ বক্স বামে রেখে যানটি এগোচ্ছে। আইডিয়াল গভ. স্কুল বাঁয়ে রেখে আউটার সার্কুলার রোড ধরে একটু এগিয়ে পানির ট্যাঙ্কির সামনে গাড়িটি থামল। গাড়ি থেকে একে একে নেমে এলেন হলুদ শাড়ি পরা এক মহিলা। সঙ্গে তাঁর ছোট ছেলে ও ড্রাইভার। গাড়িটা এখানে থামতে দেখে বেশ কয়েকজন পথশিশু ও উৎসুক জনতা ভিড় করে, যাদের অধিকাংশই দরিদ্র। গাড়ি থামানোর উদ্দেশ্য বুঝতে দেরি হলো না কারোরই। সবাই লাইন ধরে বসে পড়ল ঘাসের ওপর। মা–ছেলে মিলে ত্রাণ বণ্টন করলেন। দাতা, গ্রহীতা সবাই আনন্দিত, আপ্লুত।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এদিকে কমলাপুরের আকাশে তখন সন্ধ্যা নামছে, দূর থেকে ভেসে আসছে সুমধুর আজানের ধ্বনি। সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার। সে এক অন্য রকম অনুভূতি, অন্য রকম আনন্দ, অন্য রকম ভালোবাসা। একসময় আবেগে আপ্লুত হয়ে পথশিশুদের সবাই জড়িয়ে ধরে সুন্দরী পারভীনকে। পারভীন চেয়ে দেখেন এক অপার্থিব শোভা। শিশুদের শুদ্ধ স্পর্শে তিনি হন উদ্বেলিত, আনন্দের উচ্ছ্বাসে আর খুশির বন্যায় ভাসতে থাকেন। পারভীন এই প্রথম পেলেন নিষ্পাপ পথশিশুদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পারভীন চেয়ে থাকেন অসীম আকাশের দিকে। আউটার সার্কুলার রোডের নিয়ন বাতিগুলো তখন জ্বলতে শুরু করেছে, আর সেই নিয়নের আলোয় দেখা যাচ্ছে পারভীনের হলুদ শাড়ির ঘোমটার বাইরের সোনালি চুল, আর সেই চুলে খেলা করছে বাতাসের ঢেউ, আর সেই বাতাসের ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছে অজানা এক নক্ষত্রের দিকে।