কবে দেশে যাব, আপনজনদের দেখা পাব

মক্কা গ্র্যান্ড মসজিদ জীবাণুমুক্ত করার কাজ চলছে। ছবি: সংগৃহীত
মক্কা গ্র্যান্ড মসজিদ জীবাণুমুক্ত করার কাজ চলছে। ছবি: সংগৃহীত

পেনডেমিক শব্দটির সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না আগে কিন্তু শাব্দিক অর্থ জানার সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুতই এর স্বরূপ বুঝতে পারলাম৷ মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুনলাম বিশেষজ্ঞরা শব্দটি ব্যবহার করছেন।

বিশ্বায়নের এ যুগে আর অন্য সবকিছুর মতো বিশ্বের মানুষ শেয়ার করে নিল করোনাকে, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এ ভাইরাস। একই পরিবারের চারজন হয়তো চার ভিন্ন দেশে কিন্তু কেউ নিরাপদে নেই, প্রত্যেকেই রয়েছে করোনা-আতঙ্কে।

মার্স ও ইবোলার কথা শুনেছিলাম, কোন ভিনদেশের মানুষের জন্য সহানুভূতি জন্মেছিল মনে। কিন্তু, এই করোনা নিজের ড্রয়িংরুমে নিরাপদে বসে সংবাদপত্রে পড়া দূর দেশের কোনো ভাইরাস না, কয়েক মাসের মাথায় তার মাতৃভূমি থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে এখন আমাদের প্রত্যেকের দরজায় কড়া নাড়ছে।

৮ মার্চ ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে খবর পেলাম মক্কা-মদিনার মসজিদে নামাজের জামাত এবং ওমরা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বুঝতে পারলাম, এ দেশে করোনার আগমন ঘটেছে এবং বেশ আ্যলারমিং পর্যায়েই আছে। সোমবার শেষ গেলাম ক্যাম্পাসে। মঙ্গলবার থেকে আমাদের বলা হলো অনলাইন ক্লাস নিতে। সেদিন থেকেই আমাদের অনলাইন ক্লাস শুরু হলো। সঙ্গে ছিল অনলাইন প্রশিক্ষণ ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের জন্য। এ ব্যস্ততার মধ্যে দেশ থেকে খবর এল আমার স্বামীর ব্রেইনে টিউমার ধরা পড়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সেটা রিমুভ করতে হবে। আগে থেকেই অসুস্থ ছিল এবং চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করছিল কিন্তু টিউমারের ব্যাপারটি জানা ছিল না। বুধবার সন্ধ্যায় এই দুঃসংবাদটি পেলাম। ১২ মার্চ বৃহস্পতিবার সকালে ডিনের কাছে ছুটির জন্য আবেদন করলাম। যেহেতু ক্যাম্পাস বন্ধ ফোনেই যোগাযোগ হচ্ছিল ওনার সঙ্গে। ১০টা নাগাদ তিনি আমাকে ১০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করলেন। আমি ভিসা প্রসেসিংয়ের কাজ শুরু করলাম। যেহেতু সামনে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। আধঘণ্টা পর ডিন একটি মেসেজ পাঠালেন যেখানে ছিল একটি সরকারি নির্দেশনা এবং শেষে লিখলেন ‘You can't travel’। বিজ্ঞপ্তিটিতে ছিল করোনাভাইরাস রোধ করার জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে কিছু দেশের বিমান যোগাযোগ বন্ধ করার ঘোষণা। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল কিন্তু আর কিছুই করার ছিল না।

এদিকে আমার স্বামীকে শুক্রবারে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। মঙ্গলবারে তার অস্ত্রোপচার হলো। আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থ হয়ে উঠল। যেহেতু তত দিনে বাংলাদেশে করোনা খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে, মাত্র ৩ দিনের মাথায় তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

৯ মার্চ থেকে আমি বাসায়। পুরোপুরি একা। স্বামীর অপারেশনের সময় সহকর্মীরা এসেছে সহানুভূতি জানাতে কিন্তু, যখন থেকে আভা শহরে কারফিউ এবং লকডাউন শুরু হলো, সব ধরনের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল। মার্চ ও এপ্রিলে ব্যস্ত ছিলাম অনলাইন ক্লাস এবং টেস্ট নিয়ে। মের প্রথমে রেজাল্ট দিয়ে সেমিস্টারও শেষ হয়ে গেল। এখন শুধু অপেক্ষা, কবে লকডাউন উঠবে, কবে বিমান চলাচল শুরু হবে, কবে দেশে যাব, আপনজনদের সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু, পরিস্থিতি এত সহজ না, করোনা সংক্রমণ এখন এমন একটি পর্যায়ে, কেউ বলতে পারছে না কখন কী হবে।

লকডাউনে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত
লকডাউনে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত

সাম্যবাদী করোনার কাছে সবাই সমান। তার কাছে বরিস জনসন আর আমার গরিব দেশের খেটে খাওয়া দিনমজুর একই। সৌদি আরবে করোনার চিকিৎসা ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে, বাসিন্দাদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, অসুস্থ হলেই যেন টেস্ট করায়, চিকিৎসা নেয়। সারা দেশেই প্রায় কঠোর লকডাউন চলছে। তার পরও করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলছে, কমছে না। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে।

বাংলাদেশের অপ্রতুল চিকিৎসা সুবিধা, অসচেতন জনগোষ্ঠী নিয়ে একই হারে বেড়ে চলেছে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা। একদিকে কিছু দায়িত্ববান, ত্যাগী মানুষ তাঁদের সীমিত সাধ্য নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এ ভাইরাস ঠেকাতে, অন্যদিকে কিছু নির্বোধ, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানীর কারণে তাঁদের সে পথ আরও দুর্গম হয়ে যাচ্ছে। সব যুদ্ধেই বীর, সাহসী যোদ্ধাদের সঙ্গে থাকে মিরজাফর আর রাজাকার। জাতি একদিন এই স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানীদের ঘৃণা ভরে স্মরণ করবে। এই পরিস্থিতিতে এই দুই দেশের মধ্যে কবে আবার বিমান যোগাযোগ স্থাপিত হবে, তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। আমার ইউনিভার্সিটি থেকে বিদেশিদের বলা হয়েছে, যদি সম্ভব হয় তোমরা দেশে যেতে পারো, তবে কবে ফিরে আসতে পারবে, তা অনিশ্চিত। এ থেকে মনে হচ্ছে শিগগির বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রবাসীরা সৌদি আরবে ঢুকতে পারবেন না।

প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে, আজ বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা কত? মনে পড়ে আমার পরিবারের কথা যেখানে আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা, অসুস্থ স্বামী, সন্তান, সঙ্গে আমার দেশের আরও কোটি পরিবার, করোনার চেয়েও যাদের আতঙ্ক এখন ক্ষুধা, মনে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় এবং বন্ধু-বান্ধবের কথা, বিশ্বের অচেনা অসংখ্য পরিবারের কথা, যারা প্রিয়জন হারিয়েছে। জানি না এই পেনডেমিক করোনা কবে এই পৃথিবীর ওপর থেকে তার নৃশংস থাবা গুটিয়ে নেবে।

*লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, কিং খালেদ বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব। [email protected]