লকডাউনে মানসিক স্বাস্থ্যের কী খবর

অনেকের মধ্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
অনেকের মধ্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

বড্ড বেশি প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেছিলাম ২০২০ সাল। কিন্তু মাস না ঘুরতেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল তামাম দুনিয়ার মানুষের কপালে। হঠাৎ করেই বদলে গেল মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। গ্লোবাল প্যানডেমিক কোভিড-১৯ শুধু একটি ভাইরাস হলেও এর প্রভাবে দিশেহারা বিশ্বের ক্ষমতাশালী দেশগুলো।

চীন, আমেরিকা আর ইউরোপের দেশ ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেন করোনার ভয়াল ছোবলে আজ মৃত্যুপুরী। যুক্তরাজ্যেও করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যুর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে রকেটগতিতে। শুধু প্রাণহানি নয়, করোনা যে দেশে যাচ্ছে, সেই দেশের অর্থনীতির ভিতকেও নাড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মানসিক অসুস্থতা। বদলে দিচ্ছে মানুষের মনোজগৎ। সেই সঙ্গে লকডাউনে বন্দী মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে দুশ্চিন্তা, অসহিষ্ণুতা ও ডিপ্রেশন।


মার্চের শুরু থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। পরিচিতদের কয়েকজনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়েছিলাম। নিউজে কোভিড-১৯–এর আপডেট দেখতাম আর একটা চাপা উৎকণ্ঠা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত সারাক্ষণ। লকডাউন শুরুর পর প্রায় প্রতিরাতেই ঘুম ভেঙেছে দুঃস্বপ্ন দেখে। প্রচণ্ড মৃত্যুভয় আমাকে তাড়া করে ফিরেছে। প্রতিদিন ক্রমাগত বেড়ে চলা মৃত্যুর সংখ্যা আর সহ্য করতে পারছিলাম না, আবার নিউজ না দেখেও থাকতে পারছিলাম না। নাওয়া–খাওয়া ভুলে শুধু তাকিয়ে থাকতাম টিভি স্ক্রিনে। আমার প্রতিবেশী সাইয়েমা আশপাশের পরিচিতজনদের মৃত্যুর খবরে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্যানিক অ্যাটাক হয়ে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। এরপর ইমারজেন্সি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে এক দিন থাকার পর, আরও চৌদ্দ দিনের সেলফ আইসোলেশনে থেকে এরপর মুক্তি। কিন্তু সেই আতঙ্ক এখনো সাইয়েমার পিছু ছাড়ছে না।

মানসিক চাপ কমাতে বেশি বেশি চকলেট ও সুইটস খাওয়ার কারণে অস্বাভাবিকভাবে ওজন বেড়ে যাচ্ছে অনেকের। ছবি: সংগৃহীত
মানসিক চাপ কমাতে বেশি বেশি চকলেট ও সুইটস খাওয়ার কারণে অস্বাভাবিকভাবে ওজন বেড়ে যাচ্ছে অনেকের। ছবি: সংগৃহীত

লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে অর্থনীতির ওপর। বন্ধ হয়ে যায় ছোট–বড় অনেক প্রতিষ্ঠান। কর্মহীন হয়ে পড়েন অগণিত মানুষ। মি. জন (ছদ্মনাম) কর্মহীন হয়ে ঘরবন্দী হওয়ার পর ভুগতে থাকেন প্রচণ্ড মানসিক চাপে। আর্থিক টানাপোড়েন এবং সংসারের ব্যয় মিটানোর চিন্তা তার মধ্যে তৈরি করে হতাশা। এই হতাশা, ডিপ্রেশন থেকেই দেখা দেয় নিদ্রাহীনতা। আর ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ হিসেবে স্বল্প ঘুমের মধ্যেই আসে দুঃস্বপ্ন। জনের ভাষায়,‘করোনা আমার জীবনটাকে একেবারে দোজখ বানিয়ে ছেড়েছে।’

আমার সহকর্মী ড্যানিয়েল। সত্তরোর্ধ্ব বাবা–মায়ের সংক্রমণের ভয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ করে তাদের সঙ্গে সেলফ কয়ারেন্টিনে আছে প্রায় ছয় সপ্তাহ। প্রিয়জন হারানোর আশঙ্কায় অসহায় বোধ করছেন। ড্যানিয়েল জানাল, মানসিক চাপ কমাতে বেশি বেশি চকলেট ও সুইটস খাওয়ার ফলে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে তার ওজন।

লন্ডনের সুপারমার্কেটগুলোতে গেলেই দেখা যায় ক্রেতারা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর পাশাপাশি প্রচুর অ্যালকোহল কিনছেন। ইউরোপিয়ান তরুণ নিক বয়স খুব বেশি হলে ২৫ বছর। কাজ করেন একটি ফিন্যান্স কোম্পানিতে। নিয়মিত অফিস করছেন বাসা থেকে। লকডাউনে মদ্যপান বেড়েছে কি না জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে উইকএন্ড ছাড়া খাই না কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এ ছাড়া কী বা আর করার আছে?’ মূলত একাকিত্ব এবং বন্দিজীবনের একঘেয়েমি কাটাতে অনেকে মদ্যপানের দিকে ঝুঁকছেন। 


৩৪ বছরের ম্যাগি বরাবরই পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করেন। সবধরনের ক্লিনিংয়ের প্রতি তার একটু বেশি নজর। করোনা আসার পর থেকে তার এই বাতিক যেন বেড়ে গেছে শতগুণ। কথা প্রসঙ্গে বলছিল, ও নাকি করোনাভাইরাস দেখতে পায়। তাই যতক্ষণ সেটা অদৃশ্য না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ক্লিন করতে থাকে। লকডাউনে তার পূর্বের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি) অনেক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

করোনাভাইরাসের কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের মনোজগৎ। ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের মনোজগৎ। ছবি: সংগৃহীত

৪২ বছর বয়সী ট্যাক্সিচালক হোসেনের মনে হয়, জানালা-দরজার বাইরে করোনাভাইরাস কিলবিল করছে। কোনো কিছু স্পর্শ করলেই ভাইরাস সংক্রমিত হবে। তাই জরিরী প্রয়োজনেও বাইরে যেতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন তিনি। আশপাশের সবাইকেই মনে হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত রোগী। সবার দিকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকান আর সারাক্ষণ ভয়ে সিটিয়ে থাকেন। কাজ থেকে বিরতি নিয়েছেন অনেক আগেই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সামাজিকভাবে বিচ্যুত হওয়ার ভয় তাকে তাড়া করে ফিরছে সারাক্ষণ।

করোনা পজিটিভ হয়ে মৃত্যু শুরু হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাজ্যের মুসলিম কমিউনিটিতে প্রধান যে প্রশ্নটি সামনে আসে, সেটি হলো মৃত্যুর পর দাফন ও কাফনের বিষয়টি। মৃতদেহের গোসল কীভাবে হবে, আর জানাজাই বা হবে কীভবে। এ সময় যুক্তরাজ্যপ্রবাসী প্রায় সব মুসলমানই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন । বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধরা সারা জীবন ধর্মীয় বিধিনিষেধ সঠিকভাবে পালনের পর মৃত্যুর পর গোসল না পাওয়ার আশঙ্কায় মুষড়ে পড়েন। কবর না হওয়ার মানসিক চাপ আরও জাঁকিয়ে বসে তাদের মনে।

৬০ ঊর্ধ্বদের আইসোলেশনে যাওয়ার সরকারি নির্দেশ আসার পর থেকে যুক্তরাজ্যের সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে দূরে রাস্তায় বেলুন হাতে দাঁড়ানো প্রিয়জনের সঙ্গে উড়ন্ত চুমু বিনিময় করে লুকিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মোছেন। আর সন্তানেরা দরজার বাইরে গ্রসারির প্যাকেট রেখে, গলার কাছে উঠে আসা কান্না দমিয়ে, জোর করে হাসি ফুটিয়েছেন মুখে। প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন অনেক বয়োবৃদ্ধকে টিভি ক্যামেরার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। অনেকেই তাদের একাকিত্বের জন্য অসহায় বোধ করেছেন।

তবে এই লকডাউনে সবচেয়ে বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে টিন–এজাররা। বাইরে যাওয়ার স্বাভাবিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ায় অনেকেই ভুগছে ডিপ্রেশনে। বয়ঃসন্ধির কারণে পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা ছেলেমেয়েরা ভুগছে একাকিত্বে। অত্যাধিক ক্ষুধামান্দ্যয় হয়ে পড়ছে অসুস্থ।

লেখক।
লেখক।

দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউনের কারণে শিশুরা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের শিশুরা সাধারণত ইস্টারের হলিডেতে পরিবারের সঙ্গে দূরে কোথাও ঘুরতে যায়। কোনো হলিডে হোম বা কটেজে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটায়। এই হলিডে নিয়ে শিশুদের থাকে দারুণ আগ্রহ ও উত্তেজনা। কিন্তু এবার ‘ইস্টার এগ হান্টিং’ ছাড়াই ঘরে বসে ইস্টার হলিডে কাটাতে হয়েছে। বিশেষ করে ভাইবোন ছাড়া শিশুরা একাকিত্বে ভুগছে বেশি। দীর্ঘদিন ঘরের বাইরে না যেতে পেরে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। বাড়ছে রাগ এবং ভাংচুরের প্রবণতা।

ফেব্রুয়ারিতে সাত বছর পার করা আমার ছেলে ছোট্ট জাহিন প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই প্রশ্ন করে,‘মাম্মি, ভাইরাস চলে গেছে?’ নিশ্চুপ আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। জাহিন করোনাভাইরাসের ছবি এঁকেছে। ব্যবহৃত টিস্যুর রোল আর চকলেটের বক্স টেপ দিয়ে লাগিয়ে রকেট তৈরি করেছে। বলছে, এই রকেটে করে সে করোনাকে ‘আউট অফ স্পেস’–এ পাঠিয়ে দেবে। শিশুরা তো আর করোনার ভয়াবহতা বোঝে না। তারা শুধু বোঝে, ঘরের বাইরে ভাইরাস আছে, আর তাদেরকে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। শিশুদের মনে করোনাভাইরাস যে অত্যন্ত গভীর ক্ষত তৈরি করেছে, তা সারিয়ে তোলা মোটেই সহজ হবে না।

লকডাউনের ফলে ব্যাপকহারে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটবে বলে আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিল এনএইচএস। কোভিড-১৯–এর এই মহামারির সময়ে এ ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে আমরা আশা করতে পারি, পৃথিবীর এই অসুখ শিগগিরই সেরে যাবে। আমরাও ফিরে পাব স্বাভাবিক জীবন আর মানসিক সুস্থতা।