অব্যক্ত ভালোবাসা

বাংলাদেশের ছেলে রাতুল (ছদ্মনাম)। পড়াশোনার সুবাদে তিন বছর আগে তার সুদূর আমেরিকাতে আসা। কিন্তু গত বছরের আগস্ট মাসে আমেরিকার অন্য একটি শহর থেকে সে নতুন আরেকটি শহরে এসেছে। লক্ষ্য এবার পিএইচডি ডিগ্রির পড়াশোনা। নতুন শহরটা খুবই ছিমছাম আর ক্যাম্পাসটাও অনেক সুন্দর। ক্যাম্পাসে ছোট ছোট পাহাড়ের মতো উঁচু-নিচু জায়গায় রয়েছে বিভিন্ন বিভাগ। এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে যেতে হলে উঁচু-নিচু পথ হয়ে যেতে হয়। ফলে ক্যাম্পাসে হাঁটাচলা করা ছেলেটির মতো সমতলের মানুষের জন্য কিছুটা কঠিন হয়ে যায়। তা ছাড়া আমেরিকার সমতলে অবস্থিত অন্য আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার সুবাদে উঁচু-নিচু ক্যাম্পাস নিয়ে তার তেমন ধারণাও ছিল না। 


নতুন এই ক্যাম্পাসে চলাচল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। বরাবরের মতো সে ঘুম থেকে উঠে কোনোমতে ব্রাশ, গোসল, আর নাশতা সেরে বাসের জন্য দৌড়ায়। যদিও ছেলেটির বাসা থেকে ক্যাম্পাস ১০ মিনিটেরও কম সময়ের হাঁটার দূরত্ব। কিন্তু যেহেতু উঁচু-নিচু পথ হাঁটতে তার খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয় না, তাই ক্যাম্পাসের বাসেই যাওয়া–আসা করে।

২.
সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিল। বাসে করে ক্লাসের পথে যাওয়া–আসা করতে থাকে রাতুল। কিন্তু হঠাৎই একদিন বাসে তার দেখা হলো অনিন্দিতা (ছদ্মনাম) নামের এক মেয়ের সঙ্গে। যে বাসে করে রাতুল ক্লাসে যায়, সেই বাসেই প্রথম দেখা মেয়েটির সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে বসে কানে হেডফোন দিয়ে হয়তো গান শুনছিল সেই মেয়েটি। রাতুল প্রথম যখন বাসে অনিন্দিতাকে দেখছিল, তার চোখ মেয়েটির দিকে পড়তেই কেমন যেন হৃদয়ে বিজলী চমকে গেল। গত তিন বছরের আমেরিকায় থাকার সময়ে রাতুল যে এর চেয়ে সুন্দরী কোনো মেয়ে কখনো দেখেনি বা সুন্দরী কারও সঙ্গে তার কথা হয়নি, তা নয়। কিন্তু অনিন্দিতাকে প্রথম দেখেই তার কেমন যেন হৃদয়ে ইলেকট্রিক শক লাগল বুঝে উঠতে পারল না রাতুল। তবে প্রথম দেখায় মনে হলো মেয়েটি আমেরিকার স্থানীয় নয়, হয়তো ইরান বা কোনো মধ্যপ্রচ্যারের কোনো দেশের হবে। ইচ্ছা হয়েছিল তার ওই দিনই মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার। কিন্তু হার্টের ধড়ফড়ানি এত বেশি ছিল যে রাতুল আর বেশি রিস্ক নিতে পারল না। হার্ট আবার বেশি কম্পিত হয়ে যদি ফেল করে এই ভয়ে! তাই প্রথম দিন মেয়েটিকে কিছু না বলেই সোজা ক্লাসের পথে চলে যায় রাতুল। যদিও চোখের সামনে তার শুধু অনিন্দিতার ছবিই ভাসতে থাকে।

৩.
অনিন্দিতাকে দেখার প্রথম দিনের পর থেকে প্রতিদিন রাতুল বাসে যাওয়া-আসার সময় এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজে সে আছে কি না। কিন্তু এক মাস কেটে যায় সে আর অনিন্দিতার দেখা পায় না। রাতুল ভাবে সম্ভবত অনিন্দিতা অন্য কোনো সময়ে বাসে যাওয়া-আসা করে। কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন আবার সেই বাসেই রাতুল মেয়েটির দেখা পায়। দ্বিতীয়বার যখন রাতুল বাসে অনিন্দিতার দেখা পায়, তখন বাস থেকে নেমেই সরাসরি অনিন্দিতার সামনে হাজির হয়। অপ্রস্তুত রাতুল কোনো কিছু না ভেবেই অনিন্দিতাকে জিজ্ঞাসা করে তার নাম, বিভাগ, আর কোন দেশের মেয়ে সে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাতুল জানতে পারে মেয়েটি পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স করছে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মরক্কো থেকে এসেছে সে। প্রথম আলাপ তখনকার মতো ওইটুকুই। মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসে রাতুল। তারপর কেটে যায় অনেক দিন। দুই মাস পরে আবার বাসে দেখা সেই অনিন্দিতার সঙ্গে। এইবার বাস থেকে নেমেই রাতুল মেয়েটির ফোন নম্বর চাইল, মেয়েটিও হাসিমুখে তার ফোন নম্বর দিয়ে বলল, সে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজিং প্ল্যাটফর্মে আছে চাইলে রাতুল তাকে খুদেবার্তা পাঠাতে পারে। রাতুল তো মহাখুশি ফোন নম্বর পেয়ে। এরপর শুরু হয় তাদের টুকটাক হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা আদান–প্রদান।

৪.
এরই মধ্যে রাতুল সাহস করে একদিন অনিন্দিতাকে হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তায় জিজ্ঞাসা করল তারা দেখা করতে পারে কি না কফি খাওয়া আর গল্প (আড্ডা) করার জন্য। অনিন্দিতা রাজি হয়ে গেল প্রথম জিজ্ঞাসাতেই। রাতুলের খুশি কে দেখে তখন। পরিকল্পনামাফিক অনিন্দিতার সঙ্গে দেখা করার জন্য রাতুল ক্যাম্পাসের কফিশপে গেল। রাতুল সেখানে যাওয়ার ১০ মিনিট আগেই অনিন্দিতা চলে এল কফিশপে। যদিও রাতুল মনে করেছিল সে–ই হয়তো আগে যাবে, কিন্তু রাতুলের ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করে অনিন্দিতাই আগে চলে এল কফিশপে। প্রায় দুই ঘণ্টা তারা আড্ডা দিল। নিজ নিজ দেশের মানুষ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কী নিয়ে তারা গল্প করল। রাতুল দেখল, অনিন্দিতা আগে থেকেই বাংলাদেশ আর ঢাকা শহর নিয়ে কিছু তথ্য জেনে আসছে। এমনকি আড্ডা দেওয়ার এক ফাঁকে অনিন্দিতা জানাল, সে বাংলাদেশে যেতে এবং থাকতে খুবই আগ্রহী। রাতুল এটা শুনে শুধু মুখ টিপে হাসল। আর হয়তো মনে মনে বলছিল ‘চল হে বিদেশিনী আমার সঙ্গে বঙ্গদেশে।’ আড্ডার মধ্যে তারা তাদের কী কী করতে, পড়তে, জানতে ভালো লাগে, তা নিয়ে গল্প চলতে থাকল। অনিন্দিতার ভালো লাগে বিভিন্ন দেশের মুভি দেখতে আর রাতুল ভাবে মানুষ কীভাবে এক বসায় দুই–তিন ঘণ্টা মুভি দেখে কাটায়। রাতুল আবিষ্কার করল যে তার ভালো লাগে অ্যাস্ট্রোনমি (মহাকাশবিজ্ঞান) আর অনিন্দিতা ভক্ত অ্যাস্টোলজির (রাশিফল)। দুইজন প্রায় দুই মেরুর মতো। অনিন্দিতা রাতুলকে তার জন্ম তারিখ জিজ্ঞাসা করে তার রাশি সম্পর্কে জানাল। রাতুল যদিও রাশিফল বিশ্বাস করে না, তবু অনিন্দিতার তাকে নিয়ে রাশি সম্পর্কে যা–ই বলছিল, সে মন দিয়ে বাধ্য ছাত্রের মতো শুনছিল। তারা গল্প করে ওই দিন আরও অনেক বিষয় নিয়ে। বিদায় নেওয়ার আগে রাতুল অনিন্দিতাকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল যে অনিন্দিতার কোনো ছেলেবন্ধু নেই। রাতুল যে কী খুশি হয়েছিল, ওটা জেনে তা আর বলতে।

৫.
প্রথম দিনে কফিশপে আড্ডা দেওয়ার ২ দিন পরই অনিন্দিতা ১০ দিনের জন্য চলে গেল অন্য শহরে কনফারেন্সে যোগ দিতে। এদিকে রাতুল দিন গোনে কখন অনিন্দিতা ফিরে আসে, আর তারা আবার আড্ডা দেবে। অনিন্দিতা কনফারেন্স থেকে ফিরে আসার দুই দিন পর তারা আবার দেখা করে সেই কফিশপে। ওই দিন অনিন্দিতাকে অনেক সুন্দর লাগছিল, যদিও রাতুলের চোখে অনিন্দিতা সব সময়ই রাজকুমারীর মতো সুন্দর। কফিশপে তাদের অনেক বিষয়ে আলাপ হলো। রাতুল মনে মনে ভাবছিল, আজ সে অনিন্দিতাকে বলে দেবে তার মনের কথা—সে কেন অনিন্দিতাকে দেখা করতে বলে, তার অনিন্দিতাকে ভালো লাগার কথা। কিন্তু রাতুল বলতে সাহস করে উঠতে পারে না। কী যেন একটা পিছুটান। হয়তো তাকে হারানোর ভয় অথবা এখন যে তাদের ‘বন্ধুতের’ সম্পর্ক আছে, সেটা ভেঙে যাওয়ার ভয়। রাতুল বলতে পারে না তার মনের কথা। না, বলতে পারেনি রাতুল তার মনের কথা ওই দিন অনিন্দিতাকে। তবে সে মনে মনে পণ করে যে পরেরবার যখন শিগগিরই অন্য কোনো একদিন দেখা করে আড্ডা দেবে, তখন বলবে তার মনের কথা। রাতুল চাইলেই তার মনে কথা মুঠোফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তায় বলতে পারত, কিন্তু সে ভাবল সে অনিন্দিতাকে সরাসরি সামনাসামনি কথাটা বলবে। কিন্তু বিধি বাম! এরই মধ্যে করোনাভাইরাসজনিত কারণে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে আসা স্থগিত হয়ে গেল। তার ওপর সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং আর স্টে হোম নামক অদ্ভুত এক চক্করের কারণে রাতুল আর অনিন্দিতার সঙ্গে দেখা করতে পারল না। হোম কোয়ারেন্টিনে চলে গেল প্রায় দুই মাস আর তার সঙ্গে অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতেই শেষ হলো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পিং সেমিস্টার। এরই মধ্যে রাতুল জানতে পারল অনিন্দিতারও মাস্টার্স শেষ হলো এই স্পিং সেমিস্টারে। শিগগরিই হয়তো অনিন্দিতা তার দেশে ফিরে যারে। আর কখনো দেখা হবে না হয়তো রাতুলের সঙ্গে। কিন্তু রাতুল আজও বলতে পারেনি অনিন্দিতাকে তার ভালোলাগার (অথবা ভালোবাসার) কথা। থাকুক না কিছু ভালোলাগা (অথবা ভালোবাসা) অব্যক্ত। অনিন্দিতা হয়তো কোনো দিনও জানল না সেই কথা কিন্তু রাতের মহাকাশের অসংখ্য তারা–নক্ষত্ররা জানে অব্যক্ত ভালোবাসার কথা।

* লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব আরাকানসাস, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]