সন্তান-১

মাথায় বেশ খানিকটা তেল মেখে মোটা বেণির আগায় কষে সাদা ফিতে বেঁধে নিল জিনাত। একটু ক্রিম ঘষে নিল মুখে। আয়নায় আর একটু দেখে নিল নিজেকে। স্কুল ড্রেসের ওড়না–সালওয়ার সব ঠিকঠাক আছে তো? স্কুলের ঠিক আগের গলিটায় ওত পেতে বসে থাকে নাজমুল। স্কুল ড্রেসের চওড়া সাদা ওড়না আর নীল কামিজ ভেদ করে ওর কিশোরী শরীরের যতটা দেখা সম্ভব, তার সবটাই চোখ দিয়ে গিলে খেতে চায় নাজমুল।

বদমাইশটার কথা মনে হতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে জিনাতের। ব্যাটাকে সামান্য একটু সুযোগ দিলেই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপর। আব্বা আম্মাকে বলে কোনো লাভ নেই।

নাজমুল এলাকার এক সাংসদের ছেলে। বাবার ক্ষমতার জোরে চুরি-নির্যাতন-ধর্ষণ সব মামলায় খালাস পেয়ে যায়। ভাবখানা এমন, যেন গোটা এলাকাটাই তার পৈতৃক সম্পত্তি। এর নামে নালিশ করতে গেলে উল্টো জিনাতের আব্বারই গ্রাম ছাড়া হওয়ার ভয় আছে। শুধু জিনাতের মতো সদ্য প্রস্ফুটিত কিশোরী কেন? ৫০ বছরের বিধবার ওপরেও কামদৃষ্টি হানে নাজমুল। মেয়েদের শরীর দেখলেই তার মুখ দিয়ে লালা ঝরে! 

‘হালায় বাপের হোটেলে খায়, আর সবার ওপর হুকুম চালায়! কুত্তা কোন হানকার!’ মনে মনে গালি ছোড়ে জিনাত।
দুই কাঁধে দুটো সেফটিপিন আটকে স্কুলের ছোট্ট ব্যাগটা পিঠে ফেলে বের হতে যাবে, অমনি ডাক ‘জি-ই-না-আত! একটু শুনিস তো মা!’
‘আম্মা? ডাকেন?’ মুহূর্তে মায়ের সামনে হাজির জিনাত।


‘আসতি পথে ভাজা কিনে আনিস, মুড়ি মাখাব।’
ছোট্ট বেতের ঝুড়িতে সেদ্ধ ছোলা বা মটরশুঁটি, একটু কাঁচা পেঁয়াজ, সরিষার তেল আর চানাচুর দিয়ে মাখা মুড়ি। আহা! জিনাতের কাছে সেটাই এক ঝুড়ি খুশি।
‘টাকা দেন আম্মা, আনবনে কিনে, ভাজা।’


আমেনা বেগম চুলায় আরও কয়েকটা শুকনো পাতা ভরে দিয়ে ঘুরে তাকালেন মেয়ের দিকে। কপালের ওপর চিকচিক করতে থাকা দুই ফোঁটা ঘাম মুছে দিলেন হলুদ মাখা আঁচল দিয়ে।
‘সাবধানে যাবি, জিনাত।’ মেয়ের হাতে একটা ১০০ টাকার নোট গুঁজে বলেন আমেনা।
তবু জিনাতের বের হওয়া হয়ে ওঠে না। ছোট্ট ছোট্ট দুটো শ্যামলা চুড়ি পরা কচি হাত ওর পা জড়িয়ে ধরে: ‘বু! নজিন!’
‘আরে খুকু, ছাড় মা, বুবু স্কুল যায়, স্কুল!’ বড় মেয়ের পা থেকে ছোটটিকে সরাতে চেষ্টা করেন মা। খুকু আমেনার একটু বেশি বয়সের সন্তান। ওর জন্মের পর কিছুদিন চলাফেরাই করতে পারেননি আমেনা। আব্বা আনোয়ারের সঙ্গে মিলে মা আর বোন দুজনকেই একা সামলেছে ১৩ বছরের জিনাত। বুবু ছাড়া খুকু কিচ্ছু বোঝে না।


‘বুবু পারবিনা তোর লজেন্স আন্তি, কি করবিরে মেয়ে তুই?’ ইচ্ছা করেই হালকা ধমকে ওঠেন ছোটটিকে মা।
‘খুকু বুবু কামল ডি বো...’ বলতে বলতে মুখ হাঁ করে তেড়ে গেল খুকু বোনের দিকে।
কাণ্ড দেখে হাসিতে ফেটে পড়লেন আমেনা। জিনাত দুই বছরের বোনকে বুকে তুলে একপাক ঘুরল।
‘খুকু বুবু কামল ডী লে বুবু কান্না কব্ব...’ বোনের কণ্ঠ নকল করার চেষ্টা জিনাতের।
‘না বুবু কান্না কলে না... খুকু কামল ডী বে না... বুবু স্কুল যাও।’


‘জিনাত রে, পাইসিস ছাড়া, এহনি দৌড়া!’ খুকুকে কোলে তুলে বলেন আমেনা বেগম।
জিনাত এবার সত্যিই দৌড়ায়। ‘আসি, আম্মা!’
সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। এখন স্কুলে দেরি করলে চলবে? বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় ১০ মিনিটের পথ। নাজমুল বদটা না থাকলে এটুকু হাঁটতে জিনাতের ভালোই লাগে। গ্রামের ঝিরঝিরে বাতাস, ভেজা পাতার গন্ধ, আর ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট পাখির কিচিরমিচির। পথের বাঁকে সেই ইবলিশের বাচ্চা দাঁড়ানো:
‘কি লো কালী, কোনে জাইস খালি খালি? ’


খালি গা, লুঙ্গি থেকে মনুষ্য বর্জ্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে একটু। বোঝাই যাচ্ছে, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে হয়তো কোনো গাছের নিচেই বসে পড়েছিল সেলিম। সঙ্গে আবার মুখে বিড়িও আছে। গা গুলিয়ে উঠল জিনাতের।
‘পথ ছাড়েন নাজমুল ভাই।’ যথাসম্ভব ভদ্রভাবে বলল জিনাত। ‘আর আব্বায় আকিকা দিয়া আমার একটা নাম রাখসেন! পারলে সেই নামে ডাকবেন।’
‘এহ! কালীর শখ কত! আমারে একটু সুহাগ দিয়া যা না! কত্ত ভালোবাসি তরে।’ জিনাতের কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত চোখ দিয়ে মাপতে মাপতে বলে নাজমুল। ‘কস তো ... চাচার কাছে...’
কথা শেষ করতে পারে না নাজমুল। তার আগেই তার পিঠে ঢিল এসে পড়ে। ‘ওই কে ডা রে?...’


বদমাশটা কিছু বোঝার আগেই জিনাতের হাত ধরে টেনে ছুট দিয়েছে কেউ। চেনা স্পর্শে সাহস পায় জিনাত, ‘ফাতু!’
চার মাইল দূর থেকে ও প্রিয় বান্ধবী ফাতেমাকে চিনতে পারবে জিনাত। শারীরিক গড়নে, গঠনে সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও দুজনে মানিক জোড়। জিনাত যদি হয় তলোয়ার, তবে ফাতু তার ঢাল। ছিপছিপে গড়নের, লম্বা, জিনাতের গায়ের রং সেগুন কাঠের ওপর কালো রঙের প্রলেপের মতো। এমন চামড়ার কারণেই স্কুলে সবাই জিনাতকে ডাকে কালী বলে। অন্যদিকে, ফাতেমা ঠিক দুধে-আলতায় মেশানো, তার মায়াভরা মুখ একবার দেখলে যে কেউ আবার ফিরে তাকাবে।
তবে, নারী শরীরের অভ্যন্তরীণ কিছু জটিলতার কারণে ফাতেমার পক্ষে নিজের শরীরের ওজন সামলানো খুব মুশকিল। তার ওপর এই মেয়েটির উচ্চতা পাঁচ ফুটের কম। ১৪ বছরের ফাতেমা জানে, এসব কারণে সে কোনো দিন মা হতে পারবে না।
আর তাই জিনাত-ফাতেমাকে একসঙ্গে স্কুলে ঢুকতে দেখলে সহপাঠীরা ছড়া কাটে:
‘কালী আর মুটি,
আমরা এক জুটি।’


মুখ শক্ত করে, প্রায় আধবোজা চোখে, কানে আঙুল গুঁজে ক্লাসে ঢোকে দুজন প্রতিদিন, অহেতুক ঝামেলা এড়াতে।
‘আম্মা কন, মানষির সাথে কাইজ্জা করতি নাই। ইরা ডাইন ফিলি গেলি, আমরা বাম ফিলি যাই, নাকি কও, বুন ডি?’ (আম্মা বলেন, মানুষের সাথে ঝগড়া করতে নেই। এরা ডান দিকে গেলে আমরা বাম দিকে যাই, নাকি বল, বোনটি?)
প্রায় কেঁদে ফেলা ফাতেমাকে প্রতিদিন বোঝায় জিনাত। নিজের গায়ের রং নিয়ে মানুষের কথা শুনতে শুনতে জিনাতের চামড়া এখন গন্ডারের চেয়েও পুরু। ১৫ বছর বয়সেই সে জানে, কী করে এক কান দিয়ে শব্দ ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়।
টিফিনের ফাঁকে ব্যাগ থেকে বান্ধবীর জন্য আনা নিজের গাছের কাঁচা আম বের করে ফাতেমা। আম্মার দেওয়া টাকা থেকে ২৫ টাকা দিয়ে স্কুলের সামনের দোকান থেকে একটু লবণ, চিনি আর কাঁচা মরিচ কিনে নেয় জিনাত।
‘ও করিম, তোর বঁটিডা দে দি, ভাইডি, আর এক প্যাকেট ভাজা দিস, আম্মা মুড়ি মাখাবি...।’


‘আরে জিনাত দাঁড়া দাঁড়া... আর সাথে “বু, নজিন?” “নিবি না?”’ মনে করায় ফাতেমা।
‘এই মরসিরে, না নিলি তো ও আমারেই খায়া ফালাবেনে আইজ!’ করিমের সবজি কাটা ছোট্ট বঁটিতে কাঁচা আম কুঁচতে কুঁচতে হাসে জিনাত।
দোকানি ছেলেটি করিম এই দুই বান্ধবীকে বেশ চেনে। আর জিনাতের সাথে যারাই মেশে, খুকুর সাথে সবার পরিচয় আছে। দুষ্টু মিষ্টি খুকু সবার আদরের বোন। করিম জিনাতের অলক্ষ্যে চানাচুরের প্যাকেটের সাথে গোটা পাঁচেক কমলার লজেন্স ভরে দেয়।
ততক্ষণে আম চিনি মরিচ নুনের ভর্তা বানিয়ে ফেলেছে জিনাত। তিনজনে মিলে তারিয়ে তারিয়ে খায় সেটা।
খুচরো ফেরত নেবার সময় করিম বাড়তি ১০ টাকা খুচরো দিলে অবাক হয় জিনাত। ‘কিরে? তোর লজেন্সের দাম তো ই ডা।’
‘খুকু...আইজ নজিন কলিম বাই দে চে, বুবু নেয় না... খুকু বুবু কামল ডি ডাও!’ জিনাতের হাতে প্যাকেট ধরিয়ে বলে
করিম।


‘কামড়াইতে কইস নারে ভাই...ওর কুটি কুটি দাঁতে যে ধার! আবার কামড়ায় কই? সোজা নাকে! ও মাগো!’ নিজের নাক ছুঁয়ে ঠোঁট উল্টায় জিনাত।
জিনাতকে দেখে হেসে খুন বাকি দুজন। একটু পর টিফিনের ঘণ্টা পড়তে করিমকে বিদায় জানিয়ে ক্লাসে ঢুকে যায় দুই বান্ধবী। চলবে....

দ্রষ্টব্য: শুদ্ধ বাংলার পাশাপাশি ফরিদপুরের আঞ্চলিক বাংলাকেও ভালোবাসি। ভাষার সৌন্দর্য বজায় রেখে সামান্য একটু খেলার চেষ্টা করলাম। খেলতে গিয়ে দু–একটা বানানের সাড়ে বারটা বেজে গেছে হয়তো। আট পর্বের ধারাবাহিকটি পাঠক বন্ধুদের জন্য ঈদ উপহার। এবারও সাথে থাকবেন আশা করি।

(Kazi Falguni Eshita, Pasadena City College, California, USA). মেইল [email protected]