পর্যটনে ক্ষতি কীভাবে পোষাবে ইউরোপ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিতে পর্যটন খাত ১০% জিডিপিতে যুক্ত করে। করোনার কারণে তা এবার হচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিতে পর্যটন খাত ১০% জিডিপিতে যুক্ত করে। করোনার কারণে তা এবার হচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপ পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যের লীলাভূমি, এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যমণ্ডিত, খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গেলে ইউরোপের প্রতিটি দেশই অন্যতম হাজার বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত নয়নাভিরাম স্থাপত্যশৈলী। বিশ্বের অন্যতম নামকরা ঐতিহাসিক জাদুঘর, সাগর, পাহাড় , নদী ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত সুসজ্জিত মনজুড়ানো প্রাকৃতিক পরিবেশ। তা ছাড়া ভোজন বৈচিত্র্য, পানশালা ও নানা ধরনের বিনোদনে ভরপুর সাজানো-গোছানো এক পর্যটনকেন্দ্র ইউরোপ। সে কারণেই পর্যটকদের কাছে অবকাশযাপনের জন্য খুবই আকর্ষণীয় স্থান ইউরোপ। বছরব্যাপী পর্যটকেরা ইউরোপে ভিড় করেন, তবে পর্যটন মৌসুমে অর্থাৎ গ্রীষ্মে পর্যটকের আগমন হয় বেশি।

ইউরোপে বসবাসরত ৭০ ভাগ প্রবাসী কোনো না কোনোভাবে পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত। কেউ ব্যবসা করেন বা কেউ চাকরি করেন। যাঁরা ব্যবসা করছেন করোনা ভাইরাসের প্রকোপে তাঁরা এখনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারেননি বা খুলতে পারলেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। যাঁরা এ খাতে আগে চাকরি করতেন, অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন বা ঘরে থাকার কারণে কম বেতন পাচ্ছেন। বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন রকম সাবসিডি বা অর্থ সহযোগিতা করছে, তবে তা ক্ষতির মানদণ্ডে খুবই অপ্রতুল।

এমতাবস্থায় তাঁরা আগের মতো দেশে অবস্থিত পরিবারের কাছে অর্থ পাঠাতে পারছেন না, বর্তমানে রমজান ও ঈদ উপলক্ষে কিছুটা চেষ্টা থাকলেও সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াবে এ খাতসংশ্লিষ্ট মানুষদের। এমতাবস্থায় চলুন জেনে নিই ইউরোপের অর্থনীতিতে পর্যটনশিল্পের অবদান এবং বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারির পেক্ষাপটে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী?

পৃথিবীর মোট ভ্রমণকারীর ৪০ ভাগ পর্যটক ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এ ছাড়া এই অঞ্চলের স্থানীয় পর্যটক তো আছেনই, কেননা গ্রীষ্ম মৌসুমে ইউরোপে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারই নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যায় অবকাশযাপনের জন্য।
সংগত কারণেই ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনীতিতে পর্যটন একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতিতে পর্যটন খাত থেকে আসে ১০%।

পৃথিবীর মোট ভ্রমণকারীর ৪০ ভাগ পর্যটক ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ছবি: সংগৃহীত
পৃথিবীর মোট ভ্রমণকারীর ৪০ ভাগ পর্যটক ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ছবি: সংগৃহীত

৮৫% ইউরোপিয়ান নাগরিক গ্রীষ্মের ছুটিতে ইউরোপের অভ্যন্তরে অবকাশ যাপন করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্রোয়েশিয়ায় ২৫%, সাইপ্রাসে ২২%, গ্রিসে ২১%, পর্তুগালে ১৯%, অস্ট্রিয়া, ইস্তোনিয়া, স্পেনে মোট ১৫%, ইতালিতে ১৩%, স্লোভেনিয়া ও বুলগেরিয়ায় ১২%, মাল্টায় ১১%, ফ্রান্সে ১০% ও জার্মানির অর্থনীতিতে ৯% অবদান রাখে পর্যটনশিল্প।

পর্যটন খাতে কর্মসংস্থান চিত্র
১২% কর্মসংস্থান এই পর্যটন খাতে (গড় হিসাবে)। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৩ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান এ শিল্পে।
পর্যটন খাতের যুব কর্মসংস্থান আধিক্য বেশি। এ খাতে মোট কর্মসংস্থানের ৩৭% কর্মীর বয়স ৩৫ বছরের নিচে।

করোনায় পর্যটনে ক্ষতির পরিমাণ

বর্তমান প্রেক্ষাপট ইউরোপীয় পর্যটনশিল্পে ব্যাপক আঘাত এনেছে, বলতে গেলে পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণ নিষিদ্ধ, এর ফলে বিমান সংস্থা হোটেল ,রেস্টুরেন্টের সঙ্গে জড়িত সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে পড়েছে এবং কিছু কিছু অবসায়নের দ্বারপ্রান্তে, আশার আলো কিছু নেই বরং এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন এসে দাঁড়িয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনের হিসাবমতে, বিশ্বে পর্যটনশিল্প ৬০%–এর নিচে নেমে গেছে এবং অর্থের হিসাবে ৮৪০ থেকে ১০০০ বিলিয়ন ইউরো সমপরিমাণ ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে এ পর্যন্ত।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৩ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান পর্যটনশিল্পে। ছবি: সংগৃহীত
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৩ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান পর্যটনশিল্পে। ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপীয় ইউনিয়নে ক্ষতি

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলোর পর্যটনকে কেন্দ্র করে ২.৪ মিলিয়ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। তাদের ৯০ ভাগই ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসা। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৬০% থেকে ৯০% বুকিং কম হয়েছে একই সময়ে অন্য বছরের তুলনায়। ৬০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, ট্যুর অপারেটর, দূরপাল্লার ট্রেন ৮৫% রাজস্ব হারিয়েছে। বিমান সংস্থা এবং ক্রুজ শিপ ৯০% রাজস্ব হারিয়েছে।

পর্যটন ব্যবস্থা একটি ইকোসিস্টেমের মতো কাজ করে, একজন পর্যটক বিমান সংস্থা থেকে শুরু করে, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুর গাইড, যানবাহন, স্থানীয় ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আর্থিক গতি তৈরি করে।

উপরিউক্ত ক্ষতি মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন তহবিল গঠন করেছে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলোকে অর্থ সহযোগিতার মাধ্যমে পুনর্গঠন এবং শিগগিরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্তসীমান্ত পর্যটন চালু করার পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের গতি–প্রকৃতির ওপর।

এমনিতেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ইউরোপ অন্যতম রপ্তানি বাজার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা সংকুচিত হয়ে আসছে। অপর দিকে এখান থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের ঘাটতি আমাদের এই সুজলা সুফলা মাতৃভূমির জন্য অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।