সন্তান ২

নাজমুল জিনাতকে যতই বিরক্ত দেখতে চায়, জিনাত ততই ঠান্ডা মাথায় এড়িয়ে যায় সব। তাতে নাজমুলের রক্ত যেন আরও গরম হতে থাকে।

‘কালী মাগির দেমাগ কত! মাইয়া মানষির অত দেমাগ ভালা না। মাইয়া মানষি থাকপি সোয়ামির পায়ের তলে, তয় হয়।’ বন্ধুদের আড্ডায় জিনাতের গল্প করে নাজমুল।

‘শুজা কতায় কাম না হোলি আইত্তা কইরে দে না, ক্যামন বাপের ব্যাটা তুই।’ (ভালো কথায় কাজ না হলে এঁটো কোরে দে, কেমন বাবার ছেলে তুই) বুদ্ধি দেয় এক বন্ধু।

‘হে। এইডা ঠিক হবি। ছেরির ওই...কী আছে, দেখতি বড় মনে চায়।’ ঠোঁট চাটতে চাটতে বলে নাজমুল। ‘একবার সমুখই পড়তি দে ছেমরি রে! আর সাথেরডা? এক্কেরে সাদা হাতি, শালি মুটি! তয় দেখলি বুঝা যায়, খাসা মাল!’
নাজমুলের বাবা আব্বাস আলী তখন নির্বাচনী প্রচার নিয়ে এদিক–ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। কুপুত্রের কুকীর্তি দেখার সময় নেই স্নেহান্ধ আব্বাসের। বাবার কাছে টাকা চাইলেই পাবে নাজমুল। ছেলেকে মামলায় খালাস করতে আব্বাসকে শুধু জায়গামতো টাকা ঢালতে হয়।

ওদিকে কোনো এক শুক্রবারে জিনাতের বাড়ির দরজার কড়া নাড়ে ফাতেমা:
‘অ আমেনা কাকি, বাড়ি আছেন?’
‘ও কিডা রে?’ কড়া নাড়ার শব্দে বেরিয়ে এলেন আনোয়ার মিয়া।
‘সালাম আলাইকুম কাহা, বালো আছেন?’

‘ওয়ালাইকুম সালাম। কিডা? ফাতু? মেলা দিন দেহি নাই তোরে। কাকি তো বাড়ি নাই গো মা, তুই ভিতরে যাইয়ে বয়। দ্যাখ জিনাত কহনে গেল?’ ফাতেমার মাথায় স্নেহের হাত বোলান আনোয়ার।

আনোয়ারের আদর বোঝে ফাতেমা। তার নিজের বাবার পরে ফাতেমার পৃথিবীতে এই একজন পুরুষই আছেন, যিনি মাংসলোভী বাঘের মতো ওর শরীরের এদিক–ওদিক খামচে ধরেন না। নয়তো মাত্র চার ফুট ছয় ইঞ্চির ফাতেমার অতি ওজনের সুযোগে অনেক পুরুষ ওকে অশ্লীলভাবে ছুঁতে চেষ্টা করে নানা বাহানায়। অনেক সময় এমন আক্রমণকারীকে কামড়ে দিয়ে নিজের সম্মান বাঁচায় ফাতেমা।

আনোয়ারের স্নেহের স্পর্শ কয়েক মুহূর্ত উপভোগ করে ফাতেমা। পুরুষের ওই রূপ এই বয়সে দেখার পর এটুকু ওর কাছে যেন স্বস্তির নিশ্বাসের মতো।

‘পালে না পালে না বু আমালে ধত্তি পালে না পালে না...।’ ফাতেমার কানে ভেসে আসে টলোমলো পায়ে দৌড়ানোর শব্দ। আর ওই আধো বুলির কণ্ঠ যে কার, সে তো সবাই জানেন।

ঝড়ের গতিতে উঠানে দৌড়ে আসে খুকু, আর পেছনে আধ খাওয়া ভাতের থালা হাতে ছুটছে জিনাত।

‘থাম বুন, বুবু পরে খেলবানি তোর সাথে, খাতি হবি না রে?’
এবার থামল খুকু। বাড়ির মাটির সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল।

গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আনোয়ার। গামছা কাঁধে ফেলতে জিনাত দৌড়ে গিয়ে সাবান এনে দিল। ‘নেন, আব্বা।’

সাবান নিয়ে আনোয়ার জিনাতের গাল টিপে দিলেন একটু। ততক্ষণে আমেনাও এসে পড়েছেন। মেয়েদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন আনোয়ার: ‘ঘাটে গেলাম গো, আম্মারা! তুমরা ভালো হইয়ে থাইকো!’
আমেনার চোখে শাসন, ‘এহনও যাও নাই ক্যা? শেষে জ্বরজারি হইলে?’

স্ত্রীকে রাগাতেই এমন অবেলায় নাইতে যাওয়া আনোয়ারের।

‘আমার কিচ্ছু হবি না নে। এই গেলাম আর আলাম!’

আমেনা নিজেও কাপড় ছাড়তে ঘরে উঠে গেলেন এবার। জানেন, দুই মানিকজোড়ে মিলে ঠিক সামলে নেবে খুকুকে। হলোও তাই।

দুহাত বাড়িয়ে খুকুর দিকে এগিয়ে গেল ফাতেমা, ‘আইশ, বুজান!’

কোলে নেওয়াও ফাতেমার পক্ষে কঠিন। তবে খুকুর প্রতি স্নেহের কাছে সে কষ্ট কিছুই না। খুকু গিয়ে মুখ গুঁজল ফাতেমার হাঁটুতে।

ওই আধ খাওয়া থালা নিয়ে হাত ধুয়ে ফাতেমা নিজেই খাইয়ে দিতে শুরু করল খুকুকে। খেতে খেতেই খুকু বলে, ‘বু কাই না! ফাতু বু, বু কাই না!’ (বুবু ভাত খায়নি, ফাতু বু!)

শুনে চোখ কপালে তোলে ফাতেমা, ‘কয় কী রে? অই জিনাত, ভাত খাস নাই তুই?’

জিনাত হাঁপাচ্ছে, ‘ওই বিলাইর ছাউ না খাওয়াইলে আমার গলা দি নামে কিসু? আইজ খালি ফালাইতেসে উডা’ (ওই বিড়ালের বাচ্চাকে না খাওয়ালে আমার গলা দিয়ে নামে কিছু? আজ শুধু লাফাচ্ছে ওটা!)

আমেনা বেগম আর একটা বড় থালায় নতুন খাবার সাজিয়ে এনে দিলেন, ‘খুকু আইজ আসলেই মেলা ফালাইসে রে ফাতু, আর পিসে দউরতি দউরতি ওর জান নাই! তিন জনি খাইয়া নে না। (খুকু আজ সত্যি অনেক লাফাচ্ছে রে ফাতেমা, আর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জিনাতের প্রাণ শেষ! তিনজনেই খেয়ে নে না।)’

এক থালায় তিনজনে খাওয়া শেষ করে ওরা। দুই বড় বোনে মিলে খাওয়ায় ওদের ‘বিলাইর ছাউ’ মানে, খুকু কে।

বছর দুই আগে একটা বড় বরইগাছের তলায় বরই কুড়িয়ে নিচ্ছিল ফাতেমা। আচমকা কোথা থেকে যেন উদয় হয় নাজমুল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাজমুল ফাতেমার হাত টেনে ধরে নিজের শরীরের এমন একটা জায়গায় চেপে ধরে ঘষতে থাকে, যে ঘেন্নায় নাজমুলের ওপরেই তীব্র বেগে বমি করে ফেলে ফাতেমা। কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছাতে পারলেও বেশ কিছুদিন বিছানায় পড়ে ছিল সে।

ওই সময়ই যখন ওর শরীরে প্রথম বদল আসতে শুরু করে, হুট করে একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে ফাতেমা। ঘাবড়ে যান ফাতেমার মা শরিফা বানু। ‘ও ফাতুর বাপ, জলদি আসেন গো, মাইয়ার দাঁত লাগছে!’ অবাক হন কৃষক পিতা জামাল উদ্দিন। মেয়ের মুখ দিয়ে ফেনা গড়াতে দেখে তিনিও ঘাবড়ে যান। ‘ফাতু মা? কি হইছে মাগো?’

চোখে–মুখে জলের ছিটাতেও সাড়া নেই মেয়ের। শোরগোল শুনে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসেন আনোয়ার। আমেনা, ‘ও ভাবি কি হইছে কান্দেন ক্যা? জামাল ভাইডি?’

অজপাড়াগাঁয়ে অ্যাম্বুলেন্স পাবেন কোথায়? চার মাসের ঘুমন্ত খুকুকে জিনাতের বুকে ফেলে আনোয়ারের ভ্যানে ফাতেমাকে তুলে নেন দুই মা। আনোয়ার-জামাল পালা করে ভ্যান চালিয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে এলেন নেতিয়ে পড়া ফাতেমাকে। ডাক্তার আপা পরীক্ষা করার পর যা বললেন, শুনে মাথায় বাজ পড়ল শরিফার।

‘ওর গতরে রক্ত এতই কম, আর গতরের ভিতরে আরও মেলা ঝামেলা, বুঝলা ফাতুর মা...ওর পোয়াতি হওয়া মানে ওরে মউতের দরজায় নিয়া ফালান।’ একটু দম নেন ডাক্তার। ‘ওর কোনো দিন মা ডাক শুনা হবিনানে, বুন।’
কেঁপে ওঠেন শরিফা। ‘কী কন? আফা? মাইয়ার আমার বয়স এত্ত কম, বাঁজা মাইয়া আমার? ওরে বিয়া দিতি হবি তো! তায় সেলিম হারামি ডা এহনি ওরে...” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন শরিফা।

ডাক্তারের কণ্ঠে অসম্ভব দৃঢ়তা, ‘চান্দের টুকরা মাইয়া তুমার! ই ডা রে লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষ বানাইবা তুমি। এহন কান্দা মা হইয়া মানায় না তোমারে! আমি ও তো ওই গ্রামেরই মাইয়া, আমি ডাক্তার হইছি না আল্লাহ্‌র রহমতে?’
এতক্ষণ চুপ থাকা আমেনা মুখ খোলেন এবার। আফা, ফাতু মা যে মণিগো বড় ভালো জানে! (আপা, ফাতু মা যে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে!)

শরিফার মুখে যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন, ‘আমার ফাতেমা পারবি, আমি পারামু ওরে!’

সায় দেন আমেনা, ‘তুমি একা না ভাবি, ফাতেমা আমার জিনাতের কলিজা! আমরা দুইজন মিলা সামলামু ওরে! উডা আমার আর একটা মাইয়া!’

কথার ফাঁকে দুই ঢোঁক পানি গিলে নিলেন ডাক্তার, ‘আর বিয়ার কথা কও? মাআ বুদের দুনিয়ায় সব পোলাই কি নাজমুলের মতন ইবলিশের বাচ্চা? ’

*পাঠক বন্ধুদের কাছে এ প্রশ্নটা আমারও, এই সুন্দর পৃথিবীতে সব পুরুষই কি নাজমুলের মতো হয়? আপনারা কি বলেন? সঙ্গে থাকুন। চলবে....

আরও পড়ুন:
সন্তান-১