ইউটোপিয়া

এই স্বপ্নের স্বর্গ নিয়ে বহুদিন থেকেই মনের কোণে এক সূক্ষ্ম যাতনা বয়ে বেড়াচ্ছিলাম। খুব বেশি গবেষণালব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব ছাড়াও এ নিয়ে দু–এক পাতা দুঃখাঞ্জলি লিখে ফেলাই যায়, যদিও সময়াভাবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আজ মনে হলো কিছু লেখা উচিতই। বিষয়টি ঠাট্টাচ্ছলে শুরু হলেও এ যে অনেকের গভীর অন্তর্দহন, সে আজ সুস্পষ্ট হলো সংগতই। আর এই দহিত হওয়ার সংখ্যা দেশে নেহাত কমও নয়। আশঙ্কা, এই আক্রান্তের সংখ্যা করোনার থেকেও বেশি, এরও কোনো সুচিকিৎসা নেই করোনার মতোই। তাই আতঙ্কের মাত্রাও ভয়াবহ।

বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী করোনার গ্রাসে নিমজ্জিত হওয়ার পরেই এই মনোযাতনা আরও ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমে। সেই করোনার শুরুর কালে, যখন কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জরুরি সাহায্যবিষয়ক জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ বাংলায় (অতিরঞ্জন ও অবাঞ্ছিত শব্দচয়নে) অনূদিত হলো কোনো এক বিজ্ঞ সাংবাদিকের (!) হাতে, মুহূর্তেই সেটি ফেসবুকের পাতায় ভাইরাল হয়ে ঝড় তুলল। তখন থেকেই দূরের-কাছের, পরিচিত-অপরিচিত দেশীয় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই কথাচ্ছলে একটা সূক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। যেন প্রবাসীদের আঘাত দিয়ে কথা বললেই তাঁদের জীবনের সব সমস্যা ‘মুশকিল আসান’ হয়ে যাবে। এর আগেও লক্ষ করেছি বাংলাদেশি বন্ধুরা কারণে-অকারণে বলে থাকেন, ‘তোমরা তো বিদেশে থাকো’ তোমাদের আর সমস্যা কী! আসলেই, আমাদের কোনো সমস্যা নেই।

কিন্তু আমি একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আপনি-আপনারা যাঁরা খুবই সমস্যাক্রান্ত দেশে, তাঁরা চলে আসছেন না কেন বাংলাদেশ ছেড়ে? যখন বিদেশ মানেই স্বর্গ আপনাদের কাছে? নাকি বলবেন, আপনারা দেশকে খুব ভালোবাসেন, তাই আসতে চাইছেন না? আপনাদের দেশপ্রেমে দেশ ভেসে যাচ্ছে উন্নয়নের জোয়ারে! প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে (শ্রমিক ছাড়া) অনেকেরই গাত্রদাহ আছে। একবার কোনো এক বক্তব্যে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারও প্রবাসীদের তুলাধোনা করেছিলেন। যদিও জানি না তাঁর সেই ক্ষোভের পেছনের কারণ কী ছিল!

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈধ অভিবাসনের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (প্রক্রিয়া ভিন্নতর) ছাড়াও কর্মসূত্রে, বিবাহসূত্রে, শিক্ষাসূত্রে এবং সর্বোপরি ব্যবসায়িক সূত্রে বাংলাদেশি বাঙালিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বৈধ অভিবাসনের মধ্যে এই ব্যবসায়ী শ্রেণিরা নিঃসন্দেহে অনেক অর্থকড়ির মালিক। আপনি যখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত পরিশ্রম করেন, তখন টাকাওয়ালা, গাড়িওয়ালা কিংবা বাড়িওয়ালার সুখ দেখে আপনার গাত্রদাহ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে দুঃখের কথা হলো এই যে গাত্রদাহ নিবারণের জন্য না সেই সব গাড়ি-বাড়িওয়ালা, না রাষ্ট্র, না সরকার কেউই আপনার দায়িত্ব নেবে। সুতরাং, যে বা যাঁরা প্রবাসীরা স্বর্গরাজ্যে আছেন ভেবে আপন ঘরেই বহুল কষ্টে জর্জরিত হয়ে দিনাতিপাত করছেন, তাঁদের বলি, আসুন, আপনাকে, আপনাদের সুস্বাগত! কানাডায় চলে আসুন, এখানে আসার যোগ্যতা অর্জন করুন আগে। আসার পরে আপনার যাবতীয় দায় জাস্টিন ট্রুডো নেবেন, সে কথা আপনারা খুব ভালো করেই জানেন। সুতরাং আজই শুরু করুন সেই প্রক্রিয়া।

সাদাচোখে দেখতে গেলে আমি কিংবা আমার মতো আরও হাজারো পরিবার যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, তাতে করে যাঁরা আপনারা দেশে আছেন, পরোক্ষভাবে আপনারাই লাভবান হন। স্বল্প আয়তনের অধিক জনসংখ্যার একটি দেশে যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনের শাসনহীনতাসহ জনজীবন নানা বিপর্যয়ের নিত্যসঙ্গী, সেখানে এই কিছু প্রবাসী আপনাদের বরং বাড়তি জনসংখ্যার চাপ কিছুটা কমিয়েই দিয়েছে। এতে আপনার চাকরিবাজারের প্রতিযোগিতায়ও কিছু লোক কমে গেছে, নেই তাঁরা ঢাকার রাস্তায় বাড়তি ট্রাফিক জ্যাম হয়ে আপনার পাশেই গাড়ি নিয়ে। সুতরাং, আপনাদের গায়ে তো বাড়তি হাওয়াটা, আলো-তাপটা লাগতে পারছে, এতে তো খুশিই হওয়ার কথা!

বস্তুত অভিবাসনের উদ্দেশ্য ব্যক্তিভেদে ভিন্নতর হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিভেদে জীবনের অর্জন, সফলতা, কিংবা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যও যেমন ভিন্নতরভাবে সংজ্ঞায়িত হয়, তেমনি কে কোথায় থাকবেন, কীভাবে জীবন যাপন করবেন তা একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। সে ক্ষেত্রে কোনো স্থির সত্য, কিংবা ভুল-ঠিক বলে কিছুই হয় না, বরং অভিবাসনের ক্ষেত্রে কিছু পুশ-পুল ফ্যাক্টর রয়েছে, যা মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে আবার করেও না। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বৈধ অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সব ধরনের সক্ষমতা সবার থাকেও না।

পরবাসীদের জীবন, সাধারণত আমার মতো খেটে খাওয়া প্রবাসীদের জীবনের রংগুলো অনেকটাই কাছাকাছি। শিকড় ছিঁড়ে আসার বেদনা সবার এক রকম নাও হতে পারে। কেউ কেউ দ্রুতই বৈরী জল–হাওয়ায় বেড়ে ওঠার সক্ষমতা নিয়েই পৃথিবীতে আসেন। তবে যেকোনো বিচারেই মননশীল মানুষের জন্য অভিবাসন খুব সহজতর ব্যাপার নয়। এ বেদনা বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। ফেসবুকে খাবারের, বেড়ানোর, বাইরের চাকচিক্যের অনেক কিছুরই ছবি আপনারা দেখেন; ভেতরের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার আয়োজন যে নয় ওসব, কে–ই বা হলফ করে বলতে পারেন! কে জানে কার বেদনার পাহাড় কত সুউচ্চ! অন্তর্গত বেদনার কথা বাইরের মানুষকে জানিয়ে কীই–বা লাভ?

খুব বড় চাকুরে কিংবা ব্যবসায়ী ছাড়া অভিবাসীরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে পরবাসে দিন গুজরান করেন, এমন দৃশ্যও আমার চেনা ছবিতে নেই। বেশির ভাগেরই দেশে পরিবার-পরিজনকে অর্থ সাহায্য পাঠাতে হয়। যাঁদের নিয়মিত পাঠানোর প্রয়োজন নেই, তাঁরা দেশের বিভিন্ন সংকটে; বন্যায়, শীতে, খরায়, মহামারিতে চাঁদা তুলে বাংলাদেশে টাকা পাঠান। সেসব অর্থসাহায্য খুব উল্লেখযোগ্য কি না, কত বড় অঙ্কের তার থেকেও বড় বিষয় হলো সেসব কেবল ব্যক্তিগত পরিচয়ের, আত্মীয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের হাসপাতাল, স্কুলসহ, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে মানুষের কল্যাণেই ব্যয়িত হয়। অবশ্য এই তালিকায় ব্যাংক লুটেরার দলেরা যে অন্তর্ভুক্ত নন, সে আপনাদের আগেই বলে রাখছি।

এত কিছুর পরেও দেশ নিয়ে টুঁ–শব্দটি উচ্চারণ করা যায় না কোথাও। কি ফেসবুকে, কি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়; প্রবাসীরা দেশ ছেড়েই যেন মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। এমন আশ্লেষে ফেটে পড়েন সবাই, কি বন্ধু, কি স্বজন। সরাসরি না পারলেও আকারে-ইঙ্গিতে সেই ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েই যায়। একটা বিষয় খুব সুস্পষ্ট হওয়া দরকার; যাঁরা প্রবাসে আছেন তাঁরা কি বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করেছেন? কিংবা সরকারি নথিতে তাঁরা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি? যদি তা না হয়ে থাকেন, যদি তাঁদের বাংলাদেশের এনআইডিতে নাম-ঠিকানা-নম্বর নথিভুক্ত থেকে থাকে, তবে আইনত তাঁরাও বাংলাদেশের নাগরিক। আর নাগরিক হিসেবে দেশ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুঃখ-কষ্ট, ভালোবাসা-বেদনায় ঠিক যতখানি অংশ আপনার ততখানি অংশ তাঁদেরও। তাঁরাও মতামত দিতে পারেন, পারেন আলোচনা-সমালোচনায় অংশ নিতে, ঠিক আপনারই মতো। আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, বিশ্বের দরবারে অনেক প্রবাসী বাঙালি এবং তাঁদের উত্তরসূরিরা ‘বাংলাদেশের’ পতাকাকে সমুজ্জ্বল করেছেন নানা আঙ্গিকে; স্বমহিমায়, মেধায়, যোগ্যতায় এবং স্বচেষ্টায়। আর সেসব সুনামের সহভাগিতা নিতে আমাদের দেশীয় পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়, ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত’ পরিচয়ে। কোনো এককালে যাঁদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশে জন্মেছিল বিধায় আপনারা যদি সেই গৌরবেই গৌরবান্বিত হতে চান, তবে এখন কেন প্রবাসীদের ঘৃণা করেন? দেশে থেকে তো তাঁরা এই গৌরব অর্জন করেননি!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনার রাগ-অভিমান, ক্ষোভ কার-কাদের ওপর? সেই সব জোচ্চোর, ব্যাংক লুটেরা, দেশের সম্পদ চুরি করে বিদেশে নিরাপত্তার জন্য পাড়ি দেওয়া প্রবাসীদের ওপর নাকি আমার মতো হাজারো খেটে খাওয়া প্রবাসী নর-নারীর ওপর? আপনি বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ পাচ্ছেন না বলেই আপনার ক্ষোভ, নাকি আপনার দেশে নিরাপত্তা নেই বলে ক্ষোভ? আপনার অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় যাওয়ার মতো দক্ষতা-যোগ্যতা নেই নাকি আপনি দেশকে ভালোবাসেন বলেই দেশ ছাড়তে চাইছেন না? এসব প্রশ্নের জবাব আপনারই ভালো জানার কথা।

একটা কথা বলে শেষ করতে চাই। আপনারা দেশপ্রেমিক অতি, দেশটাকে নিয়ে ভাবেন বলেই দেশে আছেন। আমরা পালিয়ে এসেছি ভালো থাকার জন্য, সেই ভালোবাসার দেশটাকে ভালো রাখুন! এই করোনাকালে কে কী করল কিংবা করল না সেটা নিয়ে অন্যকে কটাক্ষ না করে আপনি কজন ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে আছেন, সেই হিসাবটা আগে কষুন। অন্যের জানালায় উঁকি দিয়ে নিম্নরুচির বাঙালি না হয়ে নিজের মনের দরজা-জানালাগুলোর ঝুলঝাড় পরিষ্কার করে উন্মুক্ত করুন। খোলা বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাস নিন। আগে তো মনের ভাইরাসটিকে মারুন, তারপর না হয় দেহের ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি অর্জন করবেন!

বিশ্বব্যাপী মহামারি তাণ্ডব যুদ্ধে অংশ নেওয়া সব লড়াকুর জন্য ভালোবাসা অনাবিল। নিজেকে, নিজের পরিবারকে সুস্থ রাখুন সর্বাগ্রে। সুস্থ দেহের মতো মনের সুস্থতাও অতি জরুরি। সারাহ গিলবার্টের নেতৃত্বে আর প্রচেষ্টায় করোনা একদিন তাড়াবই আমরা এ বিশ্ব থেকে! কিন্তু তারপর...।

যাঁরা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, তাঁরা তো গেলেনই, বেদনা অপার তাঁদের করকমলে। যারা বেঁচে গেলাম এ যাত্রায়, আমাদের যেতে হবে আরও অনেকটা পথ; এগিয়ে নিতে আমাদের এই বিশ্বটাকে! আসুন, সব কূপমণ্ডূকতার বাইরে এসে বিশ্বমানব হয়ে উঠি। সবাই মিলে ভালো রাখি আমাদের ভালোবাসার এই পৃথিবীটাকে।